আইসিজেতে রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলা: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গাম্বিয়ার সঙ্গে তথ্য বিনিময় করেছে
রোহিঙ্গাদের ওপর সংঘটিত নৃশংসতার অভিযোগে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) জেনোসাইড কনভেনশনের অধীনে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যে মামলা করা হয়েছে, সে বিষয়ে গাম্বিয়াকে তথ্য দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া বলেছেন, আমরা নৃশংসতার দীর্ঘ ইতিহাস মোকাবিলার জন্য একটি সার্বিক অন্তর্বর্তীকালীন ন্যায়বিচার প্রক্রিয়াকে সমর্থন করতে প্রস্তুত রয়েছি। এই বিচার প্রক্রিয়া সত্যকে প্রতিষ্ঠা, ক্ষতিপূরণ ও ন্যায়বিচারের দাবিতে, এবং এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না হয় সে জন্য ভুক্তভোগী এবং বেঁচে থাকা মানুষের দাবিকে সম্মান জানানোর জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ গণহত্যা শুরুর ছয় বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে জেয়া এসব কথা বলেন।
গণহত্যার কথা স্বীকার করাই একমাত্র কাজ নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, সহিংসতার অবসান ঘটাতে এবং নৃশংসতার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে সবাইকে একসঙ্গে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে।
অনুষ্ঠানে যোগদানকারী রোহিঙ্গা প্রবাসী সদস্যদের ধন্যবাদ জানান।
তিনি বলেন, 'চলমান নিপীড়নের মুখে আমি আপনাদের সহনশীলতার প্রশংসা করি।'
২০১৬-২০১৭ সালে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের উপর নৃশংস হামলা চালায়।
নির্যাতন, যৌন ও লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতাসহ পদ্ধতিগত সহিংসতা ও গণহত্যার ফলে বিপুল সংখ্যক মানুষ বাস্তুচ্যুত হন এবং হাজার হাজার নিরীহ মানুষ প্রাণ হারান।
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী দেশটির সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের লক্ষ্যবস্তু করেছিল। তারা ৭ লাখ ৪০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে। এসব আক্রমণের ভয়াবহ প্রভাব আজ ছয় বছর পরেও অব্যাহত।
বাংলাদেশ এক মিলিয়নেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আরও অনেকে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
জেয়া বলেন, 'জুলাই মাসে বাংলাদেশ সফরের সময় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তারা মিয়ানমারে তাদের ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ওপর ঘটে যাওয়া ভয়াবহ সহিংসতার বর্ণনা দেন। একইসঙ্গে নিজ দেশে ফিরে গেলে আবারও নিপীড়নের শিকার হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন।'
মিয়ানমার সরকার জাতিগত ও ধর্মীয় বিভাজনের ভিত্তিতে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। ২০১৬-২০১৭ পর্যন্ত অধিকার, নাগরিকত্ব, বাড়িঘর এবং এমনকি তাদের জীবন হারানোর ঘটনায় এ বিষয়টি স্পষ্ট বোঝা যায়। রোহিঙ্গারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মিয়ানমারের সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ- এই সত্যকে চাপা দেওয়া চেষ্টা করেছে দেশটির সরকার।
জেয়া বলেন, 'আমরা দায়ীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা, বেঁচে থাকা ও ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা করা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আমাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতিতে অটল।'
রোহিঙ্গাদের জীবন রক্ষাকারী মানবিক সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে একক দেশ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান প্রথমে।
দেশটি ২০১৭ সাল থেকে মিয়ানমার, বাংলাদেশ এবং এই অঞ্চলের এ সংক্রান্ত সংকটে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার জন্য ২ দশমিক ১ বিলিয়নেরও বেশি সহায়তা দিয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গারা নিরাপদে মিয়ানমারে তাদের মাতৃভূমিতে ফিরতে পারবে না- তা স্বীকার করে তিনি বলেন, পুনর্বাসন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়, সেখানে আমরা অবদান রাখছি।
২০০৯ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশসহ এই অঞ্চল থেকে প্রায় ১৩ হাজার রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে।
জেয়া বলেন, 'আমাদের কাজ শুধু মানবিক নয়, আমাদের অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে।'
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের জন্য জাতিসংঘের স্বাধীন তদন্ত প্রক্রিয়াতেও সহায়তা করছে। দেশটির একটি ম্যান্ডেট হলো- ২০১১ সাল থেকে মিয়ানমারে সংঘটিত সবচেয়ে গুরুতর আন্তর্জাতিক অপরাধ ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের প্রমাণ সংগ্রহ, একত্রীকরণ, সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণ করা।
ওপেন সোর্স তদন্ত পরিচালনার ক্ষমতা জোরদার করতে এবং প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীদের রক্ষা করার জন্য মার্কিন সহায়তার মধ্যে ২ মিলিয়ন ডলার তহবিল দেওয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে।
জেয়া বলেন, 'আমরা জবাবদিহি চাওয়ার ক্ষেত্রে একা নই। বুধবার, আমরা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে একটি যৌথ বিবৃতিতে জান্তা সরকারের করা নিরবচ্ছিন্ন সহিংসতা অবসানের আহ্বান জানিয়ে আরও ১২টি দেশের সঙ্গে একমত প্রকাশ করেছি।'
এই বিবৃতিতে রোহিঙ্গাদের অধিকার ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
বুধবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের অর্থনীতির জেট ফুয়েল সেক্টর পরিচালনাকারী বিদেশি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের উপর তাদের নিষেধাজ্ঞাকে আরও প্রসারিত করেছে এবং এই তালিকায় দুই ব্যক্তি ও তিনটি সংস্থাকে অন্তর্ভুক্ত করেছে।
তিনি বলেন, 'ভুক্তভোগীদের জন্য ন্যায়বিচারও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর্জেন্টিনার আদালতে তাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত নৃশংসতার জন্য সাহসীকতার সঙ্গে বিচার চেয়েছে রোহিঙ্গারা। তাদের সমর্থন করার জন্য আন্তর্জাতিক অংশীদার ও এনজিওগুলোর সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও রযেছে।'
জেয়া বলেছেন, তারা সক্রিয়ভাবে সুশীল সমাজ এবং রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের সদস্যদের সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত নৃশংসতা এবং অন্যান্য নির্যাতনের ঘটনা নথিভুক্ত করার জন্য কাজ করছে। মিয়ানমারের সেনা সদস্যরা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে বলে জানিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। ২০২২ সালের মার্চে দেওয়া এই স্বীকৃতি ছিল একটি যুগান্তকারী ঘটনা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আটবার এধরনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে।
জেয়া বলেন, 'শরণার্থীদের নিরাপদ, স্বেচ্ছায়, মর্যাদাপূর্ণ এবং স্থায়ী প্রত্যাবাসনের পরিবেশ তৈরি করাসহ বেঁচে থাকা ব্যক্তিদের প্রয়োজনগুলো বিবেচনায় নিতে হবে আমাদের। আমাদের অবশ্যই মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য সেনাবাহিনীর অব্যাহত দায়মুক্ত থাকার বিষয়টি মোকাবিলা করতে হবে। পাশাপাশি যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ন্যায়বিচারের জন্য অবশ্যই তাদের লড়াইকে সমর্থন করতে হবে।'
এই মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন, 'কীভাবে আমরা একটি শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক মিয়ানমার নিশ্চিত করতে পারি, তা নির্ধারণে এই পদক্ষেপগুলো নেওয়া হচ্ছে। যে ব্যবস্থা সবার মানবাধিকারকে সম্মান করে।'