ভাল ঋণ, মন্দ ঋণ- ঋণ কি কখনো ভাল হতে পারে?
আমরা সবাই ঋণমুক্ত একটা জীবন যাপন করতে চাই। আমরা ব্যবসাকে ঋণমুক্ত করতে চাই, কারণ আমরা শুধু ঋণের খারাপ দিকটাই দেখি ভালো দিকটা দেখি না বা মাঝে মাঝে বুঝি না।
প্রশ্ন হচ্ছে ঋণের কি ভালো কোন দিক আছে? অবশ্যই আছে। ঋণ মূলত কি? আমরা কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে আমাদের ব্যক্তিগত বা বাবসায়িক প্রয়োজনে যে টাকা ধার নেই সেটাই মূলত ঋণ। কারণ এই ঋণের নীতির সাথে আমাদের সুদ অথবা লভ্যাংশ পরিশোধ করতে হয়। আবার কেউ কেউ তাদের কোন আত্মীয়-স্বজন থেকে বিনা সুদে ঋণ গ্রহণ করে থাকেন।
প্রশ্ন হচ্ছে ঋণ কি ভালো নাকি ঋণ খারাপ? সেটা মূলত তার ব্যবহারিক দিকটা দেখেই ঠিক করতে হয়। যেমন যদি কোন ঋণ নিয়ে আপনি খেয়ে ফেলেন বা কোন ভোগ্যপণ্য কেনেন বা এমন কোন দ্রব্য কেনেন যা দিয়ে প্রতি মাসে কোন টাকা আসে না, তাহলে সেই ঋণ ভালো ঋণ নয়। সেটা মূলত মন্দ ঋণ। আবার যে ঋণ আপনার আয়কে বাড়িয়ে দেয়, যে ঋণ আপনার সম্পদের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় সেই ঋণ হচ্ছে ভালো ঋণ।
তাহলে ভালো ঋণ আপনি কিভাবে বুঝবেন? এর রূপ, রং সবই তো একই কিন্তু ভালো ঋণ বা মন্দ ঋণ কোনটা সেটা জানা খুব দরকার। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। যেমন ধরুন আপনি ঋণ নিয়ে একটা গাড়ি কিনলেন। আপনার কাছে আরো কিছু টাকা ছিল, সেই টাকাটা ব্যবহার করে আপনি আপনার গাড়ির সাজসজ্জা করলেন। এরপরে সেই গাড়িটা আপনি আপনার পারিবারিক প্রয়োজনে ব্যবহার করা শুরু করলেন। গাড়ির ইন্সটলমেন্টের টাকা আপনাকে দিতে হচ্ছে নিজের পকেট থেকে। আপনার যে বর্তমান ইনকাম সেখান থেকে আপনার পরিবারের জন্য অতিরিক্ত খরচ করতে হচ্ছে। এই ঋণ আপনার জন্য ভালো কিছু করেনি। এই ঋণ আপনার ক্যাশ ফ্লো বাড়িয়ে আপনার নেটওয়ার্থ-কে বাড়াতে পারে নাই। কিন্তু এই গাড়িটাই যদি আপনি কিনে উবারে ভাড়া দেন বা কোন অফিসকে ভাড়া দেন তাহলে প্রতি মাসে সেখান থেকে একটা ভাড়া আপনার আসছে এবং সেই ভাড়া দিয়ে আপনি ইনস্টলমেন্ট পরিশোধ করতে পারছেন। আপনি ইনস্টলমেন্টের সম্পূর্ণ পরিশোধ করতে না পারলেও বেশিরভাগই আপনি পরিশোধ করতে পারবেন। আর যদি এমনটি হয় যে সেই ভাড়া দিয়ে আপনি ইনস্টলমেন্টের চেয়ে বেশি করতে পারেন তাহলে আপনার জন্য এই ঋণ অনেক ভালো। একটা পর্যায় পরে যখন ব্যাংকের দেনা পরিশোধ হয়ে যাবে তখন দেখবেন যে গাড়িটা আপনার থেকে যাচ্ছে এবং তখন যে ভাড়াটা পাচ্ছেন, সেই ভাড়াটা আপনার কাছেই থেকে যাচ্ছে। আপনার ইনকামে সেই টাকাটা যোগ হচ্ছে, আপনার সম্পদ বেড়ে যাচ্ছে, আপনার নেটওয়ার্থ-ও বেড়ে যাচ্ছে।
আমাদের দেশে সবারই স্বপ্ন থাকে যে একটা সুন্দর অ্যাপার্টমেন্টে আমরা বসবাস করবো বা নিজের একটি বাড়ি থাকবে। সেক্ষেত্রে নিজেরা যারা চাকরি করেন তাদের পক্ষে একসাথে অনেকগুলো টাকা জোগাড় করা সম্ভব হয়ে উঠে না। প্রথমেই তারা বিশ পার্সেন্ট ইকুইটি বা তিরিশ পার্সেন্ট ইকুইটি কোন না কোনভাবে ম্যানেজ করে। এবং বাকি টাকাটা লোন এ কাভার করে থাকেন। যখন আপনি লোন এ বাড়ি কিনছেন তখন এটা কি আপনার সম্পদ হচ্ছে নাকি দায় হচ্ছে, সেটা একটু দেখতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটা সম্পদ না হয়ে দায়ে রূপান্তরিত হয়। কারণ দেখবেন যে, আপনি হয়ত ইন্সটলমেন্টে সত্তর-আশি হাজার টাকা পরিশোধ করছেন কিন্তু এই বাড়ি বা এপার্টমেন্ট যদি আপনি ভাড়া দেন তখন সেখান থেকে আপনি যে ভাড়াটি পাচ্ছেন সেটা হয়ত তিরিশ বা চল্লিশ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে আপনার ইন্সটলমেন্ট হচ্ছে না। প্রতি মাসে আপনার আয় থেকে বাকি টাকা পূরণ করে ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে। অর্থাৎ এই গ্যাপ টাকাটা আপনার প্রতি মাসে পকেট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। এবং দশ বছর বা পনেরো বছর বা বিশ বছর মেয়াদে আপনি বাড়ি কিনেন না কেন যতদিন আপনার বাড়ির এই ঋণের টাকাটা পরিশোধ না হচ্ছে ততদিন আপনার এটা একটা অতিরিক্ত প্রেশার। যতদিন আপনার ঋণ পরিশোধ না হচ্ছে ততদিন এটা কিন্তু আপনার সম্পদ নয় বরং এটা আপনার দায়।
তার কারণ এটা আপনার আয়কে বাড়াচ্ছে না বরং প্রতি মাসে এটা আপনার পকেট থেকে টাকা বের করে নিয়ে যাচ্ছে। তাই সে আপনার সঞ্চয় থেকে হোক বা আপনার আয় থেকে হোক। প্রতি মাসে আপনার টাকা অ্যাসেট থেকে ল্যাইবিলিটিতে শিফট হচ্ছে। শিফট হতে হতে দেখবেন যে আপনার নেটওয়ার্থ কমে যাচ্ছে। একটা পর্যায়ে এসে আপনার বাড়িটির লোন পরিশোধ হয়ে যাবে। বাড়ির ঋণ যখন পরিশোধ হয়ে যাবে তখন আপনার অ্যাসেট বেড়েছে ঠিকই কিন্তু এর মধ্যে আপনার খুব একটা খারাপ অবস্থা বা জীবনের উপরে বাড়তি চাপ দিয়ে আপনি যাচ্ছেন।
ফলে যখন আপনি ঋণ নিয়ে কোন কিছু কিনবেন তখন আপনি খুব সতর্ক থাকবেন। এই ঋণ আপনার জন্য কি ভালো ঋণ হচ্ছে নাকি খারাপ ঋণ হচ্ছে? ভালো ঋণ হলে সেটা গ্রহণযোগ্য হবে আর মন্দ ঋণ হলে সেটা অগ্রহণযোগ্য হবে কারণ মন্দ ঋণ আমাদের নেটওয়ার্থ কমাতে থাকবে।
তবে ঋণকে আমরা সব সময় শুধু খারাপ বলবো না, ঋণ ভালো যদি আপনি সেটাকে ভালভাবে ব্যবহার করতে জানেন। অনেক ব্যবসায়ী ঋণ নিয়ে তাদের ব্যবসাকে দিন দিন বড় করেছেন। কারণ ঋণ নিয়ে যে ইন্টারেস্ট তারা দিয়েছেন তার থেকে ওই ঋণকে ব্যবহার করে যে রিটার্ন তারা পেয়েছেন বা লভ্যাংশ তারা পেয়েছেন তা কয়েক গুণ বেশি। আবার অনেক ছোট ছোট ব্যবসায়ী দেখবেন যে, ব্যবসার জন্য টাকা নিয়েছেন কিন্তু সেই ব্যবসায় টাকাটা পুরোটা না খাটিয়ে অর্ধেক খাটিয়েছেন, বাকিটা নিজেরা ভোগ করেছেন। অর্ধেক ব্যবসায় খাটিয়েছেন ফলে ব্যবসা ভালমত করতে পারেন নাই, ফলে ব্যবসা থেকে বেরিয়ে গেছেন।
আমাদের দেশে অসংখ্য ব্যবসায়ী ব্যবসা ধরে রাখতে পারেননি ঋণকে কার্যকরভাবে ব্যবহার না করতে পারার কারণে। আবার অনেক ব্যবসায়ী অনেক বড় হয়েছেন ঋণকে ভালভাবে ব্যবহার করতে পারার কারণে। সুতরাং ঋণ সবসময় খারাপ নয়। ঋণ ভালো হতে পারে যদি আপনি সেটাকে ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারেন।
আপনারা যদি আপনাদের পার্সোনাল ফাইন্যান্স-কে সাজাতে পারেন তাহলে আপনাদের নিজের জীবনকে সাজাতে পারবেন। এবং আমি আশা করি যে আপনাদের পার্সোনাল ফাইন্যান্স ম্যানেজমেন্ট আপনারা আপনাদের নিজেদের মতো করে করবেন এবং সেটা সুন্দর হবে। আপনার জীবনকে সামনে এগিয়ে নিতে সহায়তা করবে। তবে ঋণ করে সেই ঋণ কিভাবে ব্যবহার করবেন সেটা ভেবেচিন্তে করবেন। ভাল ঋণ ও মন্দ ঋণের বিষয়টা ভালভাবে বুঝলে আপনি নিজের জীবনে তার ভাল ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারবেন। ভাল থাকুন। মন্দ ঋণ এড়িয়ে চলুন, ভাল ঋণের সাথে থাকুন।
(লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক, ফাইন্যান্স ও বিজনেস স্ট্রাটেজিস্ট; ইউটিউবার ও সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশীপ ইন্টারন্যাশনাল।
ইমেইল: [email protected])
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফল। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।