ইলেকট্রনিক ডিভাইস আসক্তি: শিশুর দেরিতে কথা বলার অন্যতম কারণ
ঢাকার উত্তরার বাসিন্দা রাখি-মাসুদ দম্পতির একমাত্র সন্তান জাবিরের বয়স তখন দেড় বছর। সারাদিন তার চোখ আটকে থাকে মোবাইল স্ক্রিনে। কখনো ভিনদেশি কার্টুন আবার কখনো মোবাইল গেমস নিয়েই ঘরের এক কোণে নিশ্চুপ বসে থাকে জাবির। কেউ ডাকলে জবাব নেই কোনো, কারো সঙ্গে কথা বলায় নেই কোনো আগ্রহ। অথচ সাত মাস বয়স থেকেই 'মা', 'বাবা'র মতো শব্দ উচ্চারণ করতে শিখেছিল সে। দিন দিন যেন কথা বলতে ভুলে গেছে জাবির।
দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মা-বাবা তখন তাকে নিয়ে যান শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের শিশু বিকাশ কেন্দ্রে। কেস হিস্ট্রি শুনে, বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে ডাক্তার জানালেন সবার আগে ইলেকট্রনিক ডিভাইস থেকে দূরে সরাতে হবে জাবিরকে। মোবাইল-ট্যাব-ল্যাপটপ সবচেয়ে বড় শত্রু তার।
ডাক্তারের পরামর্শ মেনে স্পিচ থেরাপি, ব্যায়াম, মা-বাবার সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ আর পরিচর্যায় পরবর্তী তিন বছরে অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে আসে জাবিরের কথা বলা আর আচার-আচরণ। এই দম্পতির পরবর্তী সন্তান জন্মের পর থেকেই তাই অতিরিক্ত সচেতন ছিলেন ইলেকট্রনিক ডিভাইস নিয়ে।
বর্তমানে অভিভাবকদের অন্যতম দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে শিশুর কথা বলতে দেরি হওয়া। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু নিউরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা: গোপেন কুমার কুন্ডুর ভাষ্যে, "সাধারণত শিশুরা চার থেকে ছয় মাস বয়সের মধ্যে 'মামা-বাবা'র মতো বাবলিং সাউন্ড করে, এক বছরে এক-দুইটা করে অর্থবহ শব্দ বলতে শেখে, দুই বছরে ছোট ছোট বাক্য গঠন করতে পারে, তিন বছরে ছড়া বলতে শেখে, এর কোথাও ব্যত্যয় ঘটলে মা-বাবাকে বুঝে নিতে হবে শিশুর বিকাশে সমস্যা হচ্ছে। সম্প্রতি আমাদের কাছে চিকিৎসা নিতে আসা শিশুদের মধ্যে কথা বলতে সমস্যা হওয়ার ঘটনা খুব সাধারণ।"
বিশেষজ্ঞ এই ডাক্তারের মতে, শিশুদের কথা বলতে দেরি হওয়ার পেছনে মূলত দুই ধরনের কারণ থাকতে পারে। প্রথমটি জেনেটিক, দ্বিতীয়টি পরিবেশগত। ইলেকট্রনিক ডিভাইসের প্রভাব শিশুর বিকাশে বিঘ্ন ঘটার পরিবেশগত কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম।
সহজ সমাধান যখন বিপদের কারণ
শিশুর এক বছর পূর্ণ হওয়ার পরপরই সাধারণত বাবা-মায়েরা তাকে মোবাইল বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইস দিয়ে দেয়, দীর্ঘদিনের চিকিৎসার অভিজ্ঞতা থেকে জানান ডাক্তার গোপেন কুমার। অভিভাবকের সময় স্বল্পতায় শিশুকে ব্যস্ত রাখতে সহজ সমাধান হিসেবেই এসব ডিভাইসকে বেছে নেওয়া হয় অধিকাংশ পরিবারে। কিন্তু এই সহজ সমাধান কঠিন সমস্যা হিসেবে ধরা পড়ে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই।
মোবাইল ফোনের মতো ইলেকট্রনিক ডিভাইসে আসক্তির কারণে ধীরে ধীরে শিশু হয়ে ওঠে অন্যমনস্ক। সরাসরি কারো সঙ্গে কথা বলতে চায় না সে, অন্য কোনো খেলাধুলায় আগ্রহী হয় না, সময়মতো ঘুমাতেও চায় না। একপর্যায়ে পুরোপুরিই কথা বলা বন্ধ করে দিতে পারে শিশু।
মোবাইলে হিন্দি-ইংরেজি নানান ভাষার কার্টুন দেখতে দেখতে কখনো কখনো নিজের বানানো অর্থহীন শব্দে কথা বলার চেষ্টাও করতে পারে সে। এছাড়াও চোখ শুষ্ক হয়ে যাওয়া, দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া, ঘাড় ব্যথা, মাথা ব্যথার মতো নানা শারীরিক সমস্যারও শিকার হয় শিশু। ডিভাইসের প্রতি আসক্তি থেকে 'স্ক্রিন ডিপেন্ডেন্সি ডিজঅর্ডারে'ও ভুগতে শুরু করে শিশু।
সময় থাকতে হতে হবে সচেতন
শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য প্রথম পাঁচ বছর বয়সকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় বলে মনে করা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে বাচ্চার মস্তিষ্কের ৮০ শতাংশ বিকাশ ঘটে তিন বছর বয়স পর্যন্ত। বাকি ২০ শতাংশ বিকাশ ঘটে তিন থেকে পাঁচ বছর বয়সে। তাই এই বয়সেই শিশুদের দিকে সর্বোচ্চ খেয়াল রাখতে হয় বাবা-মায়ের।
ডা: গোপেন কুমার কুন্ডু বলেন, "প্রথম তিন বছর বয়সটা শিশুদের বিকাশের জন্য 'গোল্ডেন উইন্ডো পিরিয়ড' হিসেবে ধরা হয়। এই সময়ে শিশু যে পরিবেশে বড় হবে সেটা তার সারাজীবনের উপর প্রভাব ফেলবে। এই সময়টায় কোনো কারণে শিশুর ব্রেনের বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা সারিয়ে তোলা কষ্টকর।"
শিশুর এই বিকাশকালীন সময়ে কোনো সমস্যা খেয়াল করলে দেরি না করে সাথে সাথেই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়ার কথা বলেন এই চিকিৎসক। শিশুর কথা বলতে না চাওয়া, ইলেকট্রনিক ডিভাইসে আসক্তি, ঘুম কম হওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখলে জানাতে হবে ডাক্তারকে।
'আমাদের কাছে সাধারণত দুই-তিন বছর বয়সী বাচ্চাদের নিয়ে মা-বাবারা বেশি আসেন। দুই বছর বয়স বা তার আগে বাচ্চাকে নিয়ে এলে আমরা একটু বেশি সময় পাই সাহায্য করার। পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত বাচ্চার ব্রেইনের নিউরনের বিকাশ ঘটানোর জন্য আমরা চেষ্টা করতে পারি বিভিন্ন থেরাপি দিয়ে। কিন্তু যদি কোনো বাচ্চাকে পাঁচ বছর বয়সের পর নিয়ে আসা হয় তাহলে নিউরনের বিকাশের আর সময় থাকে না,' বলেন ডা: গোপেন কুমার।
শিশুর কোনো জেনেটিক জটিলতা না থাকলে সময়মতো চিকিৎসা গ্রহণ করে অনেকাংশেই সারিয়ে তোলা যায় কথা না বলার সমস্যা। চিকিৎসার জন্য সহায়তা করতে পারেন শিশু নিউরোলজিস্ট বা সাইকিয়াট্রিস্ট্ররা। এছাড়া নির্দিষ্ট সরকারি হাসপাতালের শিশু বিকাশ কেন্দ্রেও সহজে পাওয়া যাবে চিকিৎসা।
বড় দায়িত্ব বাবা-মায়ের
ইলেকট্রনিক ডিভাইস যেন শিশুর বিকাশে বাধা হয়ে না দাঁড়াতে পারে সেজন্য সবচেয়ে বেশি তৎপর হতে হবে শিশুর বাবা-মাকে। শুরু থেকেই শিশুকে একান্ত সময় দেওয়া, তার সঙ্গে সারাক্ষণ কথা বলা, অন্যান্য শিশুর সঙ্গে খেলতে নিয়ে যাওয়া- ইত্যাদির অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে তাদের। অভিভাবকেরা উভয়ই কর্মজীবী হলে দুজনে সময় ভাগাভাগি করে শিশুকে সঙ্গ দিতে হবে। শিশুর মঙ্গলের জন্য জীবনযাপন পদ্ধতিতে আনতে হবে পরিবর্তন।
ডাক্তার গোপেন কুমারের পরামর্শ অনুযায়ী, বাচ্চার ঘুমের সময় ঠিক রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডিভাইসে আসক্তির কারণে অনেক সময় শিশুর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। ঘুমের অভ্যাস ঠিক করতে শোবার ঘরে উপযুক্ত পরিবেশ রাখতে হবে। শোবার ঘরে টিভি থাকলে তা সরিয়ে ফেলতে হবে।
শিশুর কথা বলা শেখার সময়টায় যেকোনো একটি ভাষায় তার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা। 'বাচ্চা যখন তার আশেপাশে কয়েকটি ভাষায় কথা শুনতে পায় তখন সে বুঝতে পারে না কোন ভাষায় কথা বলবে। এ কারণে মাতৃভাষা বা যে ভাষায় আশেপাশের মানুষজন কথা বলছে কেবল সে ভাষাতেই শিশুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। কার্টুন বা অন্য কোনো অনুষ্ঠান দেখলেও তা হতে হবে একই ভাষায়। নয়তো শিশুর কথা শিখতে সমস্যা হয় খুব,' বলেন শিশু নিউরোলজিস্ট গোপেন কুমার কুন্ডু।
ইলেকট্রনিক ডিভাইস দিতে মানতে হবে নিয়মাবলি
প্রযুক্তি বিপ্লবের এই যুগে নতুন প্রজন্মের শিশুকে ইলেকট্রনিক ডিভাইস থেকে পুরোপুরি দূরে সরিয়ে রাখার কোনো উপায় নেই। শিশুর বিকাশকে বাধাগ্রস্ত না করতে চাইলে কিছু নিয়ম মেনে তাকে মোবাইল বা অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইস দেওয়ার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। যেমন:
· তিন বছর পূর্ণ হওয়ার পর মোবাইল-ট্যাবের মতো ইলেকট্রনিক ডিভাইস দেওয়া যেতে পারে শিশুকে।
· অভিভাবকের তত্ত্বাবধানে দিনে ঘণ্টাখানেকের জন্য এসব ডিভাইস ব্যবহার করতে পারবে শিশু।
· দেখতে হবে শিক্ষণীয় প্রোগ্রাম।
· ঘুমের আগে দেওয়া যাবে না ইলেকট্রনিক ডিভাইস।