টানা বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত জনজীবন, অব্যাহত থাকবে রোববার পর্যন্ত
গত কয়েকদিন ধরে টানা বৃষ্টিতে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। চলাচলে প্রতিবন্ধকতাসহ যানজট ও জলাবদ্ধতায় ভুগছে হাজারো মানুষ।
তবে এরইমধ্যে আবহাওয়া অফিস থেকে মিলেছে কিছুটা স্বস্তির সংবাদ। শুক্রবার (৬ অক্টোবর) সন্ধ্যায় নামিয়ে ফেলা হয়েছে দেশের উপকূলীয় এলাকার সতর্কতা সংকেত। শনিবারে (৭ অক্টোবর) ঢাকা, সিলেট, ময়মনসিংহ বিভাগে কিছুটা বেশি বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকলেও রোববার (৮ অক্টোবর) থেকে তা কমে আসবে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস।
আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "গত কয়েকদিন ধরে টানা বৃষ্টিকে বলা যায় এ বর্ষা মৌসুমের শেষ বৃষ্টি। প্রায় প্রতি বছরই অক্টোবর মাসের কিছুদিন এমন বৃষ্টিপাত হয়। শুক্রবার রাত থেকেই রংপুর, রাজশাহী বিভাগের বৃষ্টিপাত অনেকটা কমে যাবে। রোববার থেকে সারাদেশেই বৃষ্টিপাত কমতে শুরু করবে।"
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয় নিকলিতে। ২৪ ঘন্টায় নিকলিতে ৪৭৬ মিলি মিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এছাড়া দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ময়মনসিংহে ৩৪০ মিলিমিটার এবং তৃতীয় সর্বোচ্চ নেত্রকোনায় ৩১১ মিলি মিটার। অন্যদিকে, শুক্রবার সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত ২৪ ঘন্টায় ঢাকায় বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয় ৮০ মিলিমিটার।
তিন কারণে এবার বেশি বৃষ্টি
আবহাওয়াবিদদের মতে মূলত তিন কারণে বর্ষার শেষে এসে বৃষ্টি এত বেড়ে গেছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাবে, অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকে। তাই এ সময় পর্যন্ত বর্ষাকাল ধরা হয়।
কারণগুলোর মধ্যে, প্রথমত দেশের স্থলভাগে বর্তমানে দুটি স্থানে নিম্নচাপ একত্র হয়ে প্রচুর জলীয় বাষ্প ও বাতাস টেনে নিয়ে আসছে। দ্বিতীয়ত, বঙ্গোপসাগরে ভারত মহাসাগর দ্বিচক্র (আইওডি) সক্রিয় হয়ে উঠেছে এবং তৃতীয়ত, মৌসুমি বায়ু বিদায় নেওয়ার সময়ে বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠে বিপুল পরিমাণে মেঘ জড়ো করছে।
এই তিন কারণ সাধারণত বাংলাদেশের ভেতরে এ সময়ে একত্র হয় না। কিন্তু এবার বর্ষার শেষ সময়ে এসে তা একত্র হওয়ার কারণেই অল্প কিছুদিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত হচ্ছে।
আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ বলেন, "মৌসুমি বায়ুর বিদায়বেলায় সাধারণত বৃষ্টি বেড়ে যায়। এবার স্থলনিম্নচাপের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় বৃষ্টি বেড়ে গেছে। শুক্রবার দুপুর থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টি বেড়েছে।"
বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরে একই সময় দুটি নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়েছিল। নিম্নচাপ দুটি দ্রুত স্থলভাগে উঠে পড়ে। বৃহস্পতিবার নিম্নচাপটি ভারতের সিকিম হয়ে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল দিয়ে রাজশাহীতে ঢোকে। আর তাই বৃহস্পতিবার রাজশাহীতে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে। এটি আরও শক্তিশালী হয়ে ময়মনসিংহ হয়ে কিশোরগঞ্জ-ব্রাহ্মণবাড়িয়া দিয়ে সিলেটের দিকে এগোয়।
ঢাকায় জলাবদ্ধতা, যানজট
শুক্রবার ছুটির দিন থাকা সত্ত্বেও টানা বৃষ্টির কারণে ঢাকার বেশ কয়েকটি এলাকায় যানজট দেখা যায়। রাজধানীর ধানমন্ডি, কারওয়ানবাজার, মিরপুর-১০, শাহাবাগ, মহাখালীসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় যানজট দেখা গেছে।
এছাড়া গত তিনদিন ধরে টানা বৃষ্টিপাতের ফলে এবং শুক্রবার সন্ধ্যায় ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে রাজধানীর নিউ মার্কেট এলাকা, মিরপুর-১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, পুরান ঢাকার কিছু এলাকা, নটরডেম কলেজের সামনে, মিরপুর পাইকপাড়া, ওয়ারীসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে।
ইস্কাটন থেকে ধানমন্ডির আবাহনী মাঠে আসা সিএনজি অটোরিকশা চালক মোহাম্মদ আশরাফুল বলেন, শুক্রবার সাধারণত এই দূরত্ব অতিক্রম করতে ১৫ মিনিট সময় লাগে কিন্তু আজ সময় লেগেছে ৪৫ মিনিট। বৃষ্টি এবং অসহনীয় যানজটের কারণে এত বেশি সময় লেগেছে বলে জানান তিনি।
"আমি তিনবার রুট চেঞ্জ করেছি, ওলিগলি দিয়ে এসেও এত সময় সময় লেগেছে," বলেন তিনি।
ভারী বৃষ্টির সময় এমন অসহনীয় যানজট সৃষ্টির জন্য ট্রাফিক পুলিশকে দায়ী করেন এই সিএনজি চালক। তিনি বলেন, "প্রবল বৃষ্টির সময় ট্রাফিক অফিসাররা থাকেন না। আর এই সুযোগে চালকরাও ট্রাফিক আইন মানেন না; যানজটের অবস্থা আরও খারাপ হয়।"
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের সহকারী কমিশনার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, "আমি প্রায় তিন বছর ধরে ঢাকায় ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন করছি এবং একটি বিষয় দেখছি যে বৃষ্টি হলেই অধিকাংশ রাস্তায় পানি জমে যায়; এর ফলে যানজটও বেড়ে যায়।"
তিনি কারণ হিসেবে বলেন, "বৃষ্টি হলে অধিকাংশ পথচারীই কোনো না কোনো গাড়ি ব্যবহার করেন। তাই রাস্তায় চলে আসেন গাড়ি খুঁজতে। আবার কোথাও পানি জমলে সেখানে গর্ত আছে কিনা এ সন্দেহে ঐ অংশ এড়িয়ে চলে যানবাহন, ফলে রাস্তা সরু হয়ে যায়।"
"বৃষ্টি হলে রাস্তার গাড়ির গতিবেগও অনেকটা কমে যায়। এবং ভারী বৃষ্টির সময় গাড়ি বন্ধ করেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। ফলে যানজট বেড়ে যায়। ভারী বৃষ্টির কারণে ট্রাফিক পুলিশেরও দায়িত্ব পালনে সমস্যা হয়," যোগ করেন তিনি।
তবে রাস্তায় চলাচলকারী অধিকাংশ চালকদের দাবি, বৃষ্টির সময় অধিকাংশ সিগনালগুলোতেই ট্রাফিক পুলিশ দায়িত্ব পালন করেন না। ফলে বিভিন্ন দিক থেকে আসা যানবাহন অনিয়ন্ত্রিতভাবে রাস্তা পার হয়। মূলত এ কারণেই যানজট সৃষ্টি হয় ওইসব এলাকায়।
মরিচসহ সবজির দাম বৃদ্ধির শঙ্কা
টানা বৃষ্টির ফলে দেশের বিভিন্ন এলাকার সবজিসহ মাঠের ফসলের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (সরেজমিন উইং) মো. ছাইফুল আলম টিবিএসকে বলেন, "সারাদেশেই আমন ধান রোপণ করা আছে। পানি জমে ধান ডুবে না গেলে বর্তমান পরিস্থিতিতে খুব বেশি ক্ষতির আশঙ্কা নেই। কারণ আমন ধানের গাছ পানির নিচেও ৩-৪ দিন পর্যন্ত ঠিক থাকে।"
"তবে যেসব এলাকায় ধান ফ্লাওয়ারিং পর্যায়ে আছে সেগুলো নিয়ে শঙ্কা আছে," জানান তিনি।
মো. ছাইফুল আলম আরও বলেন, সবজি নিয়ে চিন্তার কিছু নেই; সবজির জমিগুলো বেশিরভাগই উঁচু জায়গায় হয়। একইসঙ্গে শীতকালীন সবজি এখনো লাগানো হয়নি বলে জানান তিনি।
এদিকে, সারাদেশে ৯৩ হেক্টর জমিতে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ ও ২,০০০ হেক্টর এর বেশি জমিতে কাঁচা মরিচ রোপণ করা আছে।
পেঁয়াজ ও মরিচের জমিতে পানি আটকে গেলে দুটি ফসলই নষ্ট হয়ে যেতে পারে বলে জানা গেছে। এজন্য জমি থেকে দ্রুত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করার পরামর্শ দিয়েছেন কৃষি কর্মকর্তারা।