স্বল্প ব্যবহৃত টুইটার এখন বাংলাদেশের রাজনীতির ভার্চুয়াল লড়াইয়ের নতুন মঞ্চ
জুনের প্রথম সপ্তাহে দেশে যখন জোরেশোরে লোডশেডিং চলছিল, তখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রধান বিরোধী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর মধ্যে ভার্চুয়াল দুনিয়ায় এক তুমুল হাস্যরসাত্মক লড়াই দেখেছিলেন নেটিজেনেরা।
ফেসবুকে মিম ও পালটা মিমের মাধ্যমে বিদ্যুতায়ন ও লোডশেডিং নিয়ে একে অপরের ওপর ভার্চুয়াল আক্রমণ চালিয়েছিল দলদুটি।
গত ৫ জুন বিএনপি এর ফেসবুক পেজে 'হাসিনা সরকারের উন্নতি সন্ধ্যার পর মোমবাতি…' ক্যাপশন দিয়ে একটি মিম পোস্ট করে। একই দিন আওয়ামী লীগ 'খাম্বাযুগের মোমবাতির স্মৃতিতে কাতর বিএনপি!' ক্যাপশন লিখে একটি মিম প্রকাশ করে তাদের দাপ্তরিক ফেসবুক পাতায়।
ওই সপ্তাহে এ দুটিসহ একই ধরনের আরও বেশ কয়েকটি মিম ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মনোযোগ দারুণভাবে আকর্ষণ করেছিল। দুই দলের মিমযুদ্ধে আনন্দ পেয়েছিলেন মানুষজন।
এরপর বিএনপি ঢাকা ও দেশের অন্যান্য স্থানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে একের পর এক সমাবেশ করতে শুরু করে। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীরর সমর্থনে পালটা সমাবেশ করে আওয়ামী লীগও।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারে বাংলাদেশিদের তেমন বিচরণ নেই। তবে এ মুহূর্তে হঠাৎ করে টুইটারে বাংলাদেশি ব্যবহারকারীদের অংশগ্রহণ হু-হু করে বেড়ে গিয়েছে। এদের কেউ বিরোধীদলের দাবির প্রতি সমর্থন জানাচ্ছেন, অন্যদিকে অনেকে সরকারের ভাষ্যকে প্রচার করছেন।
বাংলাদেশে ইন্টারনেটের মোট সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছয় কোটি ৬৯ লাখ ৪০ হাজার। এর মধ্যে ফেসবুক ব্যবহার করেন পাঁচ কোটি ৯২ লাখ, ইনস্টাগ্রাম ৬৫ লাখ, এবং লিংকডইন ৭০ লাখ। আর ২০২৩ সালের শুরুর দিকের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে টুইটার ব্যবহারকারীর সংখ্যা কেবল ১০ লাখ ৫০ হাজার জন।
তবে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে — বিশেষ করে যখন থেকে বিএনপি প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ এবং নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দাবি ঘোষণা করেছে — তখন থেকেই টুইটারে বিরোধীদলের সমর্থকদের সংখ্যা ব্যাপক বেড়ে গিয়েছে।
ক্ষমতাসীন দলও এর সমর্থকদের টুইটারে সক্রিয় হতে উৎসাহিত করার চেষ্টা করছে।
রাজনৈতিক অঙ্গনে সাম্প্রতিক অস্থিরতা শুরু হওয়ার পর থেকে ঠিক কতজন প্ল্যাটফর্মটিতে যোগ দিয়েছেন বা কতগুলো নিষ্ক্রিয় অ্যাকাউন্টকে সক্রিয় করা হয়েছে, তা বলা কঠিন। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সক্রিয় ব্যক্তিরা বাংলাদেশি টুইটার ব্যবহারকারীর সংখ্যায় একটি উল্লেখযোগ্য উল্লম্ফন দেখতে পেয়েছেন।
আর টুইটারে নতুন করে সক্রিয় হওয়া এ বাংলাদেশি ব্যবহারকারীদের বেশিরভাগই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে হয়। ফলে শেষ পর্যন্ত এদের কতজন প্ল্যাটফর্মটি নিয়মিতভাবে ব্যবহার করবেন, তাও বলা মুশকিল।
তো, বাংলাদেশের রাজনীতি সচেতনদের মধ্যে হঠাৎ করে টুইটারের এত আবেদন বেড়েছে কেন?
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের সঙ্গে কথা বলে টুইটারে সমর্থন বাড়ানোর পেছনে তাদের মনোভাব জানতে চেয়েছে।
দুই পক্ষই মনে করে, নীতিনির্ধারক, থিংক ট্যাংক, বিশেষজ্ঞ, কূটনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ এবং সারাবিশ্বের গণমাধ্যম — সবারই উপস্থিতি টুইটারে বেশি।
ফেসবুকে রাজনৈতিক পোস্টগুলো দেশের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের জন্যই দেওয়া হয়। কিন্তু টুইটার ক্রমশ বিদেশি সমর্থকগোষ্ঠীকে আকৃষ্ট করার কৌশলগত প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠছে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য। এসব বিদেশি সমর্থকদের মধ্যে রয়েছে মানবাধিকারকর্মী, বিদেশি গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, কূটনীতিবিদসহ আরও অনেকেই।
বিএনপি'র মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন স্বপন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'যেহেতু বড় মাপের নীতিনির্ধারকদের জন্য টুইটার একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, তাই আমরা টুইটারে আমাদের কার্যক্রম প্রসারের চেষ্টা করেছি।'
তিনি স্বীকার করেন, সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের বিবেচনায় বাংলাদেশে টুইটার খুব একটা জনপ্রিয় নয়। কিন্তু 'এলেমওয়ালা মানুষেরা' টুইটার ব্যবহার করেন বলে ব্যাখ্যা করেন স্বপন। এ কারণেই তারা এই 'প্রভাবশালী মানুষদের' চিন্তনকে আকর্ষণ করার জন্য 'টুইটারকে বেছে নিয়েছেন' বলে জানান তিনি।
সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই)-এর সিনিয়র অ্যাসোসিয়েট এবং আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য শাহ আলী ফরহাদ বলেন, বিএনপি এ মুহূর্তে টুইটারে বেশি সক্রিয় কারণ তারা 'বিদেশিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়'।
'আমি মনে করি, রাজনৈতিক প্রচারণা চালানোর জন্য টুইটার ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিএনপি আওয়ামী লীগের চেয়ে এগিয়ে আছে। আওয়ামী লীগের চেয়ে টুইটারে বিএনপির পোস্ট (টুইট) ও পোস্টদাতা; উভয়ের সংখ্যাই বেশি,' ফরহাদ বলেন। 'তারা সবসময় টুইটারে পোস্ট করতে থাকে।'
আওয়ামী লীগের দাপ্তরিক টুইটার প্রোফাইলটি অবশ্য ভালোই সক্রিয়। এটি থেকে নিয়মিত টুইট করা হয় (এসব টুইটে বিভিন্ন গুজবের জবাব দেওয়া এবং আওয়ামী লীগের উন্নয়ন কাজগুলো তুলে ধরা হয়)। 'তবে আওয়ামী লীগ ফেসবুক ও ইউটিউবে বেশি প্রচারণা চালায়,' বলেন ফরহাদ।
টুইটারে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সোশ্যাল মিডিয়া যুদ্ধ কীভাবে চলছে তার একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। গত কয়েকদিন আগে ১৫ হাজার টুইটের বরাতে #StepDownHasina হ্যাশট্যাগটি টুইটারে ট্রেন্ডিং দেখাচ্ছিল। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের পালটা প্রচেষ্টা #OnceAgainHasina হ্যাশট্যাগ প্ল্যাটফর্মটিতে ট্রেন্ড করতে পারেনি। অবশ্য এটি ফেসবুকে বেশ ছড়িয়েছিল।
স্বপন বলেন, ঢাকায় গত কয়েকটি সমাবেশে বিএনপি ও এর মিত্র দলগুলো তাদের 'বিশাল সমর্থকগোষ্ঠীর' যে আড়ম্বর দেখিয়েছে, তা প্রচারের জন্য প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহার করছে তারা। এছাড়া তারা দেশের ভেতরে ব্যাপকহারে 'মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে প্রচারণা' চালায়।
'প্রশাসনকে পক্ষপাতমূলকভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে সরকারের ব্যাহত করা ভোটাধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য মানুষ কীভাবে একটি সাধারণ আন্দোলনে অংশ নিচ্ছে, তা আমরা টুইটারে প্রচার করি। আমরা প্রমাণসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো উত্থাপন করি যাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলো সরকারের প্রচারে বিভ্রান্ত না হয়,' স্বপন আরও বলেন।
আওয়ামী লীগের ফরহাদ বলেন, তার দল দেশের জনগণের দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে যেখানে বিএনপির নেতারা 'কূটনৈতিক পরিমণ্ডলের দিকে ছুটছেন'।
টুইটারে সক্রিয়তা কীভাবে দলের রাজনৈতিক লক্ষ্যকে উপকৃত করছে জানতে চাইলে বিএনপি'র স্বপন বলেন, তারা ইতোমধ্যেই এর প্রভাব দেখতে পেয়েছেন।
'আমরা ইতোমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ, নিষেধাজ্ঞা, কংগ্রেসম্যানদের উদ্বেগ, এইচআরডব্লিউ ও অ্যামনেস্টি-এর বিবৃতি, ইউরোপীয় কমিশনের সদস্যদের প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি দেখেছি,' বলেন তিনি।
ফরহাদ জানান, বিদেশিরা টুইটার থেকে তথ্য নিচ্ছেন।
'টুইটারে বিএনপির উপস্থিতি বেশি হওয়ায় বিদেশিরা সেসব মতামত নিচ্ছেন। যেমন, গত কয়েকদিনে বিএনপির কর্মসূচিতে পুলিশের কর্মকাণ্ড নিয়ে টুইটারে অনেক আলোচনা হয়েছে,' বলেন ফরহাদ। 'বিএনপির পক্ষ থেকে কর্মসূচির নামে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটলেও টুইটারের আলোচনায় তা উঠে আসেনি,' তিনি যোগ করেন।
ফরহাদ বলেন, যদিও তার দলের লোকজন এ মুহূর্তে টুইটার ব্যবহারে পিছিয়ে আছেন, তবে তিনি লক্ষ্য করেছেন, ছাত্রলীগের অনেক সদস্য টুইটারে অ্যাকাউন্ট খুলছেন।
'আমি মনে করি আওয়ামী লীগ টুইটারে উপস্থিতির দিক থেকে পিছিয়ে রয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক কার্যকলাপ টুইটারে সক্রিয় থাকার গুরুত্ব বুঝতে আমাদেরকে সাহায্য করেছে। আমার বিশ্বাস, আমরা এক বা দুই মাসের মধ্যে এটি কাটিয়ে উঠব,' তিনি আরও বলেন।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতারা সকল কর্মীকে অনলাইন কার্যক্রম বাড়াতে নির্দেশনা দিয়েছে এবং প্রতিটি ইউনিটের নিজস্ব ফেসবুক পেজ, টুইটার অ্যাকাউন্ট এবং ইউটিউব চ্যানেল থাকা বাধ্যতামূলক করেছে বলে জানা গেছে।