উৎপাদন ঘাটতির শঙ্কায় বিশ্ববাজারে বাড়ছে চালের দাম, দেশে আপাতত স্বস্তি
আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম বাড়লেও দেশের বাজারে এর প্রভাব পড়েনি। বোরো মৌসুমে চালের ভালো উৎপাদন ও খাদ্যশস্যের মজুদ গড়ে উঠায় এই মুহূর্তে সরকারকে আমদানির চিন্তা করতে হচ্ছে না বলেই আন্তর্জাতিক বাজারে দামবৃদ্ধির আঁচ এখনো লাগেনি।
জানা যায়, ভারত সরকার কৃষকদের ন্যূনতম সহায়তার পরিমাণ ৭ শতাংশ বাড়িয়েছে। এর প্রভাবে দেশটিতে চালের রপ্তানিমূল্য বেড়েছে ৯ শতাংশ। দেশটিতে চালের দাম বৃদ্ধির খবরে থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামের চালের দামও বাড়তে শুরু করেছে।
টিসিবি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ঢাকার বাজারে খুচরায় চালের দাম স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক খবরে বলা হয়, এল নিনোর প্রভাবে বিভিন্ন দেশে চালের উৎপাদন কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে, কোথাও কোথাও পরিবেশের এই প্রভাবে উৎপাদন কমেও গেছে। উৎপাদন কমলে স্বাভাবিকভাবেই রপ্তানির পরিমাণও কমে আসবে। এই খবরগুলোই চালের আন্তর্জাতিক বাজারকে আরও বেশি উসকে দিচ্ছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ফুড প্ল্যানিং অ্যান্ড মনিটরিং ইউনিটের (এফপিএমইউ) দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতির প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গত মে মাসের শেষ সপ্তাহে ভারতে চালের (৫% ভাঙ্গা) রপ্তানি মূল্য ছিল টনপ্রতি ৩৭৫ ডলার এবং থাইল্যান্ডে এটা ছিল টনপ্রতি ৪৮৬ মার্কিন ডলার। জুলাইয়ের ১২ তারিখে এই দাম ঠেকে ভারতে ৪১৪ ডলার এবং থাইল্যান্ডে ৫৩৮ ডলার। একইভাবে বেড়েছে আতপ চালের দামও।
এফপিএমইউ-এর আন্তর্জাতিক বাজার বিশ্লেষণের তথ্য বলছে, মে মাসের শেষভাগে ভারত থেকে ১ কেজি সিদ্ধ চাল আমদানি করলে দেশের বাজারে সম্ভাব্য বিক্রয়মূল্য দাঁড়াতো ৪৭ টাকা, যেটা এখন দাঁড়াবে ৫২ টাকায়। একইভাবে থাইল্যান্ডের প্রতি কেজি চালের সম্ভাব্য খুচরা মূল্য ৬১ টাকা থেকে বেড়ে ৬৭ টাকায় পড়বে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, এই মুহূর্তে সরকারের চাল আমদানির কোন চিন্তা নেই। এই অর্থবছরে কখনো যদি প্রয়োজন পড়ে তখন যাতে দ্রুত চাল আমদানি করা যায় এ কারণে ৫ লাখ টনের অনুমতি নিয়ে রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে দ্রুত যাতে আমদানি করা যায় সেজন্যও এবার দরপত্র দাখিলের লক্ষ্যমাত্রা ৪২ দিনের পরিবর্তে ১৫ দিন করা হয়েছে। তবে প্রতি বছরের মত এবারও কিছু গম সরকার আমদানি করবে। বিশ্ববাজারে গমের দাম ধারাবাহিকভাবেই কমছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব (বৈদেশিক সংগ্রহ) মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, "দেশে চালের উৎপাদন এবং সরকারের মজুদ দুটোই ভালো অবস্থানে আছে। এখন আমাদের চাল আমদানির কোন চিন্তা নেই, তবে যে কোন মুহুর্তে জরুরী পরিস্থিতিতে দরকার পড়লে যাতে দ্রুত আমদানি করা যায় এটা তারই আগাম প্রস্তুতি। ফলে এখন আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম বাড়লেও সেটার সরাসরি কোন প্রভাব আমাদের উপর পড়বে না।"
এদিকে রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, আবহাওয়ার এল নিনো পরিস্থিতির কারণে এবারে চালের উৎপাদন কমে যেতে পারে। অন্যদিকে ভারতে চালের রপ্তানি মূল্য বৃদ্ধি। এ দুয়ে মিলে এখন চালের দাম বিশ্ববাজারে যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তা গত ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এল নিনোর প্রভাবে যদি উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমে যায় তাহলে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো চালের দাম আরও ৫ গুণ বৃদ্ধি পেতে পারে।
বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল মালিক সমিতির সহ-সভাপতি এবং চাল আমদানিকারক শহীদুর রহমান পাটোয়ারী টিবিএসকে বলেন, "প্রথমত আমাদের এখন আমদানি করতে হচ্ছে না বলে আন্তর্জাতিক বাজারের দাম বৃদ্ধির প্রভাবটা স্থানীয় বাজারে পড়ছে না।"
"অন্যদিকে সরকারের হাতে অনেকগুলো টুল আছে এখন।"
তিনি বলেন, "প্রতি মাসে সরকার ১ কোটি পরিবারকে ৫ কেজি করে চাল দিচ্ছে, সংক্ষিপ্ত আকারে হলেও ওএমএস চলছে। টিআর, কাবিখার মত কর্মসূচিগুলোতে সরকার এখন গমের বদলে চাল দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, এতে সরবরাহ বেশি থাকবে।"
বাংলাদেশে সামনে রয়েছে চাল উৎপাদনের দ্বিতীয় বৃহত্তম মৌসুম, যেখানে প্রায় দেড় কোটি টন চাল উৎপাদন হয়। এই মৌসুমের উৎপাদন নির্ভর করে বৃষ্টিপাতের উপর। গত কয়েক মাস বৃদ্ধিপাত অস্বাভাবিক কমে গেলেও বিগত প্রায় ২০ দিন সারাদেশে নিয়মিত বৃষ্টি হচ্ছে, যা আমনের উৎপাদনকে সহজ করবে বলে মনে করা হচ্ছে। গত বোরো মৌসুমে ২.১৫ কোটির বেশি চাল উৎপাদন হয়েছে বলে জানায় কৃষি মন্ত্রণালয়।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ, চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম এই মুহূর্তে চাল উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষে থাকা ৬টি দেশ। কিন্তু এল নিনো ধাঁচের আবহাওয়া, অনিয়মিত মৌসুমি বৃষ্টিপাত, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, খরাসহ বিভিন্ন কারণে গত বছর চালের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে আন্তর্জাতিক বাজারেও।
ইউএসডিএ'র পূর্বাভাস বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে বৈশ্বিক চাল মজুদের পরিমাণ ছয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসতে পারে, যা হতে পারে ১৭ কোটি ২০ লাখ টন।
উল্লেখ্য, বিশ্বের সাড়ে তিন কোটিরও বেশি মানুষের প্রধান খাবার ভাত। প্রতি বছর বিশ্বে যে পরিমাণ চালের উৎপাদন হয়, তার ৯০ ভাগই হয় এশিয়ার বৃষ্টিবহুল অঞ্চলগুলোতে।