চিপ প্রস্তুতে ব্যবহৃত বিরল ধাতুর রপ্তানি সম্পূর্ণ বন্ধ করেছে চীন!
সেমিকন্ডাক্টর তৈরিতে ব্যবহৃত বিরল খনিজ গ্যালিয়াম ও জার্মেনিয়ামের রপ্তানি গত আগস্ট মাসে শুন্যে নামিয়ে এনেছে চীন। এর আগে গত জুলাই মাসে ধাতুগুলো রপ্তানিতে 'দেশের নিরাপত্তা ও জাতীয় স্বার্থ বিঘ্নিত হতে পারে' বলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল বেইজিং।
ক্রিটিক্যাল ম্যাটেরিয়াল এলায়েন্সের তথ্যমতে, বিশ্বের মোট গ্যালিয়ামের ৮০ ভাগ এবং জার্মেনিয়ামের ৬০ ভাগ চীনের দখলে। তবে গত বুধবার দেশটির প্রকাশিত কাস্টমস ডেটা থেকে দেখা যায়, গত আগস্ট মাসে বিরল এই ধাতুটি আন্তর্জাতিক মার্কেটে বিক্রিই করেনি চীন।
অথচ ঠিক তার এক মাস আগে, অর্থাৎ গত জুলাই মাসেও ৫.৫১ মেট্রিক টন গ্যালিয়াম পণ্য ও ৮.১ মেট্রিক টন জার্মেনিয়াম পণ্য রপ্তানি করেছিল চীন। আর এক মাসের ব্যবধানেই রপ্তানি প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে বেইজিং।
গত আগস্ট মাসে বিরল ধাতু দুটি রপ্তানি না করার কারণ সম্পর্কে গতকাল (বৃহস্পতিবার) প্রেস ব্রিফিংয়ে চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হি ইয়াডংয়ের কাছে জানতে চাওয়া হয়। তিনি জানান, মন্ত্রণালয়ের কাছে রপ্তানির অনুমতি চেয়ে বেশ কয়েকটি কোম্পানির পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু আবেদন অনুমোদিত হয়েছে। যদিও এই সম্পর্কে বিস্তারিত আর কোনো তথ্য প্রদান করেনি তিনি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে প্রযুক্তি খাতে টেক্কা দিতেই যে চীন জার্মেনিয়াম ও গ্যালিয়ামের রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ করছে; সেটি অনেকটা স্পষ্ট। এতে করে সেমিকন্ডাক্টর জগতে নিজের একক কর্তৃত্ব স্থাপন করে প্রতিপক্ষ যুক্তরাষ্ট্রকে চাপে ফেলতে চায় বেইজিং।
তবে এটা সত্য যে, বিরল ধাতু দুটি উৎপাদনে চীন অন্য সকল দেশের চেয়ে এগিয়ে। কিন্তু অন্য দেশগুলোও যেহেতু ধাতু দুটি উৎপাদন করতে পারে; সেক্ষেত্রে চীনের এ নিষেধাজ্ঞার ফলে ঐ দেশগুলো চাহিদার বিকল্প উৎসের যোগান দিতে পারে বলে মনে করছে বহু বিশেষজ্ঞ।
রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞার ফলে চীনের বাজারে ইতিমধ্যেই নেতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে। ক্রমাগত কমছে ধাতুর দাম। সাংহাই মেটাল মার্কেটের হিসেব মতে, গতকাল (বৃহস্পতিবার) চীনে গ্যালিয়ামের স্পট প্রাইজ ছিল প্রতি মেট্রিক টনে ২৬০ মার্কিন ডলার। যা গত জুলাই মাসের দামের তুলনায় শতকরা ২০ ভাগ কম।
তবে জার্মেনিয়ামের স্পট প্রাইজ গতকাল (বৃহস্পতিবার) খানিকটা বৃদ্ধি পেয়ে প্রতি মেট্রিক টনে ১,৩৭৬ মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। কেননা দেশটির স্থানীয় বাজারেও বিরল এ ধাতুটির সরবারাহ কিছুটা কমেছে।
ঘটনার শুরু মূলত কয়েক মাস পূর্বে চীনের ওপর উন্নত চিপ রপ্তানিতে নতুন করে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা প্রদানের মাধ্যমে। তারই পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে গত জুলাই মাসে চীন ধাতু দুটি রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে জানায়, আগামী ১ আগস্ট থেকে ধাতু দুটি রপ্তানি করতে সরকার কর্তৃক বিশেষ অনুমতি গ্রহণের দরকার হবে।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে মার্কিন এআই চিপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এনভিডিয়ার পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, মার্কিন সরকারের কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠানটিকে চীনে এআই চিপ রপ্তানি বন্ধের কথা বলেছে। সর্বোপরি এর পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে চীন এমন উদ্যোগ নিয়েছে বলে প্রযুক্তি বিশ্লেষকদের পক্ষ থেকে ধারণা করা হচ্ছে।
গ্যালিয়াম খুবই বিরল একটি ধাতু। এমনকি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন কর্তৃক এটিকে 'সংকটাপন্ন কাঁচামাল' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
কম্পিউটার চিপ থেকে শুরু করে নাইট ভিশন, স্যাটেলাইট ইমেজারি সেন্সরের মতোন সামরিক বাহিনীর অনেক সরঞ্জাম তৈরিতে দরকার হয় জার্মেনিয়াম। অন্যদিকে, রাডার, রেডিও যোগাযোগ উপকরণ, স্যাটেলাইট ও এলইডি প্রস্তুতে অপরিহার্য উপাদান গ্যালিয়াম। বৈদ্যুতিক গাড়ি ও ফাইবার অপটিক কেবল তৈরিতেও ধাতু দুটি ব্যবহৃত হয়।
সম্প্রতি চীন ও যুক্তরাষ্ট্র; বিশ্বের এই দুই পরাশক্তি অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক নানা কারণেই একে অপরের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে। দুই দেশের মধ্যকার দ্বন্দ্বও বেশ স্পষ্ট। তারই ফলশ্রুতিতে দেশ দুটি সেমিকন্ডাক্টরসহ নানা প্রযুক্তিগত খাতে একে অপরের ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে চিপ এবং অন্যান্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা বেশ কয়েকটি চীনা কোম্পানিকে 'কালো তালিকাভুক্ত' করা হয়েছে। এক্ষেত্রে আমেরিকাও জাতীয় নিরাপত্তাকে কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন।
এমনকি যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের মিত্র দেশগুলোকে চীনা প্রযুক্তি শিল্পে নানা বিধি-নিষেধ আরোপের জন্য চাপ দিচ্ছে। তারই ফলশ্রুতিতে নেদারল্যান্ডস চলতি বছরের শেষের দিকে চীনের প্রতি নতুন রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা জানিয়েছে।
অন্যদিকে চীনের পক্ষ থেকে অভিযোগ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রযুক্তি শিল্পে আধিপত্য বজায় রাখতে চীনা উদ্ভাবনকে থামাতে চাইছে।