২০২৩ অর্থবছরে রেকর্ড সংখ্যক জনশক্তি রপ্তানি সত্ত্বেও বাড়েনি রেমিট্যান্স
২০২২-২৩ অর্থবছরে রেকর্ড ১১.৩৭ লাখ কর্মী (জনশক্তি) বিদেশে রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ; দেশের ইতিহাসে এটি একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, এই সংখ্যা পূর্ব নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ৪০ শতাংশ বেশি এবং আগের বছরের তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি।
তবে জনশক্তি রপ্তানিতে এই মাইলফলক অর্জন সত্ত্বেও দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ এরসঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়েনি। এই সময়ে রেমিট্যান্সের পরিমাণ মাত্র ২.৭৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২১.৬১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। রেমিট্যান্সের ওপর সরকারের দেওয়া আড়াই শতাংশ প্রণোদনা সত্ত্বেও এই পরিমাণ গত দুই বছর আগে প্রাপ্ত রেমিট্যান্সের তুলনায় প্রায় ১৩ শতাংশ কম।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ এবং ব্যাংকাররা এই অসঙ্গতির দুটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। প্রথমত, অনানুষ্ঠানিক হুন্ডি অপারেটর; তারা আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের বিপরীতে উচ্চ বিনিময় হার প্রদান করে প্রবাসীদের আকৃষ্ট করছেন। দ্বিতীয়ত, বিপুল সংখ্যক অদক্ষ কর্মী বিদেশে পাঠানোর ফলে সামগ্রিক রেমিট্যান্সের পরিমাণে প্রভাব পড়ে থাকতে পারে বলেও ধারণা করছেন তারা।
তবে কারণ যেটিই হোক, পরিস্থিতি এখন উদ্বেগজনক; কারণ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি গত ১৬ মাস ধরে টাকার মানও কমছে।
এই সমস্যা সমাধানে ব্যাংকারদের পরামর্শ হলো, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে বর্তমান নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি হারে ডলার কেনার অনুমতি দেওয়া।
একটি বিশিষ্ট বেসরকাররি বাণিজ্যিক ব্যাংকের সিইও জানান, বর্তমানে প্রতি ডলারের জন্য ১০৯ টাকা পর্যন্ত দেওয়ার অনুমতি রয়েছে ব্যাংকগুলোর, যেখানে হুন্ডি অপারেটররা ডলারপ্রতি ১১৫ টাকা করে প্রদান করছেন। এরফলে অনানুষ্ঠানিক হুন্ডির মাধ্যমেই টাকা পাঠানোর দিকে বেশি ঝুঁকছেন প্রবাসীরা।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির সাবেক মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান টিবিএসকে বলেন, "আমরা ১০ লাখেরও বেশি কর্মী বিদেশে পাঠাতে পেরেছি, এটি নিঃসন্দেহে ভালো খবর। তবে আমরা এতে সন্তুষ্ট নই। আমরা যদি প্রতি বছর কমপক্ষে ১৫ লাখ লোক পাঠাতে পারি, তবে এটি বেকারত্ব দূর করতে এবং রেমিট্যান্স বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখবে।"
আরও দক্ষ কর্মী গড়ে তুলতে শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, "আমরা যদি অভিবাসন প্রত্যাশীদের কারিগরি দক্ষতার পাশাপাশি ইংরেজি ও আরবি শেখাতে পারি, তাহলে আমরা ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দক্ষ শ্রমবাজারটা আরও ভালোভাবে ধরতে পারবো।"
বাড়ছে শ্রম অভিবাসন
২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারি শুরু হলে লকডাউন ও বিধিনিষেধের কারণে অভিবাসন থমকে গিয়েছিল একেবারেই। এরপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে থাকলে ২০২১ সালের আগস্ট থেকে আবারও ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে শ্রম অভিবাসন। এরপর থেকে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে কর্মী পাঠানোর প্রবণতা ঊর্ধ্বমুখী অবস্থায় রয়েছে।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো অনুসারে, কোভিড বিধিনিষেধ কার্যকর হওয়ার সাথে সাথে, বৈদেশিক কর্মসংস্থান ২০২১ অর্থবছরে ২.৮০ লাখে নেমে আসে।
এরপর মহামারিজনিত লকডাউনের ধাক্কা কাটিয়ে ২০২২ সালে বাংলাদেশ থেকে ৯.৮৮ লাখ কর্মী বিদেশে যায়।
নিয়োগকারীরা বলছেন, মূলত মহামারির কারণে দুই বছর যাবত যেসব অভিবাসন প্রত্যাশীর বিদেশে যাওয়া আটকে ছিল, তারা ২০২২ ও ২০২৩ অর্থবছরে মধ্যপ্রাচ্যে পুনরায় ব্যবসা-বাণিজ্য চালু হওয়ার সাথে সাথে সেখানে যাওয়ার সুযোগটিকে কাজে লাগিয়েছেন।
দীর্ঘ তিন বছর পর বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য তাদের শ্রমবাজার খুলে দেওয়ার পর গত বছরের আগস্ট থেকে প্রায় ২.২৮ লাখ শ্রমিক মালয়েশিয়ায় গিয়েছেন।
উৎপাদন, নির্মাণ, পরিষেবা, কৃষি, খনি এবং গৃহস্থালীর কাজসহ প্রায় সমস্ত সেক্টরেই বিদেশি কর্মীদের নিয়োগ দেয় মালয়েশিয়া।
নিয়োগকারীদের মতে, তেলসমৃদ্ধ উপসাগরীয় দেশগুলোর তুলনায় ভালো বেতন কাঠামো রয়েছে মালয়েশিয়ায়। ফলে এই দেশে যেতে কর্মীদের আগ্রহ বেশি।
এছাড়া, মালয়েশিয়ার আবহাওয়া প্রায় বাংলাদেশের মতো হওয়ায় সেখানে গিয়ে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন কর্মীরা। এই কারণেও অনেক বাংলাদেশি কর্মী মালয়েশিয়ায় যেতে অগ্রহী হয়ে উঠছেন।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির যুগ্ম সম্পাদক মো. টিপু সুলতান টিবিএসকে বলেন, "সৌদি আরবে একজন বাংলাদেশি শ্রমিক বেতন পান ৮০০-১,০০০ সৌদি রিয়াল (প্রায় ২৩,০০০-২৮,০০০ টাকা), যেখানে মালয়েশিয়ায় সর্বনিম্ন বেতন ১,৫০০ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩৫,০০০ টাকা।"
যদিও মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরবই বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মীদের জন্য সবচেয়ে বড় গন্তব্য দেশ হিসেবে পরিচিত; গত অর্থবছরে ৪.৫২ লাখ বাংলাদেশি কর্মী সৌদি আরব গিয়েছেন। আর এরপরেই রয়েছে মালয়েশিয়া, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর এবং কুয়েতের অবস্থান।
সৌদি আরবের সকল ফার্মে বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য কোটা ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪০ শতাংশ করায় জনশক্তি রপ্তানির প্রবৃদ্ধিতে এই দেশের সামগ্রিক অবদান বেশি। সূত্র জানায়, গত অর্থবছরে মোট বাংলাদেশি শ্রম অভিবাসনের ৪০ শতাংশই হয়েছে সৌদিতে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বেশিরভাগ অভিবাসী কর্মী পরিচ্ছন্নতা ও গৃহপরিচারিকার কাজ করে থাকেন। এছাড়া ড্রাইভার, ইলেকট্রিশিয়ান ও প্লাম্বারের মতো কিছু স্বল্পদক্ষ কর্মীও নিয়োগ দেয় দেশগুলো।
জুনের শেষ সপ্তাহে সংসদে প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেছিলেন, জনশক্তি রপ্তানির জন্য নতুন দেশের সঙ্গে চুক্তির পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
এ বিষয়ে লিবিয়া, মাল্টা, আলবেনিয়া, রোমানিয়া ও সার্বিয়ার সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের প্রক্রিয়া চলছে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি।
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আগের বছরের তুলনায় ২০২২ সালে অন্যান্য দেশে ভ্রমণকারী দক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা কমেছে।
২০২১ সালে দক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা ছিল দেশের মোট শ্রম অভিবাসনের ২১.৩৩ শতাংশ, যা ২০২২ সালে ১৭.৭৬ শতাংশে নেমে আসে।
যদিও স্বল্পদক্ষ কর্মীদের সংখ্যায় তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন হয়নি। ২০২২ সালে দেশের মোট শ্রম অভিবাসনে স্বল্পদক্ষ কর্মী ছিল ৩.২৬ শতাংশ এবং ২০২১ সালে ছিল ৩.২৮ শতাংশ।