বোয়ালখালীতে জন্ম নেওয়াটাই যেন পাপ: কালুরঘাটে ভোগান্তির শিকার যাত্রীর আক্ষেপ
ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা হাসিনা বেগম। ছেলের বউকে নিয়ে চট্টগ্রাম শহরে এসেছিলেন ডাক্তার দেখাতে। ডায়বেটিস ও উচ্চরক্তচাপে ভোগা এই নারী দীর্ঘ প্রায় চার ঘন্টা অপেক্ষা করেও কালুরঘাটে নতুন চালু করা ফেরিঘাট পার হতে পারেননি।
তিনি টিবিএসকে বলেন, 'অসুস্থ শরীর নিয়ে এতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করা খুব কষ্টের। মুমূর্ষু কোনো রোগী হলে তো ঘাটেই মারা যাবে। কালুরঘাটে নদী পারাপারের এই ভোগান্তি ছোটকাল থেকেই দেখে আসছি। সরকার এসেছে, গেছে। আমাদের ভাগ্যের বদল হয়নি। বোয়ালখালীতে জন্ম নেওয়াটাই যেন আমাদের পাপ।'
বুধবার (২ আগস্ট) দুপুর দেড়টার দিকে শত বছরের পুরোনো কালুরঘাট সেতু সংলগ্ন ফেরি ঘাট এলাকায় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে তার কথা হয়। এদিন অনেক যাত্রী নিজেদের ভেগান্তির কথা প্রতিবেদককে জানান।
চট্টগ্রাম নগরীর সঙ্গে বোয়ালখালী ও পটিয়া উপজেলার একাংশের যোগাযোগের মাধ্যম এই কালুরঘাট সেতু। সড়ক পথের সব ধরনের যানবাহনের পাশাপাশি এই সেতু দিয়ে ট্রেনও চলত এতদিন। সেতুর সংস্কারকাজের জন্য মঙ্গলবার (১ আগস্ট) বেলা ১১টায় সেতুতে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিকল্প হিসেবে কর্ণফুলী নদীতে চালু করা হয়েছে ফেরি। তবে ফেরি সল্পতা ও জোয়ারে সংযোগ সড়ক-পল্টুন ডুবে যাওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েছেন হাজারো মানুষ।
বুধবার (২ আগস্ট) বেলা একটার দিকে সরেজমিনে দেখা যায়, ফেরিঘাট থেকে আরাকান সড়ক পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার গাড়ির লম্বা সারি। এর মধ্যে ছিল মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, পিকআপ, পণ্যবাহী ট্রাক, টেম্পো, মাইক্রোবাস ইত্যাদি। ফেরিঘাট থেকে মূল সড়ক (আরাকান সড়ক) পর্যন্ত গাড়ির লম্বা সারি। এর মধ্যে অনেক গাড়ি সকাল ৮ টা থেকে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। অটোরিকশা, টেম্পো ও মাইক্রোবাসগুলোতেও ছিল যাত্রী। জোয়ারের পানিতে ফেরিতে পৌছানোর পাটাতন কোমর পানিতে ডুবে গেছে। আটকা পড়েন চাকরীজীবি ও শিক্ষার্থীরাও।
বেলা ১২ টা দিকে কয়েকটি যানবাহন ও যাত্রী নিয়ে কর্ণফূলীর শহরমুখী প্রান্ত থেকে একটি ফেরি ছেড়ে যায়। কিন্তু জোয়ারে বোয়ালখালী প্রান্তের পাটাতন ও সংযোগ সড়ক ডুবে যাওয়ায় ফেরি তীরে ভিড়তে ব্যর্থ হয়। পরে ফেরিটি আবারও শহর প্রান্তে ফিরে আসে। এসময় মালবোঝাই কাভার্ডভ্যান, টেম্পু ও মোটরসাইকেল চালকরা বাধ্য হয়ে কোমর পানিতে গাড়ি চালিয়ে তীরে ফেরার চেষ্টা করেন। এসময় বেশ কয়েকটি গাড়ির ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে যায়।
তেমন একটি টেম্পুর চালক জাহাঙ্গির বলেন, সারাদিনে আট-নয়শ টাকা আয় হতো। আজ পুরো দিনটা শেষ। উল্টো ইঞ্জিন মেরামতে দেড়-দুই হাজার টাকা লাগবে।
কনফিডেন্স সিমেন্টের চালান নিয়ে মিরসরাই থেকে পটিয়া যাচ্ছিলেন ট্রাক চালক জসিম। তিনি জানান, সকাল ৯ টায় ফেরিঘাটে আসলেও মাত্র একটি ফেরি চালু থাকায় তিনি সিরিয়াল পাননি। পরে জোয়ারের কারণে ঘাটই বন্ধ হয়ে গেছে।
সওজ কর্মকর্তারা জানান, গতকাল রাতে মোটরসাইকেলের টোল নিয়ে দ্বন্দের জেরে আজ সকাল আটটা পর্যন্ত ফেরি চলাচল বন্ধ ছিলো। এরপর বৈরি আবহাওয়ার কারণে একটি ফেরি চালু করা হয়। কিন্তু ১১ টার দিকে জোয়ারের পানিতে ফেরিতে ওঠার পাটাতন ডুবে যাওয়ায় আবারও ফেরি চলাচল বন্ধ করে দিতে হয়।
তবে যাত্রীদের অভিযোগ, সকালে যখন ভাটা ছিলো তখন দুটি ফেরি চালু করা হলে এই ভোগান্তি এড়ানো যেত। এছাড়া সংযোগ সড়কটি প্রয়োজন অনুসারে উঁচু না করায় অল্প জোয়ারেই পাটাতন ও সংযোগ সড়ক ডুবে যাচ্ছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সড়ক ও জনপথ বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. নিজাম উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'যাত্রীরা ভোগান্তি পোহাচ্ছেন এটা সত্য, তবে সংযোগ সড়ক ও পাটাতনের উচ্চতা নির্দিষ্ট নিয়ম মেনেই করতে হয়। এছাড়া অতিরিক্ত জোয়ারের কারনে সমস্যা হচ্ছে। আশা করছি জোয়ার কেটে গেলে এ সমস্যা থাকবে না।'
৩৩ বছর ধরে একই দুর্ভোগ, একই প্রতিশ্রুতি :
১৯৩০ সালে ব্রুনিক অ্যান্ড কোম্পানি ব্রিজ বিল্ডার্স নামে একটি সেতু নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান কালুরঘাট সেতুটি নির্মাণ করে। ১৯৫৮ সালে সব রকম যানবাহন চলাচলের যোগ্য করে সেতুটির বর্তমান রূপ দেওয়া হয়।
একমুখী সেতুটিতে ট্রেনের পাশাপাশি সাধারণ যানবাহনও চলে। সেতুর একপাশে গাড়ি উঠলে আরেকপাশ বন্ধ থাকে। ফলে দীর্ঘ যানজটের ভোগান্তি চলছে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে।
কালুরঘাট সেতুর বিষয়টি নির্বাচনের সময় দল নির্বিশেষে প্রার্থীদের প্রচারণা ও প্রতিশ্রুতিতে গুরুত্ব পেয়ে আসছে। কিন্তু গত ৩৩ বছরেও এ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হয়নি।
২০১০ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম বর্ষপূতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া বক্তব্যে কর্ণফুলী নদীর উপর আরেকটি সেতু নির্মাণের আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু নতুন রেল ও সড়ক সেতুর জন্য একাধিক সম্ভাব্যতা যাচাই এবং সেতুটির নকশা তৈরি ও বদল করতে করতে কেটে গেছে ১৩ বছর।
বোয়ালখালী-কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়ন পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক মুস্তফা নঈম বলেন, 'আমরা চাই না, সেতুটা কোনো রাজনৈতিক বা নির্বাচনী কথার মারপ্যাঁচে পড়ুক। এটা দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষের প্রধান দাবিতে পরিণত হয়েছে।'