জনপ্রশাসন পদকপ্রাপ্ত হাটহাজারীর ত্রিপুরা পল্লীর স্কুলটি বন্ধ হয়ে গেছে
হাটহাজারী উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরের নিভৃত এক পল্লীর নাম 'মনাই ত্রিপুরা'। সেই ত্রিপুরা পাড়ায় 'আমার জেলা আমার শহর' মডেল উদ্যোগ বাস্তবায়ন করে জেলা পর্যায়ে সাধারণ (প্রাতিষ্ঠানিক) ক্যাটাগরিতে 'জনপ্রশাসন পদক ২০২০' পেয়েছিলো হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কার্যালয়। নিভৃত সেই পল্লীতে শিক্ষার আলো জ্বালানো একমাত্র প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়টি গত চার মাস বন্ধ থাকলেও বিষয়টি জানা নেই বলে দাবি পুরস্কারের কৃতিত্ব নেওয়া উপজেলা প্রশাসনের।
সভ্যতার আলো থেকে দূরের পাহাড়ি গ্রাম সোনাই ও মনাই ত্রিপুরা পল্লী। যেখানে সকল সরকারি সুবিধার বাইরে থেকে শত বছর ধরে বসবাস করে আসছিলো ১৪০টি আদিবাসী পরিবার। ২০১৭ সালের পাহাড় ধস ও ২০১৮ সালে হামে ৪ শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় প্রশাসনের নজরে আসে নিভৃত এই পল্লী দুটি।
তৎকালীন হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিন ও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের আন্তরিক প্রচেষ্টায় শুরু হয় ক্ষুদ্রপল্লীর অধিবাসীদের সমস্যা সমধান ও জীবনমান উন্নয়নে কাজ। পাহাড় থেকে সরিয়ে বাড়ি করে দেওয়া হয় ১২ পরিবারকে। স্থাপন করা হয় স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার, সুপেয় পানির জন্য ৩টি গভীর নলকূপ।
দুর্গম এলাকাটিতে বিদ্যালয় না থাকায় শিশুরা ছিল শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। উপজেলা প্রশাসনের চেষ্টায় ২০১৮ সালে 'আমার জেলা আমার শহর' প্রকল্পের আওতায় প্রতিষ্ঠা করা হয় এলাকার প্রথম ও একমাত্র বিদ্যালয়টি। মন্দিরভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় নিয়োগ দেওয়া হয় শিক্ষক। অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনা নিয়মিত রাখতে শিক্ষার্থীদের জন্য চালু করা হয় 'শিক্ষা বৃত্তি'। শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে ইউনিফর্ম প্রদান সহ যাবতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার উদ্যোগ নেয় তৎকালীন উপজেলা প্রশাসন।
কিন্তু অজ্ঞাত কারণে গত দেড় বছর ধরে বেতন পাচ্ছিলেন না স্কুলশিক্ষিকা বিরণ বালা। চলতি বছরের শুরুতে তিনি বিদ্যালয় থেকে পদত্যাগ করেন। ফলে গত চারমাস ধরে স্কুলটির শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এ নিয়ে উপজেলা প্রশাসন ও মন্দিরভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমে জড়িত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করেও স্কুলটি চালু করা যায়নি বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
স্কুলের সাবেক শিক্ষিকা বিরণ বালা বলেন, 'আমাদের যে সম্মানি দেওয়া হতো, সেটা দিয়ে জীবন চলে না। তারপরেও এলাকার সন্তানদের শিক্ষার কথা ভেবে অভাবের মধ্যেও দেড়টা বছর স্কুল চালিয়েছি। কিন্তু পেট তো মনের কথা বোঝেনা, সে খাবার কেনার টাকা চায়। তাই বাধ্য হয়ে রিজাইন দিয়েছি।'
মনাই ত্রিপুরা পাড়ার সভাপতি সচিন ত্রিপুরা বলেন, 'কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থীদের একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে গেলেও উপজেলা প্রশাসন থেকে এ নিয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আমি নিজে কয়েকবার স্কুল চালুর জন্য মন্দিরভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষার কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু তারা নতুন করে কোনো শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছে না। স্কুল বন্ধ থাকায় মনাই ত্রিপুরা পল্লীর প্রায় ৫০ জন শিশুর শিক্ষা জীবন এখানেই শেষ হবার উপক্রম হয়েছে।'
এদিকে চার মাস আগে স্কুর বন্ধ হলে সেটা জানা নেই বলে দাবি উপজেলা প্রশাসনের। কেন বন্ধ আছে তার কোনো স্পষ্ট কারণ জানাতে পারছে না।
রোববার বিকেলে এ বিষয়ে জানতে হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. শাহিদুল আলমের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি টিবিএসকে জানান, "স্কুলটি বন্ধ নাকি খোলা বিষয়টি আমার জানা নেই।"
অবশ্য কিছুক্ষণ পরে উপজেলা নির্বাহী অফিসার এই প্রতিবেদককে ফোন করে স্কুল বন্ধ থাকার বিষয়টি স্বীকার করেন।
সে সময় তিনি বলেন, 'মন্দির ভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম থেকে স্কুলটির একমাত্র শিক্ষিকাকে বেতন দেওয়া হতো। বেতন বন্ধ থাকায় ওই শিক্ষিকা আর পাঠদান করছেন না। অন্যদিকে বিজ্ঞপ্তি দিয়েও দুর্গম এলাকায় যাওয়ার মত শিক্ষক পাওয়া যাচ্ছে না। বিষয়টা যেহেতু জানাজানি হলো, তাই এবার উপজেলা প্রশাসন নিজ ফান্ড থেকে ব্যবস্থা নিয়ে স্কুল চালু করবে।'
তবে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের এ দাবি নাকচ করে দিয়ে মনাই ত্রিপুরা পাড়ার সভাপতি সচিন ত্রিপুরা বলেন, 'স্কুল বন্ধের বিষয়টি বেশ কয়েকবার উপজেলা প্রশাসন ও মন্দির ভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমে জড়িত সংশ্লিষ্টদের জানানো হয়েছে। আমরা বলেছিলাম বর্তমান শিক্ষিকা না হলে আমাদের সন্তানদের মধ্যে অনেকে স্কুল-কলেজে পড়ালেখা করেছে তাদের নিয়োগ দিন, কিন্তু তা করা হয়নি।'
জেলা মন্দির ভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমের প্রকল্প পরিচালক রিংকু কুমার শর্মা বলেন, 'আগের শিক্ষিকার বকেয়া বেতনের কিছুটা পরিশোধ করা হয়েছে। কিন্তু তিনি আর কাজে যোগ দিতে রাজি নন। এ অবস্থায় আমরা নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু এলাকাটি দুর্গম হওয়ায় কেউ যেতে চান না। এছাড়া স্থানীয়ভাবে যাদের আবেদন পেয়েছি, তারা যোগ্য নন। আগামী মাসে স্কুলটিতে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে আমরা বসবো।'
এর আগে গত ফেব্রুয়ারী মাসে বন্ধ হয়ে যায় সীতাকুণ্ডের দক্ষিণ সোনাইছড়ি ত্রিপুরাপাড়া প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়টি। সেখানেও শিক্ষকের বেতন বন্ধ থাকায় পদত্যাগ করেন বিদ্যালয়ের দুই শিক্ষক।
জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, 'দুর্গম পল্লীতে সরকার শিক্ষার আলোসহ নানা সুবিধা পৌঁছে দিয়েছে। কিন্তু স্কুলগুলো যে বন্ধ হয়ে গেছে, সেটি আমাকে কেউ জানায়নি। যাই হোক আমি যথাশীঘ্র স্কুল চালুসহ সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দিচ্ছি।'