যে ১০ ঘণ্টায় উদ্ধত ইসরায়েল হতভম্ব হয়ে পড়ে
সম্প্রতি জাতিসংঘে ইসরায়েলকেন্দ্রিক এক নতুন মধ্যপ্রাচ্য গড়ার সদম্ভ ঘোষণা দিয়ে এসেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তার কদিন পরই তিনি ও ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে পেলেন ভয়ানক এক আঘাত, যাদের তিনি তার কল্পিত আঞ্চলিক মানচিত্রে ঠাঁই-ই দেননি।
ফিলিস্তিনের মুক্তিসংগ্রামের গোষ্ঠী হামাস সুপরকল্পিত, সফল এক আকস্মিক আক্রমণ চালিয়েছে ইসরায়েলে। জল, স্থল ও আকাশ—সব পথেই। অল্প সময়ের ব্যবধানে ছুড়েছে হাজার হাজার রকেট। ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের হাতে মারা পড়েছে কয়েকশ ইসরায়েলি, আটক হয়েছে বহু।
হামাসের এ অভিযানের উদ্দেশ্য কারও অজানা নয়। প্রথমত, ইসরায়েলের দখলদারিত্ব, উৎপীড়ন, অবৈধ বসতি স্থাপন ও ফিলিস্তিনিদের ধর্মীয় প্রতীক বিশেষ করে আল-আকসা মসজিদকে অপবিত্র করার প্রতিশোধ নেওয়া। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য, বর্ণবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে আরব দেশগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিরুদ্ধে নিজেদের জোরালো অবস্থান জানান দেওয়া। সর্বশেষ উদ্দেশ্য, ইসরায়েলি জিম্মিদের বিনিময়ে যত বেশি সম্ভব ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক বন্দি মুক্ত করা।
স্মর্তব্য যে, হামাসের গাজা উপত্যকার নেতা ইয়াহিয়া আল-সিনওয়ার দুই দশকের বেশি সময় ইসরায়েলের কারাগারে বন্দি থাকার পর বন্দি বিনিময়ের মাধ্যমে মুক্ত হয়েছিলেন। হামাসের সামরিক শাখার প্রধান মোহাম্মাদ দেইফও অন্যান্য ফিলিস্তিনিদের মতোই প্রিয়জনদের হারিয়েছেন। দেইফের স্ত্রী, তিন বছরের শিশুকন্যা ও এক বছর বয়সি এক পুত্রসন্তানকে ইসরায়েলি সেনারা হত্যা করেছিল। ফলে এই হামলার পেছনে শাস্তিমূলক ও প্রতিশোধমূলক কারণও রয়েছে স্পষ্ট।
সেদিক থেকে বিবেচনা করলে হামাসের হামলাটি সবাইকে প্রচণ্ড ধাক্কা দিলেও, এটা নিয়ে আশ্চর্য হওয়ার মতো তেমন কিছু নেই।
অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস শেষতক ইসরায়েল ও তার উদ্ধত নেতাদের হতভম্ব করে দিয়েছে। এই নেতারা বহুদিন ধরে নিজেদের অজেয় গণ্য করেছেন। সেইসঙ্গে শত্রুপক্ষকে অবজ্ঞার চোখে দেখে এসেছেন।
১৯৭৩ সালের 'আকস্মিক' আরব হামলার পর থেকে ইসরায়েল বারবার নিপীড়িত শক্তিগুলোর প্রত্যাঘাতে ধাক্কা খেয়েছে, ভয় পেয়েছে।
১৯৮২ সালে ইসরায়েল লেবাননে হামলা চালানোর পর লেবানন প্রচণ্ড প্রত্যাঘাত করলে ওই সময়ও ইসরায়েলিরা এভাবেই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। ১৯৮০ ও ২০০০-এর দশকের ফিলিস্তিনি ইন্তিফাদার সময়ও বড় ধাক্কা খেয়েছে ইসরায়েল।
ইসরায়েলের সামরিক ও বেসামরিক নেতৃত্ব যে হামাসের এই হামলা আশা করেনি, তা এখন সবার কাছে স্পষ্ট। হামাসের এ হামলার সাফল্য ইসরায়েলি গোয়েন্দা ও সামরিক ব্যর্থতার প্রতিনিধি। ইসরায়েলের কাছে দক্ষ গুপ্তচর, ড্রোন ও নজরদারি প্রযুক্তি থাকা সত্ত্বেও আক্রমণ সম্পর্কে কোনো পূর্বাভাসই পায়নি দেশটি।
তবে এই ক্ষতি ইসরায়েলের সামরিক ও গোয়েন্দা পরিসর ছাপিয়ে গেছে। এ আক্রমণ ইসরায়েলের জন্য রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয় হয়েও এসেছে। 'অপরাজেয়' রাষ্ট্রটির অরক্ষিত, দুর্বল ও অযোগ্য চেহারা সবার সামনে ফাঁস হয়ে গেছে। ইসরায়েল যে মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক নেতা হওয়ার জন্য কতটা অযোগ্য, তা হামাসের হামলায় প্রকাশ্যে চলে এসেছে।
আতঙ্কে বাড়িঘর ও শহর ছেড়ে ইসরায়েলিদের ছুটে পালানোর ছবি আগামী বহু বছর সবার স্মৃতিতে গেঁথে থাকবে। আজ যা ঘটে গেছে, সেটি সম্ভবত ইসরায়েলের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ দিন; চূড়ান্ত অপমানের দিন।
অরক্ষিত ইসরায়েলের এই ছবি সারা বিশ্বের সামনে উন্মোচিত হয়ে গেছে।
কোনো সন্দেহ নেই, ইসরায়েলের সামরিক প্রতিষ্ঠান হামাসের বিরুদ্ধে নির্মম প্রতিশোধ নিয়ে নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার চেষ্টা করবে। অতীতের মতো এবারও বৃষ্টির ন্যায় বোমা ফেলবে ফিলিস্তিনিদের ওপর (ইতিমধ্যে যা শুরু হয়ে গেছে)। তাতে প্রাণ হারাবে অগুনতি ফিলিস্তিনি। কিন্তু অতীতের মতো এবারও ফিলিস্তিনিদের অদম্য মনোবল টুটবে না।
হামাস ও অন্যান্য ফিলিস্তিনি মুক্তিকামী গোষ্ঠীকে নির্মূল করার ছলে ফিলিস্তিনের বিভিন্ন শহর, গাজা উপত্যকা ও পশ্চিম তীরে পুনরায় সেনা মোতায়েনের কথা ভাবতে পারে ইসরায়েল।
সেটি করলে বড় ভুল হবে। এর ফলে পুরোদমে যুদ্ধ শুরু হবে। আর সেই প্রক্রিয়ায় নজিরবিহীনভাবে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়বে ইসরায়েল।
ব্যক্তিগত ব্যর্থতা ঢাকতে এবং নিজের ভঙ্গুর জোট রক্ষা করতে মরিয়া নেতানিয়াহু নিশ্চিতভাবেই অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখাবেন। এ প্রক্রিয়ায় তিনি নিজের নতুন ও সম্ভাব্য আঞ্চলিক অংশীদারদের কাছ থেকে আরও দূরে সরে যাবেন।
তবে ফিলিস্তিনিরা আজ স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছে, অপমানজনক মৃত্যুবরণের চেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে লড়াই করার ইচ্ছাই তাদের বেশি। ইতিহাসের সত্য থেকে শিক্ষা নেওয়ার সময় হয়ে গেছে ইসরায়েলের।