দেশীয় উদ্যোক্তাদের হাতে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ‘বালাচাও’
'বালাচাও' মূলত চিংড়ি, পেঁয়াজ, রসুন, শুকনো মরিচ ও মশলার ভর্তা; যা দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়। মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের জনপ্রিয় এই খাবারটি কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয়; যা ভাত, খিচুড়ি, ফ্রায়েড রাইস ও সালাদসহ বিভিন্ন ধরনের সবজির সঙ্গে খাওয়া যায়। গত কয়েক বছরে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের হাত ধরে ঘরে বানানো খাবারটি 'রেডি টু ইট ফুড' হিসেবে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সারাদেশে।
বর্তমানে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ছাড়াও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ এমনকি খুলনা অঞ্চলের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারাও এটি বাজারজাত করছেন; পাওয়া যাচ্ছে সুপারশপেও। এসব উদ্যোক্তাদের ৯০ শতাংশই নারী। সময়ের পরিক্রমায় দেশীয় খাবার হয়ে ওঠা রেডি ফুড বালাচাও দেশের সীমানা ছাড়িয়ে যাচ্ছে আমেরিকা, লন্ডন, সিঙ্গাপুর ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে। প্রবাসীদের কাছে ভালো চাহিদা রয়েছে এই খাবারের।
চট্টগ্রামের নারী উদ্যোক্তা ও সেলিমা'স কিচেনের স্বত্বাধিকারী সেলিমা ইসলাম দশ বছর আগে এক থাই পর্যটকের মাধ্যমে বালাচাও রেসিপির সঙ্গে পরিচিত হন। প্রথমদিকে ঘরোয়াভাবে তৈরী করলেও দুই বছর ধরে তিনি রেডি ফুড হিসেবে বালাচাও বাজারজাত করছেন।
সেলিমা ইসলাম বলেন, 'এটি পুরোপুরিভাবে একটি ফ্যামিলি প্রোডাকশন। নিজের ঘরে তৈরী করে প্রতিদিন প্রায় ২০০ কৌটা পণ্য আমরা বাজারে দিচ্ছি। পরিবারের সাতজন সদস্য আমাকে সহায়তা করছে।'
'চট্টগ্রামের কাজীর দেউড়ি, চকবাজারসহ সারাদেশে অন্তত ১০০টি শুঁটকির আড়ত, মুদি দোকানে ঘরে তৈরী বালাচাও সরবরাহ করে থাকি। যার বাজারমূল্য প্রায় ৬ লাখ টাকা', বলেন সেলিমা ইসলাম।
বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সুপারশপেও বালাচাও বিক্রি হয়। তবে এই পণ্যটির সবচেয়ে বড় বাজার অনলাইনে। ফেসবুকসহ অনলাইন প্লাটফর্মে অন্তত হাজারখানেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা রয়েছেন, যারা ঘরে তৈরী বালাচাও বিক্রি করছেন।
বাজারে মানভেদে ১৪০ গ্রামের কৌটা ১৩০ থেকে ২০০ টাকা, ২৪০ গ্রাম ২১০ থেকে ৩৫০ টাকা ও ৩০০ গ্রামের কৌটা ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়।
যেভাবে এদেশে জনপ্রিয় হলো বার্মিজ বালাচাও
কক্সবাজারের ব্যবসায়ী সরওয়ার সোহেল জানান, ১০ বছর আগেও বালাচাও পরিচিত কোনো প্রোডাক্ট ছিলো না। মিয়ানমার থেকে বিভিন্ন আচারের সঙ্গে কক্সবাজারের বার্মিজ মার্কেটে বালাচাও নিয়ে আসতেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। স্থানীয় রাখাইন, চীনা ও থাই পর্যটকদের কাছে বালাচাওয়ের কদর ছিলো তখন থেকেই। আমাদের দেশের শুটকি ভর্তার সঙ্গে অনেকটা মিল থাকায় পরবর্তী সময়ে এটি স্থানীয়দের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে উঠে।
সরওয়ার সোহেল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বর্তমানে দেশের সৌখিন শ্রেণীর ক্রেতা ও প্রবাসীদের কাছে বালাচাওয়ের বেশ কদর রয়েছে। গত চার বছর ধরে নিজের তৈরী বালাচাও ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম ও রংপুরের ২০টি সুপার শপে সরবরাহ করছি।'
তরুণ আইনজীবি ইমতিয়াজ বোরহানের পরিবার প্রায় ৩০ বছর ধরে শুঁটকি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। বাবার হাত ধরেই চট্টগ্রামে শুঁটকির সবচেয়ে বড় আড়ত আসাদগঞ্জে তার যাওয়া-আসা। ২০১৭ সালের দিকে তিনি অনলাইনে বালাচাও সম্পর্কে জানতে পারেন। পরবর্তীতে নিজ উদ্যোগেই এটি তৈরীর পদ্ধতি শেখেন, শেখান নিজ পরিবারের সদস্যদেরও। বর্তমানে তার অনলাইন প্লাটফর্ম 'ইজি শুঁটকি শপিং' এর মাধ্যমে বালাচাও যাচ্ছে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
ইমতিয়াজ বোরহান টিবিএসকে বলেন, 'বালাচাও বিক্রির পুরো ব্যবসাটাই অনলাইন নির্ভর। ফেসবুক পেজে প্রোডাক্ট দেখে ক্রেতারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আমরা তাদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য তৈরী ও প্যাকেটজাত করে পাঠাই। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া, নিউইয়র্ক, লন্ডন ও অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে প্রতি মাসে প্রায় ১০০ কেজি বালাচাও যাচ্ছে।'
লন্ডন প্রবাসী শাহরিয়ার ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'প্রবাসের ব্যস্ত জীবনে দেশীয় খাবার পাওয়া অনেকটা ভাগ্যের। সেদিক থেকে বালাচাও বেস্ট। কারণ এটিতে রান্নার কোনো ঝামেলা নেই। প্যাকেটজাত খাবারটি যখন ইচ্ছে খাওয়া যায়। তাই প্রবাসীদের কাছে এটি বেশ জনপ্রিয়।'
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বালাচাও সরাসরি রপ্তানি পণ্য হিসেবে বিদেশে যাচ্ছে না। মূলত সৌখিন ক্রেতারা ব্যক্তি পর্যায়ে, আবার অনেকে কুরিয়ারে করে অন্য পণ্যের সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন।
উদ্যোক্তারা বলছেন, এখন পর্যন্ত দেশে বালাচাও উৎপাদনের জন্য বড় কোনো কারখানা গড়ে উঠেনি। এর প্রধান কারণ হলো বিএসটিআইয়ের অনুমোদন ও ব্যাংক ঋণ সুবিধা না পাওয়া। সম্ভাবনাময় খাতটিতে বাঁচাতে প্রয়োজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ এবং প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান।
নারায়ণগঞ্জের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও ইয়ামি ফ্রেশ ফুডের স্বত্বাধিকারী সাদিয়া আক্তার সায়মা বলেন, 'অনলাইনে প্রচার প্রচারণা দেখে বালাচাওয়ের বাজারটিকে যত বড় মনে হয়, আসলে তা না। একজন ক্রেতা একমাসে ২০০ থেকে ৩০০ গ্রামের বেশি অর্ডার করেন না। সবমিলিয়ে মাসে ৫০ কেজির মত বিক্রি হয়। তবে চিংড়ি ও পেঁয়াজের দাম বাড়ার কারণে ব্যবসাটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ব্যবসা যা হচ্ছে পুরোটাই হচ্ছে ব্যক্তিচেষ্টায়।'
ঘরে যেভাবে তৈরী করবেন বালাচাও
উপকরণ: চিংড়ি শুঁটকি- ২ কাপ; পেঁয়াজ কুঁচি- ১ কাপ; রসুন ছেঁচা- আধা কাপ; শুকনা মরিচ- ১ মুঠো (আস্ত); লবণ- আধা চা চামচ
তেলে পেঁয়াজ বেরেস্তা করে তুলে রাখুন। এবার একই তেলে ছেঁচা রসুন মুচমুচে বাদামি করে ভেজে তুলে নিন।
একইভাবে শুকনা মরিচ ভেজে নিন। সবশেষে চিংড়ি মাছ শুঁটকি মচমচে করে ভাজুন। ভাজার সময় লবণ দিতে হবে। এবার বেরেস্তা, রসুন ভাজা ও মরিচ হাতে ভেঙে চিংড়ির সঙ্গে মিশিয়ে দিন। সবকিছু একটু সময় নিয়ে কম আঁচে ভাজতে হবে। রান্না শেষে ধোঁয়া ওঠা ভাতের সঙ্গে পরিবেশন করুন বালাচাও।