গদার, তারকোভস্কি, তোরনাতোরে যখন ধানমন্ডির আড্ডার মধ্যমণি ছিলেন
আশি এমনকি নব্বই দশকের ঢাকাও বেশি বড় ছিল না। বেইলি রোড, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ধানমন্ডি ছিল শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্রস্থল। এর মধ্যে বিকল্পধারার চলচ্চিত্রকর্মীদের যাতায়াত ছিল ধানমন্ডিতে বেশি। ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া আর ভারতের কালচারাল সেন্টারগুলো ছিল হাঁটা দুরত্বের মধ্যেই। তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব প্রজেকশন সিস্টেম আর অডিটোরিয়াম ছিল। নিজ নিজ দেশ থেকে তারা চলচ্চিত্র আনিয়ে নিত। আর সেগুলো দেখাত চলচ্চিত্র সংসদ মারফত। দেশের প্রথম চলচ্চিত্র সংসদ তৈরি হয়েছিল দেশ স্বাধীন হওয়ারও বেশ আগে। নাম ছিল পাকিস্তান চলচ্চিত্র সংসদ। ওয়াহিদুল হক ছিলেন প্রতিষ্ঠাতাদের একজন।
১৯৬১ সালে রবীন্দ্র্র জন্মশতবর্ষ উদযাপন তখন হয়ে উঠেছিল স্বাধিকার আন্দোলনের সমার্থক। চলচ্চিত্র গবেষক শামছুল আলম বাবু প্রসঙ্গটি তুলে ধরে বলেন, 'চলচ্চিত্র সংসদ প্রতিষ্ঠাও ছিল তারই ধারাবাহিকতা। বস্তুত পশ্চিমা শাসকদের চাপিয়ে দেওয়া সংস্কৃতির একটি সমান্তরাল ধারা তৈরি হচ্ছিল পূ্র্ব পাকিস্তানে। তখন দূতাবাসগুলো ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে আর পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় ছিল কয়েকটি দেশের কনস্যুলেট। কনস্যুলেটগুলোর কালচারাল উইং ছিল। ইউনাইটেড স্টেটস ইনফরমেশন সার্ভিস ( ইউএসআইএস) ঢাকায় বেশ সক্রিয় ছিল সেসময়। রাশিয়ান কালচারাল সেন্টারও নিজেদের আদর্শের সঙ্গে মেলে এমন ছবির দর্শক পেতে চাইত। সেকালে তাদের যুদ্ধবিরোধী, ফ্যাসিবাদবিরোধী ছবি যেমন দ্য ক্রেইনস আর ফ্লাইং, ব্যালাড অব আ সোলজার, নুরেমবার্গ ট্রায়াল দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিল।
'পূর্ব পাকিস্তানে তখন আইয়ুববিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধছে। স্বায়ত্ত্বশাসনের পক্ষে জনমত তৈরি হচ্ছে। শিল্পধর্মী ছবিগুলো সে চেতনাকে এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখছিল। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় ছবির প্রদর্শন নিষিদ্ধ হয়। অল্পস্বল্প যা প্রদর্শিত হতো তা ওই চলচ্চিত্র সংসদের মাধ্যমেই। অথচ ভারতীয় ছবি দেখার আগ্রহ দর্শকদের ব্যাপকভাবেই ছিল। তাই চলচ্চিত্র সংসদের সদস্যসংখ্যা দিন দিন বাড়ছিল। এ প্রসঙ্গে মুহম্মদ খসরুর ভূমিকার কথা উল্লেখযোগ্য। চলচ্চিত্র ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান। ছবি দেখতে ও দেখাতে তিনি পছন্দ করতেন। শুধু তা-ই নয়, ছবির নান্দনিক বৈশিষ্ট্য দর্শকদের বুঝতে সাহায্য করতেন। এর ফলে ছবি শুধু কাহিনী দেখার মাধ্যম থাকত না বরং হয়ে উঠত অনুভবের উপায়।
'মুহম্মদ খসরুকে বলা হয় বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আন্দোলনের পথিকৃৎ। এ কথার প্রতিধ্বনি শুনতে পাই পরিচালক তারেক মাসুদের ভাষায়: আমরা মুহম্মদ খসরুর ওভারকোটের বিভিন্ন পকেট থেকে বেরিয়েছি। খসরুর সম্পাদনায় চলচ্চিত্র পত্রিকা ধ্রুপদী প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৮ সালে। বাংলা ভাষায় এর চেয়ে ভালো চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকা আর হয়নি বলে মনে করেন সুধীজন। সে আমলে হলিউড আর ভারতের ছবির বাইরে কোনো চলচ্চিত্রের অস্তিত্ব আছে, অধিকাংশ মানুষই জানত না। মুহম্মদ খসরু দেখালেন লাতিন আমেরিকা, পূর্ব ইউরোপ, আফ্রিকার ছবি। থার্ড ওয়ার্ল্ডের ছবির ব্যাপারে তার আগ্রহ ছিল বেশি।'
এফডিসিতেও চলচ্চিত্র সংসদ গঠিত হয়েছিল
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাহাত্তর সাল থেকেই নতুন নতুন চলচ্চিত্র সংসদ গড়ে উঠতে থাকল। সদ্য স্বাধীন দেশ তখন, দেশপ্রেমে উদ্দীপিত সবাই। চলচ্চিত্রপ্রেমীরাও তার বাইরে থাকলেন না। সে আমলে ৩৫ মিমি প্র্রক্ষেপণ যন্ত্র দিয়েই কেবল ছবি দেখানো যেত। এতে সর্বত্র প্রদর্শনের সুযোগ যেমন ছিল না, তার চেয়েও বড় সমস্যা ছিল দূতাবাস মারফত আসা ছবির প্রিন্ট বেশিদিন থাকতও না। তাই সংসদগুলোর মধ্যে তাড়াহুড়া পড়ে যেত কার আগে কে প্রদর্শনীর আয়োজন করতে পারে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে পাকিস্তান ফিল্ম সোসাইটি নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ ফিল্ম সোসাইটি হয় এবং তাদের কাজের পরিসর বৃদ্ধি পায়। তারা প্রত্যেক প্রদর্শনীর আগে ছবিটি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্যসংবলিত কাগজ দর্শকদের মধ্যে বিলি করত। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে উল্লেখযোগ্য প্রায় সব দেশের দূতাবাস প্রতিষ্ঠিত হলো। ফলে ছবিপ্রাপ্তি সহজ হলো, ছবির সংখ্যাও বাড়ল।
শামছুল আলম বাবু বলেন, 'চলচ্চিত্র সংসদ কর্মীরা জাতীয় পর্যায়ে তিনটি বড় কাজে সফল হওয়ার কৃতিত্ব নিতে পারেন। এক, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ প্রতিষ্ঠা; দুই, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রবর্তন; তিন, চলচ্চিত্রে অনুদান। এগুলোর জন্য নিয়মিতই বাদল রহমান, মুহম্মদ খসরু প্রমুখ নামী ব্যক্তিরা সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতেন এবং ফলশ্রুতিতে উপরোক্ত তিনটিতেই সাফল্য পাওয়া যায়। মুহম্মদ খসরুকে আর্কাইভের কিউরেটর করার দাবিও তোলা হয়েছিল কিন্তু সরকারি পাকেচক্রে বিষয়টির বাস্তবায়ন ঘটেনি। অথচ তিনিই যে এর সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত মানুষ ছিলেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।'
সত্তরের দশকের শেষ দিকে সারাদেশে প্রায় একশটি চলচ্চিত্র সংসদ গড়ে উঠেছিল। সেগুলোর মধ্যে কয়েকটির নাম করা যায় — উত্তরণ ফিল্ম সোসাইটি, ঢাকা সিনে সার্কেল, অনুষ্টুপ ফিল্ম সোসাইটি, সিনেপল ফিল্ম সোসাইটি, সিনে আর্ট সার্কেল, সিনে সেন্ট্রাল বাংলাদেশ, ক্যাটওয়া ফিল্ম সোসাইটি, ইমেজ ফিল্ম সোসাইটি, সাইট অ্যান্ড সাউন্ড ইত্যাদি। মূলধারার চলচ্চিত্র কর্মীরাও চলচ্চিত্র সংসদ গড়ে তুলেছিলেন, সেটা অবশ্য আশির দশকের গোড়ায়। এর নাম ছিল সিনেমা অ্যাসিস্ট্যান্টস অ্যান্ড টেকনিশিয়ানস সোসাইটি। তারা এফডিসিতেই প্রদর্শনীর আয়োজন করতেন আর অংশগ্রহণকারী ছিলেন মূলত এফডিসির কলাকুশলীরা। এ সংগঠনে রূপবান-এর পরিচালক সালাউদ্দিন, বড় ভালো লোক ছিল'র পরিচালক মহিউদ্দিনের মতো ব্যক্তিরা যুক্ত ছিলেন। তারাও অন্য সংগঠনগুলোর মতো দূতাবাস থেকে ছবি এনে প্রদর্শন করতেন।
সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার পর
শামছুল আলম বাবু প্রথম চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনে যুক্ত হন ১৯৮৯ সালে। এফডিসিতে তার যাতায়াত শুরু হয়েছিল তারও আগে থেকে। আলোকচিত্র গ্রহণে তার আগ্রহ ছিল। টিএসসিতে ইয়ার আহমেদ পিয়ারুর একটি স্টুডিও ছিল (এখনো আছে), তিনি একটি ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সের আয়োজন করেছিলেন। সে কোর্সে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সঙ্গে বাবু যুক্ত হন। তখন ধানমন্ডিতে জার্মান কালচারাল সেন্টার ছিল ভারতীয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পাশেই। ভারতীয় ছবি বিশেষ করে বাংলা ছবি দেখতেই ভিড় হতো বেশি। কোনো কোনো সময় এমনও হয়েছে সিঁড়িতে, মেঝেতে বসে দর্শকেরা ছবি দেখেছেন।
বিরানব্বই সালের ২৩ এপ্রিল, মানে যেদিন সত্যজিৎ রায় মারা গেলেন, সেদিন কোনো একটা ছবির প্রদর্শনী চলছিল ভারতীয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে। বাবুও ছিলেন দর্শকসারিতে। মোরশেদুল ইসলাম প্রদর্শনীর মাঝখানে কোনো কাজে মিলনায়তনের বাইরে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রদর্শন স্থগিত করতে বললেন। তারপর বললেন, 'একটা দুঃসংবাদ পেলাম এমাত্র, সত্যজিৎ রায় মারা গেছেন।'
বাবু বলছিলেন, 'আশির দশকের মধ্যভাগ থেকে নব্বইয়ের দশকের মধ্যভাগ ছিল চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের তুঙ্গ সময়। তখন জার্মান, ফ্রান্স বা ভারতীয় যে কেন্দ্রেই যেতাম, দেখা হয়ে যেত চলচ্চিত্রপ্রেমীদের সঙ্গে — বিশেষ করে যারা বিকল্পধারার চলচ্চিত্র নিয়ে আগ্রহী ছিলেন। সংসদগুলো কেবল ছবি দেখাত না, কর্মশালা ও পাঠচক্রের আয়োজনও করত। এসবে যারা যোগ দিতেন, তাদের বন্ধু হয়ে যেতে সময় বেশি লাগত না। চায়ের কাপে তুফান তুলে আমরা গদার, ত্রুফোর ছবি নিয়ে আলাপ করতাম। কার ফ্রেমিং ভালো, কার গল্প বলার ঢং অন্য কারোর সঙ্গে মেলে না ইত্যাদি ছিল আড্ডার আলোচনার বিষয়। জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের প্রজেক্টর অপারেটর আদনান আমাদের সবারই আপনজন হয়ে গিয়েছিলেন। তখন অডিটরিয়ামগুলোয় গানের বা কবিতা পাঠের আসরের চেয়ে চলচ্চিত্র প্রদর্শনীই হতো বেশি। ওই সময়ে সারাদেশে কম করেও দেড় থেকে দুশো চলচ্চিত্র সংসদ ছিল। কোনো কোনো সংসদের জেলাওয়ারি শাখাও ছিল।
'নব্বই সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়া কিন্তু একটা বড় পরিবর্তনের সূচনা করেছিল। রাশিয়ান কালচারাল সেন্টারের নিজস্ব আর্কাইভ ছিল। তারা যে ছবি নিয়ে আসত সেগুলো ফেরত পাঠাত না, তাই বারবার প্রদর্শনের সুযোগ পাওয়া যেত। তাদের ছবিগুলো আমাদের মন ছুঁয়ে যেত। দ্য ক্রেইনস আর ফ্লাইং দশবার দেখেছেন এমন অনেকেই ছিলেন। তারকোভস্কির আন্দ্রেই রুবলভ দেখে আমার নিজেরই ঘোর কাটাতে অনেক সময় লেগেছে। সে আমলে যারা চলচ্চিত্র নিয়ে ভাবত বা চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বপ্ন দেখত, তাদের কাছে তারকোভস্কি ছিলেন আদর্শ। তারকোভস্কির ছবি কবিতার মতো; তা-তে ইতিহাস, দর্শন, সমাজ-সাহিত্য, রাজনীতি, যুদ্ধ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। সাধারণ দর্শক হয়তো কিছুটা বিপাকে পড়তেন কিন্তু নির্মাণে উৎসাহী যারা তারা পড়া মুখস্থ করার মতো তারকোভস্কি পড়তেন।'
তোরনাতোরে অনেককে কাঁদিয়েছেন
আমাদের এখানে ইতালির সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিল না, তবে অন্য কেন্দ্রগুলোয় ইতালিয়ান সিনেমা দেখানোর বাধা ছিল না। ওদের ছবিগুলো আবেগঘন হয় যা বাঙালির আবেগের কাছাকাছি। তাই ছবিগুলো দর্শকদের কাছে টানত চুম্বকের মতো। সিনেমা প্যারাদিসোকে এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে টানা যায়। গুইসেপ্পে তোরনাতোরের এ ছবিটি যে কতজনকে কাঁদিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
ইরানি চলচ্চিত্রের কথাও আসে একই সূত্রে। মোহসেন মাখ্মলবফ বা মাজিদ মাজিদির ছবিগুলো দারিদ্র্যের যে গাঁথা তৈরি করে তা দর্শককে না কাঁদিয়ে ছাড়ে না। আব্বাস কিয়ারোস্তামি অবশ্য খানিক ব্যতিক্রম, তিনি জীবনকে ভালোবাসার কথা বলেন, তা জীবনে যতই ঝড় আসুক। ঢাকা ধারাবাহিকভাবে চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজনকারী রেইনবো চলচ্চিত্র সংসদ নতুন নতুন ইরানি চলচ্চিত্র প্রদর্শনে অন্য সংসদগুলোর চেয়ে এগিয়ে ছিল — এখনো আছে।
সোভিয়েত চলচ্চিত্রের কথা বলা শেষ হয়নি আগের অংশে। ব্যালাড অব আ সোলজার একাই হয়ে উঠেছিল একশ পশ্চিমা চলচ্চিত্রের প্রতিপক্ষ। বাবু তাই বলছিলেন, 'সোভিয়েত এজেন্ডা ফুরিয়ে যেতে থাকল যখন অন্য দেশগুলোও তাদের আগ্রহের ধরন বদলালো। সাংস্কৃতিক লড়াইয়ে ইস্তফা দিল তারা, তাদের মনোযোগ নিবিড় হলো বাণিজ্যে বা সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে। দূতাবাসগুলো নিজেদের দেশ থেকে ছবি আনা কমিয়ে দিলো। এর প্রতিক্রিয়ায় সংসদগুলোর কার্যক্রমে ভাটা পড়তে থাকল। তবে ব্যতিক্রম ছিল জহির রায়হান চলচ্চিত্র সংসদ।
'আগের চেয়েও অধিক সক্রিয় হয়ে উঠল সংগঠনটি। প্রধান কারণ এর সংগঠক সাব্বির চৌধুরীর ভান্ডারে প্রচুর বিদেশি ছবি জমা পড়ছিল। লন্ডন বা অন্য বড় শহরে থাকা তার বন্ধুরা ছবি পাঠাতেন চাহিদামতো। ফলে বৈচিত্র্যপূর্ণ ও নতুন ধারার সব ছবির প্রদর্শনী করতে থাকল জহির রায়হান চলচ্চিত্র সংসদ। প্রযুক্তির পরিবর্তনও এক্ষেত্রে ভালো অবদান রাখল। ৩৫ বা ১৬ এমএম রিলের পরিবর্তে ক্যাসেটেই ছবি বহন করা যেত। প্রক্ষেপণ যন্ত্রও অনেক ছোট হয়ে এলো। এ সঙ্গে চলচ্চিত্রম-এর কথাও বলতে হয় — প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম যার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তারা ধারাবাহিক প্রদর্শনী বজায় রেখেছিল প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই। নিয়মিত কর্মশালাও আয়োজন করত আর চলচ্চিত্রে অবদান রাখার স্বীকৃতি স্বরূপ সম্মাননাও প্রদান করেছিল।'
বাবু যোগ করেন, '২০০০ সালের পর সময়ের কারণেই চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনে ভাটা তৈরি হয়। প্রযুক্তির দ্রুত প্রসারের ফলাফলে চলচ্চিত্র এখন সবার পকেটে পকেটে। এতে যে ক্ষতিটা হলো তা নতুন প্রজন্ম সম্ভবত আঁচ করতে পারবে না। ধরা যাক টাইটানিক ছবির কথাই। এটা তৈরি করা হয়েছে ৬০ বা ১২০ ফুট পর্দায় দেখানোর জন্য। এ ছবির একটা ফ্রেমেই অনেকগুলো ঘটনা ঘটে চলে। মোবাইল বা কম্পিউটারের পর্দায় সেগুলোর সবটা খেয়াল করা সম্ভবপর নয়, এভাবে কেবল কাহিনীটা বোঝা যায় কিন্তু ছবি দেখা দূরের ব্যাপারই রয়ে যায়।
'চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন আসলে একটা সময়কে খুব প্রাণচঞ্চল করে তুলেছিল। নগরের মধ্যবিত্ত এমনকি নিম্ন-মধ্যবিত্তের অগ্রসর অংশের জন্য ব্রেসোঁ, ত্রুফো, গদার, কুরোসাওয়া, কিয়ারোস্তামি, উসমান সেমবেন, তোরনাতোরে, কিসলভস্কি বা বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত অনন্য, অসাধারণ সৌন্দর্য নিয়ে হাজির হতেন। আজ সেই দিনগুলো ফিকে হয়ে যাচ্ছে।'
আলমগীর কবিরের প্রস্থান
তারেক আহমেদ নিকটজনদের মধ্যে বুলবুল নামে বেশি পরিচিত। আশির দশকের মাঝামাঝিতে তার ধারাবাহিক লেখাপড়ায় ছেদ পড়ে। একদিন তার ছোট ভাই জানালেন, একটা ফিল্ম অ্যাপ্রিয়েশন কোর্স হবে, তুমি যোগ দিতে পারো। চুরাশি সালের শেষ দিক সেটা। অর্গান্টা ফিল্ম সোসাইটি ছিল সে কোর্সের আয়োজক। কোর্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছিল ব্রিটিশ কাউন্সিল মিলনায়তনে। আমন্ত্রিত ছিলেন আলমগীর কবির যার সূর্যকন্যা বুলবুল দেখেছিলেন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময়। তিনি মঞ্চে উঠলে অপলক তাকিয়ে দেখলেন, মুগ্ধ হয়ে শুনলেন তার কথা।
অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন আলমগীর কবির। চলচ্চিত্র বোঝাতে গিয়ে নানাদিকে বিচরণ করতেন — পদার্থবিদ্যা থেকে নন্দনতত্ত্ব কোনোটাই তার আলোচনার বাইরে থাকত না। মানুষটি বুলবুলকে বেঁধে ফেললেন। সেকালে মোরশেদুল ইসলামের আগামী এবং তানভীর মোকাম্মেলের হুলিয়া চলচ্চিত্রদুটি প্রায় সকল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের অংশ হয়ে গিয়েছিল। বিকল্পধারা চলচ্চিত্র আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য ফসল ওই ছবি দুটি। মূলধারা চলচ্চিত্রের দৌরাত্ম্য থেকে বাঁচতে তখন সংসদকর্মীরা ছবি নির্মাণ ও দেশব্যাপী প্রদর্শনের উদ্যোগী হয়েছিলেন নিজেরাই।
১৯৭৬ সালে চলচ্চিত্রে অনুদান প্রথা চালু হলে প্রথম যে ছবিকে অনুদান দেওয়া হয় সেটি হলো মসিহউদ্দিন শাকের ও শেখ নিয়ামত আলী পরিচালিত সূর্য দীঘল বাড়ী। মুক্তি পাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সৃজনশীল চলচ্চিত্রের এক উজ্জ্বল নজির স্থাপন করে ছবিটি। বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক পুরস্কারও লাভ করে। অথচ নাটোরের একটি সিনেমা হল ছাড়া আর কোথাও ছবিটি প্রদর্শিত হয়নি। হলগুলোতে ছবিটির প্রদর্শন বাধাগ্রস্ত করা হয় নানা কৌশলে। তারেক বুলবুল মনে করেন, মূলধারার প্রযোজক, ডিস্ট্রিবিউটর ও হলমালিক মিলে চলচ্চিত্রের সিন্ডিকেট ততদিনে সক্রিয় হয়ে গিয়েছিল। শিল্পধর্মী ছবি নির্মাণ ও প্রদর্শনকে সিন্ডিকেটটি পছন্দ করছিল না। তাই বিকল্প বিপণন ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা সংশ্লিষ্ট সকলেই উপলব্ধি করেছিলেন। আগামী ও হুলিয়া এ প্রক্রিয়ায় বাণিজ্যিকভাবেও সফলতা লাভ করেছিল।
১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরাম প্রতিষ্ঠা লাভ করে। শিল্পধর্মী ছবি বোঝা ও প্রদর্শনের দরজা উন্মুক্ত করেছিল এ সংগঠনটিও। মোটা দাগে বলা যায়, কর্মীদের সংগঠন হলো চলচ্চিত্র সংসদ আর নির্মাতাদের সংগঠন শর্ট ফিল্ম ফোরাম। ১৯৮৭ সালে ফোরাম একটি চলচ্চিত্র বিষয়ক ফাউন্ডেশন কোর্সের আয়োজন করে। বুলবুল তাতে অংশ নিয়ে অনেক বন্ধু পেয়ে গেলেন, যেমন তারেক শাহরিয়ার, শাকিল হান্নান, দিলদার হোসেন, সামিয়া জামান প্রমুখ। এর মধ্যে ১৯৮৯ সালে আলমগীর কবিরের অকস্মাৎ মৃত্যু চলচ্চিত্র কর্মীদের দারুণভাবে ব্যথিত করে। জহির রায়হানের অন্তর্ধানের পর আলমগীর কবিরকে ঘিরেই চলচ্চিত্রের বিকল্পধারাটি সজীব ও সতেজ ছিল। ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ-এর সভাপতি ছিলেন তিনি। ১৯৬৯ সালে সাংবাদিক লায়লা সামাদের সঙ্গে যৌথভাবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ঢাকা সিনে ক্লাব।
খসরু ভাই ছিলেন সূর্যের মতো
১৯৮৮ সালে ফোরাম আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য ও স্বাধীন চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করে যা ছিল উপমহাদেশে প্রথম। এ উৎসব বিকল্পধারাকে শক্ত অবস্থানে নিয়ে যায়, দর্শক, নির্মাতা, কর্তৃপক্ষ সবাইকেই শিল্পধর্মী ছবি সম্পর্কে সজাগ করে তোলে। বুলবুল ও তার বন্ধুরা শর্ট ফিল্ম ফোরামের সদস্য হন ১৯৯১ সালে। বুলবুল বলেন, 'ফোরামের বস্তুত কালেক্টিভ বার্গেনিং এজেন্ট হওয়ার কথা ছিল। ফিল্ম সেন্সর নীতিমালা আধুনিকীকরণ, ফিল্ম সেন্টার প্রতিষ্ঠা এবং বিকল্প বিপণন ব্যবস্থা তৈরিতে অবদান রাখতে পারত ফোরাম। কিন্তু ফোরাম নিজে থেকেই তার এজেন্ডাগুলো থেকে পিছিয়ে পড়ে।
'আমি একটা সময়ে তানভীর মোকাম্মেলের প্রেরণায় ঋত্বিক চলচ্চিত্র সংসদে সময় দিতে থাকি বেশি। সংগঠনটির কার্যালয় ছিল উদীচী অফিসে। প্রায় সন্ধ্যাতেই আমরা সংসদের কর্মীরা জড়ো হয়ে চলচ্চিত্র বিষয়ক আড্ডা দিতাম, নয়তো আমন্ত্রণপত্রের খামে নাম লিখতাম। বিলি করতেও বের হতাম সময় সময়। দিনের বেলার অনেকটা সময় কাটাতাম খসরু ভাইয়ের (মুহম্মদ খসরু) অফিসে। তিনি ছিলেন বিসিকের আলোকচিত্রী। তার সব কথার বিষয় ছিল একটাই, সেটা হলো চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্র বিষয়ক বই, সাময়িকী, উৎসব স্মরণিকা তিনি সংগ্রহ করতেন, পড়তেন আর সুযোগ পেলেই সেগুলো সম্পর্কে বলতেন।
'আমি সাহচর্য পেয়েছি তারেক মাসুদেরও। চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানকে নিয়ে আদম সুরত প্রামাণ্যচিত্রটি তৈরি করতে তিনি সময় দিয়েছেন সাত বছর। এত সময় ধরে ধৈর্য রাখা আমাদের এখানকার চলচ্চিত্রকারদের জন্য বিরল ঘটনা। এর অনেকটাই অবশ্য টাকার জন্য। মুক্তির গান-এর ক্ষেত্রেও তিনি বিরাট আর্থিক সংকটে ভুগেছেন। আমেরিকায় ক্যাথরিন তখন সবটা গুছিয়ে এনেছেন অথচ টাকার জন্য প্রিন্ট নিতে পারছেন না। তারেক ভাইয়ের কাছে ব্যাপারটি ছিল জুয়ার খেলার মতো। শ্যাওড়াপাড়ায় তার একটি জমি ছিল। সেটি তিনি বিক্রি করে দিয়েছিলেন মুক্তির গান-এর অর্থ যোগান দিতে গিয়ে। তারেক ভাই ভালো সংগঠকও ছিলেন। মুক্তির গান-এর প্রদর্শনীর জন্য যেন অন্যের ওপর নির্ভর না করতে হয় তাই প্রজেক্টর, স্ক্রিন সব কিনেছিলেন। উদ্যমী কয়েকজন তরুণ তখন ছবিটি সারাদেশেই দেখিয়ে বেড়িয়েছে। বিকল্পধারার জন্য এটি ভালো নজির তৈরি করেছিল।'
চলচ্চিত্র সংসদগুলো এবং শর্ট ফিল্ম ফোরাম বাংলাদেশের সংস্কৃতি জগতকে আন্দোলিত করেছিল সন্দেহ নেই। বর্হিবিশ্বের সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক যোগাযোগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমও হয়ে উঠেছিল এটি। কিন্তু সামগ্রিকভাবে সমাজ মনন বা রুচিশীল সাংস্কৃতিক আবহ তৈরিতে সফল হয়েছে কতটা? তারেক আহমেদের বলেন, 'নব্বইয়ের দশকের শেষ দিক থেকে আমাদের মূলধারার চলচ্চিত্রেও ধস নামে। বিকল্পধারার নতুন নির্মাতারা পরিকল্পনা যখন গুছিয়ে আনছিলেন, তখনই প্রযুক্তি সমাজের রুচি ও অভ্যাস আমূল বদলে দিলো। বিকল্প বা সমান্তরাল কিছু গড়ে তোলার যে পশ্চাৎপট ছিল তা যেন উবে গেল হঠাৎই। তবু আমি বলব, বিশেষ করে ডকল্যাবের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, নতুনদের মধ্যে অনেক অন্যরকম ভাবনা রয়েছে যেগুলো শুনে বা যার প্রকাশ দেখে চমকে যেতে হয়। আমার প্রত্যয় আছে, আমাদের জন্য ভালো আগামী অপেক্ষমাণ।'