সৈয়দপুরের কিচেনওয়্যারের বাজার গড়ে উঠছে বিদেশের মাটিতে
১৯৭৮ সালের কথা। অ্যালুমিনিয়ামের পণ্যের রমরমা বাজার। তৈরি হতো বগুড়ায়। আশেপাশের জেলায় তখন ছড়িয়ে পড়েছে ব্যবসা। নীলফামারীর সৈয়দপুরে তখনও অ্যালুমিনিয়ামের কারখানা ছিল না। কিন্তু চাহিদা ছিল বেশ। এ কারণে সৈয়দপুরে নোয়াহ্ গ্রুপের রয়েল রিল্যাক্স মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ নামে গড়ে তোলা হয় অ্যালুমিনিয়ামের কারখানা।
রূপান্তরের শুরু ২০০৪ সালে। অ্যালুমিনিয়াম শিল্পের সাথে যোগ হয় স্টিলের তৈজসপত্র। প্রেশার কুকার তৈরির শুরুও তখনই। এখন রাইস কুকার, গ্যাস চুলা, কেটলি, ব্লেন্ডার, ইন্ডাকশন চুলা, ননস্টিক ফ্রাইপ্যান প্রভৃতি নানা পণ্য তৈরির ভরসার প্রতিষ্ঠান এটি।
৪৫ বছর আগে শুরু করা এই প্রতিষ্ঠানের বাজার এখন শুধু উত্তরে নয়, ছড়িয়েছে বিশ্ব দরবারে। 'মেড ইন বাংলাদেশ' লেখা ২২ হাজার ডলারের পণ্য চলতি মাসেই ভুটানে যাবে। এই প্রতিষ্ঠানে তৈরি পণ্য ভারত, ভুটান, নেপালে যায়।
'মঙ্গাকে করেছি জয়, নোয়াহ্ করবে এবার বিশ্বজয়' স্লোগানকে সামনে নিয়ে তৈরি করা হচ্ছে কিচেন পণ্য, হাঁড়ি-পাতিল, জগ, ননস্টিক ফ্রাইপ্যান, কড়াই, তাওয়া সহ রকমারি সব আইটেম।
নথিতে নোয়াহ্ গ্রুপের রয়েল রিল্যাক্স মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক পূজা দেবী পোদ্দার। পরিচালক পদে রয়েছেন রাজু পোদ্দার ও গোকুল কুমার পোদ্দার।
সৈয়দপুর-রংপুর মহাসড়কের পাশে নীলফামারি কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালের সাথে লাগোয়া নোয়াহ গ্রুপের রয়েল রিল্যাক্স মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ। ১৯৭৮ সালে প্রায় সাড়ে ৩ একর জমিতে গড়ে তোলা কারখানাটি।
প্রথমে শুধুমাত্র অ্যালুমিনিয়াম পণ্য সামগ্রী তৈরি হতো। এখানে উৎপাদিত পণ্য কারখানা প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মধ্যে গোটা উত্তরাঞ্চলের বাজার দখলে নেয়।
বগুড়া থেকে এসে সৈয়দপুরে কারখানা
রাজু পোদ্দারের জন্ম বগুড়ার দুপচাঁচিয়ার তালোড়া উপজেলায়। তালোড়ার সাথে রেল ও নদীপথে যোগাযোগ সুবিধার কারণে ১৯৫৪ সালে এখানে প্রথম অ্যালুমিনিয়াম শিল্প গড়ে ওঠে। এরপর একে একে প্রায় ১৫টি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। তার মধ্যে রাজু পোদ্দারদের কারখানাও ছিল। রাজুর এক বোনের বিয়ে হয় সৈয়দপুরে। রেল, সড়কপথে যোগাযোগ ভালো হওয়ার কারণে সৈয়দপুর শুরু থেকেই ব্যবসাবান্ধব এলাকা। সত্তরের দশকে সেখানে রাজুর পরিবারের লোকজন গিয়ে বুঝতে পারেন অ্যালুমিনিয়ামের পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বিষয়টি বিবেচনায় সৈয়দপুর বাস টার্মিনালের পাশে গড়ে তোলা হয় অ্যালুমিনিয়াম কারখানা।
রয়েল রিল্যাক্স মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক রাজু পোদ্দার জানান, এই কারখানায় শুরুতে বিদেশি টেকনিশিয়ান নিয়ে আসা হয়। তারা কারখানায় যন্ত্রপাতির ব্যবহার শিখিয়ে দেয়। এরপর এখানে আমাদের দেশীয় টেকনিশিয়ানরা দক্ষতার সাথে কারখানার যন্ত্রপাতি পরিচালনা করে আসছেন।
রয়েল রিল্যাক্স মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ সূত্রে জানা যায়, এখানে অ্যালুমিনিয়ামের প্রেসার কুকার, নন-স্টিকের তৈজসপত্র, স্টিলের বাসনপত্র, ইলেকট্রিক রাইস কুকার, গ্যাস চুলা, ব্লেন্ডারসহ আরও অনেক আন্তর্জাতিক মানের পণ্য তৈরি হয়। এর মধ্যে প্রেসার কুকার, নন-স্টিকের তৈজসপত্র তৈরির কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। অ্যালুমিনিয়াম সার্কেল, পিটিএফআই কোটিং, ফিটিংস সামগ্রী, পলিশিং মেটেরিয়াল, পলিশিং বাফ, এসএস সার্কেল, এসএস ফিটিংস ও ইলেকট্রিক রাইস কুকারের পার্টস, এএস সার্কেল আমদানি করা হয় ভারত, চীন ও মালয়েশিয়া থেকে। এসব কাঁচামাল থেকে বিশেষ পদ্ধতিতে ব্যবহার্য পণ্য উৎপাদন হচ্ছে।
ভৌগোলিক কারণে সৈয়দপুর খুব গুরুত্বপূর্ণ। রংপুর ও দিনাজপুরের মধ্যবর্তী স্থান, সৈয়দপুরে কারখানাটি অবস্থান। এই কারখানায় কাজ করেন প্রায় সাড়ে ৩০০ শ্রমিক। তাদের মধ্যে ৪০% নারী। আছেন ৫-৭ জন শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিও।
তাদের মধ্যে একজন পুতুল রানী। আগে দর্জির কাজ করতেন। এখন কারখানায় শ্রমিকের কাজ করছেন। সৈয়দপুরের পাশের এলাকা তারাগঞ্জের বাসিন্দা পুতুলের স্বামী প্রতাপ গার্মেন্টসে কাজ করেন। পায়ের সমস্যার কারণে পুতুল অন্য কাজ করতে পারেন না। পুতুল বলেন, "এখানে কাজের পরিবেশ ও টাকা পরিশোধের বিষয়ে কোনো ঝামেলা নেই। কাজ করে শান্তি পাওয়া যায়।"
কারখানায় আয়রন তৈরির কাজ করেন সৈয়দপুর শহরের বাসিন্দা মনিরা খাতুন। ১০ বছর ধরে রয়েল রিল্যাক্স মেটালে কাজ করা এই নারী জানান, "এখানে যত ইলেকট্রিক পণ্য তৈরি হয় তার সবগুলো কাজ করতে পারি। এখানে কাজ করে আয় দিয়েই সংসার চলে। এখানে সব দারুণ দারুণ পণ্য উৎপাদন করা হয়।"
বিদেশের বাজারে পণ্য
রয়েল রিল্যাক্স মেটালের পরিচালক রাজু পোদ্দার বলেন, "এই প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত বিশ্বমানের পণ্য রপ্তানি শুরু হয় ২০১০-২০১১ অর্থবছরে। ভারত ও ভুটানে তখন রপ্তানি করা হয়েছিল রাইস কুকার। ১০ থেকে ১৫ হাজার ডলারের অর্ডার পেয়েছিলাম। এখন বছরে গড়ে সাড়ে ৩ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তারি করা হয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। চলতি মাসেও ভুটানে রপ্তানি করা হবে।"
রাজু পোদ্দার জানান, আগে রাইস কুকার, প্রেসার কুকার, ব্লেন্ডার সহ একাধিক কিচেন আইটেমে দেশ শতভাগ আমদানি নির্ভর ছিল। এখন ১% আমদানি করতে হয়। দেশীয় কোম্পানিগুলো আমদানি নির্ভরতাকে প্রায় শূন্যের কোটায় নিয়ে আসছে। দেশে ১৫ থেকে ১৮টি প্রতিষ্ঠান বিশ্বমানের এসব পণ্য তৈরি করে। তাদের মধ্যে অনেকে ইউরোপেও রপ্তানি করে। এটি দেশের জন্য বড় অর্জন।
দেশের সম্মান বাড়ানোর উদ্দেশ্যে এই প্রতিষ্ঠান 'মেড ইন বাংলাদেশ' লেখা পণ্য রপ্তানি কর। বর্তমানে কোম্পানির মোট সক্ষমতার ২৫% পণ্য উৎপাদন করা হচ্ছে। সুযোগ আছে শতভাগ উৎপাদনের।
কিছু সংকট
অনগ্রসর এলাকায় ব্যবসা করে এগিয়ে চলা উদ্যোক্তা রাজু পোদ্দার আরও বলেন, "বড় সমস্যা বলতে গেলে দেশের ব্যবসায়ীদের কাস্টমস ও ভ্যাট অহেতুক হয়রানি করে। অথচ আমাদের মতো ছোট প্রতিষ্ঠান থেকে সরকারকে প্রতি বছর ১০ থেকে ১২ কোটি টাকা ভ্যাট দিই। ট্যাক্স দেওয়া হয় অন্তত আড়াই কোটি টাকা। অহেতুক হয়রানির কারণে অনেক ব্যবসায়ী তাদের কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।"
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, লোডশেডিং সহ নানা কারণে প্রতিযোগিতার বাজারে এখন টিকে থাকা দায়। তবে এর মধ্যে গ্যাসের পাইপলাইন নীলফামারি পর্যন্ত এসেছে। শিল্পকারখানায় গ্যাস সংযোগ দিলে দেশীয় উদ্যোক্তারা উপকৃত হবেন বলে জানান রাজু পোদ্দার।
রয়েল রিল্যাক্স মেটালকে এই অঞ্চলের জন্য 'আইকন' উল্লেখ করে নীলফামারি চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক আখতার হোসেন স্বপন বলেন, "এই অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যের আরও প্রসারে চিলাহাটিকে পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তাহলে ভারতের সাথে আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা বাড়বে। আর সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রূপ দিতে হবে। তাহলে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে সুবিধা হবে। একই সাথে শিল্পের জন্য গ্যাসলাইন খুব জরুরি। ইতোমধ্যে সৈয়দপুর পর্যন্ত গ্যাসলাইন আনা হয়েছে। এখন অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে শিল্প-কলকারখানায় গ্যাস সংযোগ দিতে হবে। তাহলে আশা করছি এটি অনেক বড় শিল্পাঞ্চলে পরিণত হবে। কর্মসংস্থান হবে হাজারও মানুষের।"