চমৎকার এক কাপ কফি বানাতে শিখুন এবং বিদেশে চাকরি নিন
সিডনির ইউনিভার্সিটি অভ টেকনোলজিস থেকে ফুড ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে স্নাতকোত্তর করতে স্টুডেন্ট ভিসায় গত জুলাইতে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমান তৌহিদুন নাহার। তার আগে দেশে কফি তৈরির একটি বিশেষ কোর্স সম্পন্ন করে নেন তিনি। তৌহিদুন নাহার এখন একজন সনদপ্রাপ্ত বারিস্তা (কফি প্রস্তুত ও পরিবেশনকারী)।
তৌহিদুন এখন এস্প্রেসোর সঠিক মিশ্রন সম্পর্কে জানেন। তিনি জানেন এক কাপ ক্যাপাচিনো এবং লাতে-তে ফ্রোথেড মিল্কের (দুধকে ফেনিয়ে কফির উপরে যে লেয়ার দেওয়া হয়) মিশ্রন হবে কতটুকু। কফির ওপরে দুধ দিয়ে সাদা হার্ট আকৃতি আঁকার বিখ্যাত কৌশলও শিখে নিয়েছেন তিনি।
তিনি বলেন, সিডনিতে বারিস্তার চাহিদা বেশি। তাই সেখানে যাওয়ার আগে আমি কফি তৈরির ওপর সাতদিনের একটি পেশাদার কোর্স করেছি। যাতে সেখানে খণ্ডকালীন চাকরি পাওয়া সহজ হয়। আমি পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি কিছু উপার্জনও করতে চাই।
তৌহিদা খণ্ডকালীন চাকরির জন্য শিখলেও অনেকে বিদেশে পূর্ণকালীন চাকরির জন্যও কফি তৈরি করা শেখেন। কুমিল্লায় উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে চাকরির জন্য বিদেশে যেতে চেয়েছিলেন শাকিল। সৌদি আরবে যাওয়ার আগে তিনিও শিখে নিয়েছিলেন নানা রকম কফি তৈরির কলাকৌশল।
শাকিল বলেন, 'বাংলাদেশে কফি তৈরির বিষয়ে আমার খুব কম জ্ঞান ছিল, কিন্তু সৌদি আরবে কফি শপে পাঁচ বছর কাজ করার পর আমি একজন পেশাদার বারিস্তা হয়েছি। তবে, আমি এখনো লাতে তৈরির শিল্প রপ্ত করছি।' সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার ভিডিওগুলোতে শাকিলকে প্রায়শই বাদামী কফির ওপর সাদা ফ্রোথেড দুধ দিয়ে রাজহাঁস আঁকতে দেখা যায়।
তৌহিদা ও শাকিলের মতো এখন অনেক বাংলাদেশি তরুণ-তরুণী পূর্ণ বা খণ্ডকালীন চাকরির জন্য পেশাদার বারিস্তা হওয়ার প্রশিক্ষণ নিচ্ছে।
কফি ট্রেইনিং সলিউশন, নর্থ এন্ড, বিন্স অ্যান্ড ব্যারিসের মতো প্রতিষ্ঠান বারিস্তা হওয়ার কোর্স চালু করেছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে মাসে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ জনকে কফি প্রস্তুত করার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
ক্যাফে এবং হোটেলগুলোতে তাদের কর্মীদের প্রশিক্ষণের জন্য নিজস্ব কোর্স আছে। সেগুলো বাইরের কারো জন্য উন্মুক্ত নয়।
শিক্ষার্থী এবং বিদেশ গমনে ইচ্ছুকরাই প্রধান প্রশিক্ষণার্থী
কফি ট্রেনিং সলিউশন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা মোঃ ফারুক হোসেন ফারহান গত ১০ বছর ধরে কফি তৈরির ব্যবসা করছেন। তিনি বলেন, আমি ২০১১ সালে নর্থ এন্ডে যোগ দেই। সেখানে আমাদের বারিস্তা হওয়ার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। ২০২০ সালে আমি চাকরি ছেড়ে নিজের কফি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র শুরু করি।
গত দুই বছরে কফি ট্রেনিং সলিউশন দুই শতাধিক ব্যক্তিকে বারিস্তা প্রশিক্ষণ দিয়েছে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই তরুণ ছাত্রছাত্রী যারা পড়াশোনার জন্য বিদেশে যাচ্ছে এবং বাকিরা অভিবাসী শ্রমিক। প্রতি মাসে গড়ে ২২-৪৪ জন শিক্ষার্থী বারিস্তা প্রশিক্ষণের জন্য তার কেন্দ্রে যান।
ফারহান জানান, তাদের প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে ৬০ শতাংশেই বিদেশ গমনে ইচ্ছুক। নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানই তাদেরকে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠায়। আর ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী। যারা বিদেশে পড়ালেখার পাশাপাশি খণ্ডকালীন চাকরির জন্য বারিস্তা প্রশিক্ষণ নেয়। আর বাকি ১০ শতাংশ আসে শখে বা কফির প্রতি ভালোবাসা থেকে।
কোথায় আপনি বারিস্তা প্রশিক্ষণ পাবেন?
ঢাকায় বারিস্তা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তিন ক্যাটাগরিতে। মৌলিক, মধ্যবর্তী এবং পেশাদার। কফি ট্রেনিং সলিউশনে, একটি দিনব্যাপী (ছয় ঘণ্টার) বেসিক বারিস্তা কোর্সে কফি বিনের মৌলিক বিষয়গুলি শেখানো হয়। কীভাবে সেগুলিকে রোস্ট করা হয়, সেরা কফির জন্য কী ধরনের কফি বিন ব্যবহার করা হয়, একটি কফি মেশিন কীভাবে পরিচালনা করতে হয় এবং কফি কীভাবে পরিমাপ করতে হয় তা শেখানো হয়।
ফারহান বলেন, বাংলাদেশে আমরা মিষ্টতার জন্য আরাবিকা কফি বিন ব্যবহার করি। তেতো হওয়ায় রোবাস্তা বিনের স্বাদ বাংলাদেশিরা পছন্দ করেন না। একটি এসপ্রেসো, আমেরিকানো বা ম্যাকিয়াটোতে ৭-৯ গ্রাম গ্রাউন্ড কফি থাকা উচিত। এছাড়াও, ডিজিটাল এবং ম্যানুয়াল কফি মেশিন রয়েছে – এগুলি সবই প্রাথমিক কোর্সে শেখানো হয়।
প্রাথমিক বিষয়গুলোর পরে, ছাত্রদের দুধের ফ্রোথিং (লাতে, মোকা, ক্যাপাচিনো ইত্যাদির জন্য), এবং বিভিন্ন স্বাদের সিরাপ (ভ্যানিলা, হ্যাজেলনাট, ক্যারামেল, চকলেট ইত্যাদি) দিয়ে কফি তৈরি করার কৌশল শেখানো হয়। ফারহান জানান, এসব সিরাপ বেশির ভাগই আমদানি করা হয় অস্ট্রেলিয়া ও মালয়েশিয়া থেকে।
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, লাতে, মোকা, ক্যাপাচিনোর জন্য কফির আদর্শ পরিমাণ হল ৩০ মিলি। সেই ৩০ মিলি এসপ্রেসো (কেবলই কফি) দিয়ে পানীয়র আকারের ওপর নির্ভর করে দুধের ফ্রোথিং যোগ করি। উদাহরণস্বরূপ, একটি ১৮০ মিলি লাতের মধ্যে ৩০ মিলি এসপ্রেসো এবং ১৫০ মিলি দুধের ফ্রোথিং থাকবে। এর সাথে সিরাপ যোগ করে কফিকে আরো উন্নত করা হবে।
ফারহান বলেন, তারপর সেই বেসিক লাতের পরে আপনি হ্যাজেলনাট লাতে, চকোলেট লাতে, ক্যারামেল লাতে বা এমনকি ভ্যানিলা লাতে তৈরি করতে পারবেন৷ যখন আমরা একটি কফি মেন্যু প্রস্তুত করি, তখন আমরা ১৫টি ভিন্ন ধরণের হট কফি যোগ করতে পারি এবং তারপরে বরফ যোগ করলে কোল্প কফি বানিয়ে আমরা আরও ১৫টি আইটেম পাই৷ সুতরাং, আমাদের কাছে মেন্যুতে ৩০টি কফি থাকে।
কফি ট্রেনিং সলিউশনে, একদিনের বেসিক কফি প্রশিক্ষণের খরচ ৩,৫০০ টাকা। চার দিনের এডভান্স কোর্সের খরচ ১০,০০০ হাজার টাকা। সাত দিনের স্টুডেন্ট বারিস্তা কোর্সের খরচ ১৬,৫০০ টাকা এবং ১০ দিনের পেশাদার বারিস্তা কোর্সের খরচ ১৮,০০০ টাকা।
নর্থ এন্ডও প্রতি মাসে বারিস্তা বেসিক ট্রেনিং সেশনের আয়োজন করে, যার খরচ ৫,০০০ টাকা। বিকাশে ফি পাঠিয়ে আপনাকে প্রশিক্ষণের জন্য একটি আসন বুক করতে হবে। প্রগতি স্মরণিতে তাদের প্রশিক্ষণ ল্যাবে সেশনের আয়োজন করা হয়। তারা প্রতি মাসে ২০ জনেরও বেশি শিক্ষার্থী পায়।
প্রতিষ্ঠান মুখপাত্র রুমা জানান, এই দিনব্যাপী (ছয় ঘন্টা) বেসিক কোর্সে কফি বিন, কফি মেশিনের গ্রাইন্ডিং সেটিংস এবং কীভাবে বিভিন্ন ধরণের কফি তৈরি করা যায় সে সম্পর্কে আলোচনা করা হয়।
নর্থ এন্ডে ইন্টারমিডিয়েট কফি লার্নিং, লাতে আর্ট এবং কাস্টমাইজড সার্ভিসসহ অন্যান্য কোর্সও বিদ্যমান। কিন্তু বেসিক বারিস্তা কোর্সের মতো সেগুলো প্রতি মাসে আয়োজন করা হয় না। একটা সেশন আয়োজনের জন্য অন্তত পাঁচজন অংশগ্রহণকারী প্রয়োজন। চার ঘণ্টার ইন্টারমিডিয়েট কোর্সের জন্য ৫,০০০ টাকা। তিন ঘণ্টার লাতে আর্ট কোর্সের জন্য ২,০০০ টাকা ফি নির্ধারিত।
এই দুই প্রতিষ্ঠান কেবল বিভিন্ন ধরনের কফি নিয়ে কাজ করলেও বিন্স অ্যান্ড ব্যারিস হট এবং কোল্ড উভয় পানীয় মিলিয়ে বারিস্তা কোর্স তৈরি করেছে। প্রশিক্ষণার্থীদের কফি, আইসড টি, স্মুদি এবং ভার্জিন মোহিতো ও লেমোনেড ইত্যাদির মতো মকটেল তৈরি করতে শেখানো হয়। এছাড়াও তাদের মকটেল গার্নিশিং, কীভাবে বারিস্তা সরঞ্জাম এবং যন্ত্রপাতির ব্যবহার ও সুরক্ষা করতে হয় সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।