জানুয়ারির মধ্যে ম্যান মেড ফাইবারের কাঁচামাল আমদানি নির্ভরতা ৫০% কমানোর উদ্যোগ
ম্যান মেড ফাইবারের (এমএমএফ) তৈরি পোশাক, জুতাসহ আরো কিছু পণ্যের মূল কাঁচামাল দেশে উৎপাদনে বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে আসায় আমদানি নির্ভরতা কমছে এবং আগামী জানুয়ারির মধ্যে এ নির্ভরতা প্রায় অর্ধেক কমিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
হাতেগোনা দুয়েকটি প্রতিষ্ঠান দেশে ছোটখাট পরিসরে এর কাঁচামাল তৈরি করলেও চট্টগ্রামভিত্তিক টিকে গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান, মডার্ন সিনটেক্স লিমিটেড প্রথমবারের মতো দুটি প্রধান কাঁচামাল উৎপাদন করতে যাচ্ছে। এগুলো হলো- পলিয়েস্টার স্টেপল ফাইবার এবং পলিথিন টেরেফথালেট (পেট) চিপস।
আগামী নভেম্বর থেকে স্বল্প পরিসরে এবং জানুয়ারি থেকে পুরোদমে উৎপাদন শুরু করবে এরা।
এর বাইরে নিজেদের তৈরি পেট চিপস থেকেই ড্রন টেক্সচার্ড ইয়ার্ন (ডিটিওয়াই) এবং পলিয়েস্টার ফুল্লি ড্রন ইয়ার্ন (এফডিওয়াই) উৎপাদন করবে।
মডার্ন সিনটেক্সের জেনারেল ম্যানেজার সফল বড়ুয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আগামী নভেম্বর থেকে আমরা উৎপাদন শুরু করবো। বাজারে অন্য যারা একই পণ্য উৎপাদন করে, সবাই মিলে আগামী বছরের শুরু থেকে চাহিদার প্রায় অর্ধেক পূরণ করা সম্ভব হবে।"
তিনি বলেন, "এর ফলে বাংলাদেশের বছরে প্রায় ৬৫ মিলিয়ন বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে, আমদানি করতে না হওয়ায় লিড টাইমে এগিয়ে থাকার সুযোগ তৈরি হবে, যা বাংলাদেশকে প্রতিযোগিতা সক্ষম করতে সহায়তা করবে।"
টিকে গ্রুপের অপর দুই প্রতিষ্ঠান মডার্ন পলি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এবং সুপার সিন্থেটিকও ম্যান মেড ফাইবারের চারটি মূল কাঁচামালের মধ্যে দুটি উৎপাদন করে, যারা ওই দুটি কাঁচামাল সরবরাহে এখন মার্কেটে শীর্ষ। এর বাইরে বেঙ্গল সিনথেটিক এবং নোমান গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান সামান্য পরিমাণ ডিটিওয়াই এবং এফডিওয়াই উৎপাদন করে।
তবে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের শ(বিটিএমএ) তথ্য অনুযায়ী, দেশে ম্যান মেড ফাইবারের কাঁচামালের ৯০ শতাংশের বেশিই আমদানি নির্ভর।
বিটিএমএ'র সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন টিবিএসকে বলেন, "স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যদি পিএসএফ এবং পেট চিপস এর মতো কাঁচামাল সরবরাহ করতে পারে, তা অবশ্যই ইতিবাচক খবর হবে, কেননা এতে একদিকে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে, অন্যদিকে সময়ের ক্ষেত্রে (লিড টাইম) আমাদের জন্য সুবিধা হবে।"
"তবে তারা এই পণ্য প্রতিযোগিতামূলক দরে দিতে পারবে কিনা, তা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়", বলেন তিনি।
অপর একজন টেক্সটাইল মিল মালিক টিবিএসকে বলেন, "যেহেতু ম্যান মেড ফাইবারের পোশাকের চাহিদা বাড়ছে এবং এক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো অনেক পিছিয়ে। স্থানীয়ভাবে কাঁচামাল সরবরাহের সুযোগ তৈরি হলে বাংলাদেশের সামনেও ভবিষ্যতে বেশি অর্ডার নেওয়ার সুযোগ তৈরি হবে, কেননা ক্রেতাদের আত্মবিশ্বাস বাড়বে।"
দেশের রপ্তানির ৮৪ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) মতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি মূল্য ছিল প্রায় ৪৭ বিলিয়ন ডলার।
পোশাক রপ্তানিকারকরা বলছেন, এর মধ্যে ২০ শতাংশের মতো ম্যান মেড ফাইবারের পোশাক রপ্তানি হয়। অথচ বিশ্ববব্যাপী এমএমএফ'র পোশাকের চাহিদা বাড়ছে।
পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে পোশাকের বাজারে এমএমএফ এবং নন-কটন পোশাকের বাজার ৭০ শতাংশের উপরে।
বাংলাদেশের ম্যান-মেড ফাইবারের কাঁচামাল হিসেবে এক সময় এমএমএফ ফেব্রিক পুরোটাই আমদানি হতো। বর্তমানে দেশে ৫০টির মত টেক্সটাইল প্রতিষ্ঠান পিএসএফ, এফডিওয়াই ও ডিটিওয়াই আমদানি করে এখান থেকে ইয়ার্ন তৈরি করে স্থানীয় ফেব্রিক উৎপাদকদের সরবরাহ করতে সক্ষম হয়েছে।
কিন্তু আলোচ্য তিনটি কাঁচামাল যা পেট্রোকেমিক্যাল থেকে তৈরি হয়, তা স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করতে পারেনি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পেট চিপস আমদানি করে সেখান থেকে ডিটিওয়াই ও এফডিওয়াই উৎপাদন করলেও বিশাল বিনিয়োগ করতে হওয়ায় পিএসএফ এবং পেট চিপস উৎপাদনে যায়নি কেউ।
মডার্ন সিনটেক্স লিমিটেড নামের এ প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে অবস্থিত। সরেজমিন ওই ইকোনমিক জোন ঘুরে মডার্ন সিনটেক্সের প্রস্তুতি নিয়ে কথা হয় প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে।
টিবিএসকে জানান, বর্তমানে কিছু পরীক্ষামূলক উৎপাদন কাজ শুরু করেছেন তারা।
তারা জানান, দেশে প্রতিদিন পিএসএফ এর চাহিদা ৩৫০ টন, যার মধ্যে একক তাদের প্রতিষ্ঠানটি ৬০% সরবরাহ করতে সক্ষম হবে। এছাড়া পেট চিপস এর চাহিদা একই, যার মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি সরবরাহ করতে পারবে ৩০%।
বিনিয়োগের চ্যালেঞ্জ
উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, বিশ্ববাজারে পোশাকের চাহিদার ৭০ শতাংশের বেশি এমএমএফ পোশাকের হলেও বাংলাদেশ এর কাঁচামাল উৎপাদনে বিনিয়োগ করেনি। এর মূল কাঁচামাল পরিশোধিত টেরেফথ্যালিক অ্যাসিড (পিটিএ) এবং মনো ইথিলিন গ্লাইকল (এমইজি) আমদানি করতে হয়, কেননা এটি বাংলাদেশে হয় না। এর মাধ্যমে পিএসএফ ও পেট চিপস তৈরি করতে হলে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও পানির সরবরাহ থাকতে হবে। এছাড়া এ ধরণের কারখানায় বিপুল বিনিয়োগেরও প্রয়োজন।
এছাড়া বাংলাদেশে এ ধরণের প্রতিষ্ঠান এই প্রথম হওয়ায় দক্ষ জনশক্তির অভাবও একটি চ্যালেঞ্জ। এছাড়া কাঁচামাল আমদানিতে ৫% ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স রয়েছে, যা প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা বলে মনে করছেন তারা।
টিকে গ্রুপের অপর দুই প্রতিষ্ঠান বাদে কেবল মডার্ন সিনটেক্স লিমিটেড এজন্য বিনিয়োগ করেছে ১৪১ মিলিয়ন ডলার।
প্রতিষ্ঠানটির জেনারেল ম্যানেজার সফল বড়ুয়া বলেন, "গ্যাস সংযোগ পেয়েছি। তবে ভবিষ্যতে পানির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ পাবো কিনা, তা এখনো বলতে পারছি না।"
প্রতিষ্ঠানটিতে প্রায় ১৫০০ জনবল প্রয়োজন হবে। এর মধ্যে ৩০০ জন 'ফ্রেশ ওয়ার্কার' ইতিমধ্যে নিয়োগ দিয়ে তাদের টিকে গ্রুপেরই অপর প্রতিষ্ঠান মডার্ন পলি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডে বর্তমানে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
অবশ্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরের প্রকল্প পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ ফারুক বলেন, "প্রতিষ্ঠানটির গ্যাসের সমস্যা সমাধান করা হয়েছে। কিন্তু খুব বেশি পানির প্রয়োজন হবে, এমন চাহিদা আমাদের কাছে দেওয়া হয়নি। যে প্রয়োজন রয়েছে, তার ব্যবস্থা বর্তমানে রয়েছে। আশা করছি, ভবিষ্যতেও অসুবিধা হবে না।"