ভাগনার প্রধান প্রিগোজিনের মৃত্যুকে সঙ্গী করে বেঁচে থাকা
ক্রেমলিনের ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে মাস দুয়েক আগে বিদ্রোহ করে ব্যর্থ হওয়ার পর থেকেই মৃত্যুর ছায়া তাকে ধরে ফেলা ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। ইয়েভগেনি প্রিগোজিন বহু বছর বিপদের ঝুঁকিকে সঙ্গী করেই বেঁচেছেন, কিন্তু বিদ্রোহটাই ছিল সবচেয়ে বাড়াবাড়ি। বিবিসি অবলম্বনে
গত বুধবার রাতে (বাংলাদেশ সময়) রাশিয়ার গণমাধ্যম জানায়, মস্কো থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গ যাওয়ার পথে প্রিগোজিনের প্রাইভেট জেটকে ভূপাতিত করেছে একটি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। বিমানের যাত্রীদের তালিকায় ভাগনার মার্সেনারি গ্রুপের সাবেক প্রধান প্রিগোজিনও ছিলেন।
জীবনের উল্লেখযোগ্য একটি সময় যুদ্ধ-সহিংসতায় নেতৃত্ব দেওয়ার পর– তার অস্থির জীবনের অবসান হয়েছে আকস্মিক ও নির্মমভাবে।
রাশিয়ায় ক্ষমতার শীর্ষে যিনি- প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, এক সময় তার একান্ত ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন ছিলেন প্রিগোজিন। বিভিন্ন সময় পুতিন তাকে দিয়ে অনেক কাজ করিয়েছেন। এমনকী ইউক্রেন যুদ্ধেও রুশ বাহিনীর সহযোগী হিসেবে মাঠে ছিল ভাগনারের যোদ্ধারা।
কিন্তু, এক পর্যায়ে ভাগনারের বিরুদ্ধে সেনাপ্রধান ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী শত্রুতা করছেন এমন অভিযোগ করেন সেসময়ে ভাগনার প্রধান প্রিগোজিন। তাদেরকে অপসারণের দোহাই দিয়ে ইউক্রেনের যুদ্ধের ময়দান থেকে হাজার হাজার যোদ্ধা নিয়ে রওনা দেন মস্কো অভিমুখে।
পুতিন তাৎক্ষনিকভাবে এই বিদ্রোহকে 'রাষ্ট্রদ্রোহ' বলে আখ্যায়িত করেন। পরে বেলারুশের মধ্যস্ততায় বিদ্রোহের অবসান হলেও, খুব শিগগিরই স্পষ্ট হয়ে যায়– রাশিয়ায় প্রিগোজিনের অসীম প্রতাপের অবসান হয়েছে।
তিনি ছিলেন এমন এক ব্যক্তি– যৌবনের এক দশক যার কেটেছে কারাগারে। সেখান থেকে বেরিয়ে হয়েছেন হটডগ বিক্রেতা। পরে করেছেন খাবার সরবরাহের (ক্যাটারিং) কাজ। এই ব্যবসার সুবাদেই পুতিনের সুনজরে আসেন একসময়, আর অঢেল বিত্ত গড়ার সুযোগও পান। পুতিনের সম্মতিক্রমে গড়ে তোলেন ভাড়াটে যোদ্ধা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ভাগনার; যা পরবর্তী সময়ে ক্রেমলিনের হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কার্যক্রম বিস্তার করে।
প্রথমে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের সংঘাতে, এরপর সিরিয়া ও ইউক্রেনের ডনবাস অঞ্চলের বিদ্রোহে ভাগনারের অংশগ্রহণ একজন সামরিক নেতা হিসেবে প্রিগোজিনের ভাবমূর্তি তৈরি করে। যা আরো প্রতিষ্ঠিত হয় রাশিয়া ইউক্রেনে পুরোদস্তুর আগ্রাসন চালালে, এক সময়ে পুতিনের 'শেফ' বলে পরিচিত প্রিগোজিন আরো বেশি ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠেন।
ক্ষমতার অহমিকা তাকে অন্ধ করেছিল হয়তো, সেকারণেই নিজেকে জাহির করতে শুরু করেন বিভিন্ন সময়। যুদ্ধ নিয়ে ক্রেমলিনের সমালোচনাও করেন খোলাখুলি।
তার পতনের সূত্রপাত সেখান থেকেই। এরপর তার মৃত্যুর খবরও জানা গেল। হয়তো ব্যর্থ বিদ্রোহের পর থেকেই মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে বেঁচে ছিলেন।
জানা গেছে, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থেকে ছোড়া গোলার আঘাতে তাকে বহনকারী এমব্রায়ার জেট বিমানটি ভূপাতিত হয়।
বিমান ভূপাতিত করার ঘটনা যদি ইচ্ছেকৃতভাবেই করা হয়, তাহলেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই, কারণ প্রিগোজিনের শত্রুর অভাব ছিল না। প্রিগোজিনের সাথে তার ফার্স্ট কমান্ডার দিমিত্রি উটকিন-ও মারা গেছেন।
দুই মাস আগে যখন ৬২ বছরের প্রিগোজিন বিদ্রোহ করেছিলেন, তখন অনেকেই ধারণা করেছিলেন পুতিন তাকে কঠোর শাস্তি দেবেন। কিন্তু, পরে তাকে বেলারুশে নির্বাসন দেওয়া হলে, বিস্মিত হন পর্যবেক্ষকরা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল, পুতিনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েও তিনি সাজা এড়াতে পেরেছেন।
বেলারুশের মধ্যস্ততায় করা ওই সমঝোতার আওতায় কথা ছিল- বিদ্রোহে যোগ দেওয়া ভাড়াটে যোদ্ধাদের নিয়ে বেলারুশে অবস্থান করবেন প্রিগোজিন। তবে রাশিয়ায় যাতায়াতের সুযোগ পেয়েছেন তিনি। যেমন গত জুলাইয়ে সেন্ট পিটার্সবার্গে আফ্রিকার নেতাদের সাথে রাশিয়ার সম্মেলন চলার সময়ে তাকে সাদামাটা পোশাকে ওই শহরে দেখা যায়।
তবে সেন্ট পিটার্সবার্গে তার বিলাসবহুল বাড়িতে কর্তৃপক্ষ অভিযান চালানোর পর– রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি তার ভিডিও বার্তায় বিষেদাগার করা বন্ধ হয়।
কিন্তু, বেলারুশে নিশ্চুপ বসে থাকার পাত্র ছিলেন না প্রিগোজিন। তাই ব্যর্থ বিদ্রোহের পর চলতি সপ্তাহে প্রথম তার একটি ভিডিও বার্তা প্রকাশিত হয়।
ভিডিও'র নেপথ্যে মরুভূমির দৃশ্যপট দেখে মনে হচ্ছিল, সেটি আফ্রিকায় ধারণ করা হয়েছে। সেখানে যুদ্ধের পোশাক-সজ্জিত প্রিগোজিন জানান, ৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে অগ্রাহ্য করে ভাগনার গ্রুপ নতুন ভাড়াটে সেনা নিয়োগ চালিয়ে যাচ্ছে, যাতে পৃথিবীর সব মহাদেশে রাশিয়ার অবস্থানকে আরো দৃঢ় করা যায়, আফ্রিকাকে আরো মুক্ত (পশ্চিমা প্রভাব থেকে) করা যায়।
অনেক বছর আগে মার্সেনারি প্রধান হিসেবে যে পরিচিতি অর্জন করেছিলেন, মনে হয়েছে সেই শেকড়েই ফেরার বার্তা দেন প্রিগোজিন। সেই ইতিহাস বলে, ভাগনারের সুবাদেই মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র ও সিরিয়ায় রাশিয়ার মিত্ররা টিকে থাকার সুযোগ পায়। এমনকী ভাগনারের প্রভাবেই ফরাসী আধিপত্যবাদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়ার শক্তি পায় মালি।
প্রিগোজিন তার সেন্ট পিটার্সবার্গের অফিসে ক্রেমলিন-পন্থী ব্লগারদের তথাকথিত 'ট্রল-ফ্যাক্টরি' প্রতিষ্ঠা করেন, যদিও এর অস্তিত্ব তিনি দীর্ঘদিন ধরে অস্বীকার করেছেন। তার প্রতিষ্ঠিত ইন্টারনেট গবেষণা সংস্থার বিরুদ্ধে তথ্যযুদ্ধ চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হস্তক্ষেপের অভিযোগও আছে।
চলতি বছরে এই পরিকল্পনার কথা স্বীকার করেন প্রিগোজিন। তার ভাষ্যমতে, 'পশ্চিমাদের একঘেয়ে ও আগ্রাসী রাশিয়া-বিরোধী অপপ্রচার থেকে রাশিয়ার তথ্যজগতকে রক্ষা করতেই তিনি এ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন।'
প্রিগোজিন শূন্য থেকে শীর্ষে উঠে আসার এক উদাহরণ। সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন পতনের দ্বারপ্রান্তে তখন জালিয়াতি ও ডাকাতির দায়ে যুবক প্রিগোঝিন জেল খেটেছেন। এরপর রাশিয়া সোভিয়েত অধ্যায়কে পেছনে ফেলে যখন এগুতে শুরু করে, তখন প্রথমে হটডগ বিক্রির মাধ্যমে এবং পরে সেন্ট পিটার্সবার্গে একের পর এক রেস্তোরাঁ খুলে খাবারের ব্যবসায় নামেন।
সেসময় সেন্ট পিটার্সবার্গের ডেপুটি মেয়রের সুনজর পড়ে তার প্রতি। পুতিন বুঝতে পারেন, এই লোকটির প্রবল উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে।
এবিষয়ে পরবর্তীকালে প্রিগোজিন বলেছিলেন, 'সামান্য কিয়স্ক থেকে কিভাবে আমি ব্যবসা গড়ে তুলেছি ভ্লাদিমির পুতিন তা দেখেছেন।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ফ্রান্সের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জ্যাক শিরাকসহ বিশ্বনেতাদের নিয়ে প্রিগোজিনের রেস্তোরায় গেছেন পুতিন। আর সেই সুবাদে এই ক্যাটারিং ব্যবসায়ী পুতিনের 'শেফ' পরিচিতি লাভ করেন।
মার্সেনারি ব্যবসা প্রিগোজিনকে সামরিক প্রভাব এনে দিলেও – ক্যাটারিং ব্যবসা থেকেই তার বিত্ত বাড়তে থাকে।
ভাগনারের ব্যর্থ বিদ্যোহের পর পুতিন জানান, গত ১২ মাসে প্রিগোজিনের ভাড়াটে সেনাদের পেছনে ১ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে রুশ সরকার। এই সময়ে রুশ সেনাবাহিনীকে খাদ্য সরবরাহের জন্য প্রিগোজিনের কনকর্ড ক্যাটারিং ফার্মকে আরো ১ বিলিয়ন ডলার দেয় ক্রেমলিন।
এতো গেল মাত্র এক বছরের হিসাব, বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে ১৮ বিলিয়ন ডলারের সরকারি ঠিকাদারি পেয়েছেন তিনি।
রাশিয়ার একজন প্রভাবশালী উপস্থাপক ও ক্রেমলিনের পক্ষে প্রচারণাকারী দিমিত্রি কিশেলিয়ভ বলেন, বিপুল অর্থই প্রিগোজিনকে 'লাইনচ্যুত' করে, আর যুদ্ধের ময়দানে তার ভাড়াটে সেনাদের সাফল্যের ফলে তিনি নিজেকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে মনে করতে থাকেন।
কিশেলিয়ভ বলেন, 'তিনি ভেবেছিলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে, খোদ রাষ্ট্র ও প্রেসিডেন্টকেও চ্যালেঞ্জ করতে পারবেন।'
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রিগোজিন নিজের শক্তি সম্পর্কে ভুল ধারণা রাখতেন। আর সেকারণেই, পুতিনের নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানান, যা তার বিস্ময়কর ও বিতর্কিত জীবনের অবসানের সূত্রপাত রচনা করে।