এইসব 'আলোচিত ঘটনা’ আমাদের কী বার্তা দেয়?
একটা দেশে একই সময়ে কত বিপরীতধর্মী ও কত অদ্ভুত ঘটনা যে ঘটতে পারে, বাংলাদেশ তার প্রমাণ। দেশের হাসপাতালগুলোতে একদিকে ডেঙ্গু রোগীরা কাতরাচ্ছেন; পর পর দুই সপ্তাহে দুজন বাবা-মা সন্তান হারিয়ে পাগলপ্রায়; আরেকজন বাবা তার সন্তানকে বাঁচাতে পারবেন কিনা তা ভেবে আর্তনাদ করছেন; রোগীদের স্বজনরা পাগলের মতো রক্ত আর স্যালাইনের জন্য দৌঁড়াচ্ছেন। অন্যদিকে বারডেমের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ত একটি হাসপাতালে আড্ডাকে কেন্দ্র করে মারামারি, গালাগালি, হট্টগোল করছেন কতিপয় উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকতা। দুটি বিপরীতধর্মী চিত্রের এ বিষয়টা ভাবা না গেলেও, এইটাই আমাদের বাস্তবতা। এই ঘটনা নিয়ে দশ জনে দশ কথা বলছেন, সামাজিক মাধ্যমে লিখছেন, এমনকি কেউ কেউ ওয়েব সিরিজ লিখবেন বলে কাগজ কলম নিয়ে বসে গেছেন।
এরমধ্যে গত ৩/৪ দিন যাবত দেশবাসীর আলোচ্যসূচিতে ছিলেন এডিসি হারুণ। সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, এমনকি সহকর্মীকে মারধর করে পার পেয়ে যাওয়া রমনা জোনের এডিসি হারুণ অর রশিদের 'নতুন কাহিনী'। আগের ঘটনাগুলোতে তার বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ না নেওয়া হলেও এবার ছাত্রলীগ নেতার দাঁত ভেঙে দেওয়ার ঘটনায় বেশ বিপদেই পড়েছেন তিনি। কারণ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান নিজেই বলেছেন পুলিশের কেউ অন্যায় করলে তার সাজা হবে। হুম, একটা লঘু সাজা হয়েছিলও বটে।
গত সোমবার (১১ সেপ্টেম্বর) বিকেলে জাতি জানতে পারলো, ছাত্রলীগের তিন নেতাকে থানায় মারধর করার ঘটনায় পুলিশের রমনা বিভাগ থেকে বদলি হওয়া অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) হারুন অর রশিদকে সাময়িক বরখাস্ত করা হচ্ছে। ডিএমপি কমিশনারের সঙ্গে দুই ছাত্রলীগ নেতার সাক্ষাতের পর এই সাময়িক বরখাস্ত করা হচ্ছে এমন খবরও পাওয়া যায়।
এর আগে রোববার দুপুরে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, এডিসি হারুনকে রমনা বিভাগ থেকে সরিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) দাঙ্গা দমন বা পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট বিভাগে সংযুক্ত করা হয়েছে। একইদিন সন্ধ্যায় জানানো হয়, তাকে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে (এপিবিএন) বদলি করা হয়েছে। সাময়িক বরখাস্ত করে পুলিশ অধিদপ্তরে সংযুক্ত করা করার কিছু সময় পরেই মঙ্গলবার হারুনকে পুলিশের রংপুর রেঞ্জে সংযুক্ত করে আদেশ জারি হয়।
পুলিশ এমন একটি প্রতিষ্ঠান যাদের চেইন অব কমান্ড আছে। আছে কঠোর আইনী বিধান। পুলিশ একটি সিভিল ফোর্স। পুলিশের সামরিকীকরণ কিভাবে প্রতিষ্ঠানের সিভিলিটি নষ্ট করে দিতে পারে, এটা ভেবে দেখার সময় এসেছে। ছাত্রলীগের নেতাদের পেটানোর বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান ছেপেছে দৈনিক সমকাল। সেটা পড়ার পর মনে হয়েছে এই আচরণ আদতে সুস্থ মানসিকতার ব্যক্তিদের আচরণ কিনা।
সেই ঘটনার প্রেক্ষিতে, একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার শাস্তি ধার্য করা নিয়ে এরকম ঘটনা মনে হয় এই বাংলাদেশেই সম্ভব। ছাত্রলীগ নেতার দাঁত উপড়ে ফেলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে খুব অল্প সময়ের মধ্যে হারুণ সাহেবের বদলি হওয়া, এরপর সাময়িক বরখাস্ত হওয়ার আদেশ, আবার এপিবিএন-এ বদলি ও সর্বশেষ রংপুর রেঞ্জে সংযুক্তির আদেশ --- পর পর এই ঘটনাগুলো মনে রাখার জন্য একটি চার্ট করে ফেলতে হবে জাতিকে। নয়তো ঘটনার ধারাবাহিকতা মনে রাখা কষ্টকর হচ্ছে।
এখানেই শেষ নয়। ছাত্রলীগের দুই কেন্দ্রীয় নেতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নেতাকে থানায় নিয়ে মারধরের ঘটনার চার দিনের মাথায় এসে পুলিশ বলছে, এডিসি হারুণের ওপরই প্রথম হামলা হয়েছে। হামলা করেছেন রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস)। এদিকে এ ঘটনা নিয়ে রাষ্ট্রপতির এপিএস মঙ্গলবার পর্যন্ত মুখ না খুললেও, মুখ খুলেছেন ঘটনার সঙ্গে জড়িত তার স্ত্রী ঢাকা মহানগর পুলিশের এডিসি (অতিরিক্ত উপকমিশনার) সানজিদা আফরিন। ঘটনাটি নিয়ে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আইকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, এডিসি হারুনকে তার স্বামী আজিজুল মারধর করেছেন। অবশ্য এরপরেই ডিএমপি'র কমিশনার বলেছেন, "অনুমতি ছাড়া বক্তব্য দিয়ে এডিসি সানজিদা ঠিক করেননি।"
এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকেই সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। ঘটনাস্থলও বারডেম হাসপাতাল। সেখানেই ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া এবং তুমুল বাগবিতণ্ডা হয়েছে। একটি হাসপাতালে গিয়ে সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা তাদের ব্যক্তিগত ইস্যু নিয়ে এরকম আচরণ করেন কিভাবে? সন্ধ্যাবেলায় হাসপাতালে রোগীদের বিশ্রামের কথা ভেবেই যেখানে দর্শনার্থী প্রবেশ নিষিদ্ধ, সেখানে আড্ডা, মারামারি, হামলা ও গালাগালির কথা ভাবাই যায় না।
এই আলোচনার রেশ চলতে চলতেই খবরে দেখলাম, আলোচিত ইউটিউবার আশরাফুল হোসেন আলম ওরফে হিরো আলম বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্মলীগে যোগ দিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্মলীগ নেতাদের সঙ্গে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধি সৌধ টুঙ্গীপাড়ায় শ্রদ্ধা জানাতে ও জিয়ারত করতে যান। ঘটনাটি এমন গুরুত্বপূর্ণ নাও হতে পারতো, যদি নাকি হিরো আলম একে পুঁজি করে ভবিষ্যতে কিছু করতে না চাইতেন। উনি যে পুঁজি করবেন, ওনার এটিচিউড আমাদের সে বার্তাই দেয়।
হিরো আলমের উত্থান এবং কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা করতে চাইলে অনেক কিছু বলা যায়। তার নিম্নমানের ভিডিও মেকিং, সেই ভিডিওর কোটিখানেক ভিউ, রবীন্দ্র সঙ্গীত গাওয়ার পর ডিবি অফিসে ধরে নিয়ে যাওয়া, হিরো আলম এ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস নামানো, নির্বাচনে দাঁড়ানো, মারপিটের মধ্যে পড়ে পরনের কাপড় ছিঁড়ে যাওয়া- সবই এই আলোচনায় আসবে। শেষ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্মলীগে যোগ দিয়েছেন। হিরো আলমের মতো একজন ব্যক্তির প্রজন্মলীগে যোগদান দেশের রাজনীতির দীনতাই প্রকাশ করছে। এর মাধ্যমে ধারণা করা যায়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভালো নেতা ও কর্মীর সংকট এবং একই সাথে রুচির সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। কে যে কখন রাজনীতিবিদ হয়ে উঠছেন এবং সরাসরি ক্ষমতার কাছাকাছি চলে যাচ্ছেন, তা ভাবলে অবাকই লাগে।
আমাদের এ সপ্তাহের আলোচনায় আরো ছিল দিল্লিতে জি-২০ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সেলফি। এরপর রাজভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে হাঁটু গেড়ে বসা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের একটি ছবি ভাইরাল হওয়া। ভাইরাল ছবিতে দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চেয়ারে বসে রয়েছেন। আর তার পাশে মেঝের ওপর খালি পায়ে হাঁটু গেড়ে বসে কথা বলছেন ঋষি সুনাক।
ইতোমধ্যে ঢাকায় এসে ঘুরে গেলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ। হঠাৎ মাখোঁ সাহেবের উপস্থিতি নিয়েও প্রচুর কথা হচ্ছে। অবশ্য ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিজেই খোলাসা করেছেন তিনি কেন এসেছেন। চা, সিঙ্গারা বা রাহুলের গান শুনতে নয়, ১০টি ফরাসি এয়ারবাস ও স্যাটেলাইট বিক্রির জন্য।
তাহলে কেন মাঁখো, সুনাক এবং বাইডেন এরকম সহৃদয় আচরণ করলেন? না করলেও তো চলতো। উন্নত দেশের ক্ষমতাসম্পন্ন নেতাদের এমন আচরণে বিস্মিত হয়েছি আমরা, অর্থাৎ বাংলাদেশের মানুষ। এসব ঘটনাকে নিজেদের সংস্কৃতির আলোকে বিচার করেছি আমরা। বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে এই ঘটনাগুলোকে দেখেছেন ও মন্তব্য করেছেন। কে, কেন, কোন উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এই কাজগুলো করেছেন সেগুলো অবশ্যই আলোচনার দাবি রাখে। এমনতো হতেই পারে যে উন্নত বিশ্বের ঐ নেতারা তাদের নিজেদের দেশের মতো করেই এই কাজগুলো করেছেন, নিছক লোক দেখানোর জন্য নয়।
নেতাকে মানুষ কিরকম দেখতে চায় এটা নিয়ে বিভিন্ন জাতি ও সংস্কৃতিতে ভিন্নতা আছে। ঠিক এই কথাটার ব্যাখ্যা পেয়ে গেলাম ব্লগার সিরাজুল হোসেন এর একটি লেখায়। তিনি লিখেছেন, ডাচ গবেষক হফস্টেডের তত্ত্ব অনুসারে 'ক্ষমতা-দুরত্ব' নামে একটি মাত্রার কথা। এই মাত্রা হল মানুষ তাদের নেতা বা প্রধানকে কেমন দেখতে চায়। নিজেদের মত একই রকম ক্ষমতাশালী না কি সবার চেয়ে অনেক ক্ষমতাশালী? ক্ষমতা-দুরত্ব স্কেলে বাংলাদেশের স্কোর ৮০। এর অর্থ আমরা নেতা বা নেতৃত্বকে নিজেদের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাশালী দেখতে চাই।
অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের ক্ষেত্রে এই স্কোর ৩৫। এর অর্থ তারা নেতা বা প্রধানকে দেখতে চায় নিজের ক্ষমতার কাছাকাছি। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের মেঝের ওপর হাঁটু গেড়ে বসার বিষয়টি তেমনই। সে যত নিজেকে অন্যের সমান প্রমাণ করতে পারবে, তার সমাজে নেতা হিসাবে সে তত গৃহিত হবে।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁর মানুষের সাথে মিশে যাবার বিষয়টাও হয়তো তেমন। হফস্টেডের তত্ত্ব অনুসারে 'ইনডিভিজুয়ালিজম' ও 'ইনডালজেন্স' এর স্কোর বাংলাদেশের ২০, মানে অতি নিম্ন। অন্যদিকে ফরাসীদের যথাক্রমে ৭১ ও ৪৮। এর অর্থ অন্যের উপর প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে আমরা রাসভারী ও কর্তৃত্বমূলক চেহারা দেখাতে চেষ্টা করি, ওরা সেটা ততটা করে না।
যাক বাংলাদেশের আলোচ্য বিষয়ে ফিরে আসি। কিছুদিন আগে দেখলাম ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল (ডিএজি) পদ থেকে বরখাস্ত হওয়া এমরান আহম্মদ ভূঁইয়া নিরাপত্তা চেয়ে পরিবার নিয়ে ঢাকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে গিয়ে আশ্রয় চেয়েছেন। এ বিষয়ে তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, "আমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। তাই পরিবারসহ যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে হাজির হয়েছি। বন্ধের দিন হওয়ায় নিরাপত্তাকর্মীরা ভেতরে যেতে দেননি। মূল ফটকের পাশে একটি কক্ষে আমাদের বসিয়েছেন।" একজন উচ্চপদস্থ মানুষ ছুটির দিন কোন যুক্তিতে মার্কিন দূতাবাসে নিরাপত্তা চাইতে গেলেন এবং কেন গেলেন, জাতি এটাও বুঝতে পারেনি। তবে আইনমন্ত্রী একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন এ প্রসঙ্গে। তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন , "এই জন্যই তো নাটক সাজিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে যেতে চায়, বিষয়টি আমি দেখছি।"
এদিকে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, তার অফিস থেকে ইউনুসের বিপক্ষে কোনো বিবৃতি তৈরি করা হয়নি বা কাউকে সই করতে বলা হয়নি। তাহলে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কিসের ভিত্তিতে এরকম বক্তব্য দিলেন? বেশ একটা আলোচনা চললো কিছুদিন এই নিয়ে।
আমরা প্রতিদিন এমনসব ঘটনা দেখি, আলোচনা করি, লেখালেখি করি, সামাজিকমাধ্যম গরম করি, যা আমাদের দৃষ্টিকে মূল সমস্যা থেকে অন্যদিকে নিয়ে যায়। এর উপর যখন দেখি সরকারের বড় বড় পদে থাকা ব্যক্তিরা অসহিষ্ণু আচরণ করছেন, তখন মনে হয় কী যেন, হয়তো এইদেশে আমরাই অচল, আর আলম সাহেবের মতো ব্যক্তিরাই সচল।
শেষে এসে বলছি, এই দেশটা আমাদের, দেশটাকে আমরা ভালবাসি। তাই এই দেশে ঘটে যাওয়া উদ্ভট ঘটনা নিয়ে লিখতে বা হাসাহাসি করতে আমরাও চাই না, চাই প্রকৃত সমস্যা নিয়ে কথা বলতে ও সাফল্যগাঁথা গাইতে।
- লেখক: যোগাযোগ কর্মী
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফল। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।