পাহাড়ে চলছে জুমধান কাটার ধুম
পাহাড়ি এলাকার প্রায় প্রতিটি জুমিয়া পরিবার ব্যস্ত সময় পার করছে জুমধান ও জুমের অন্যান্য ফসল সংগ্রহে।
দুর্গম এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, পাহাড়ের পাদদেশে একরের পর একর পাকা ধানের জুমক্ষেত। সেই জুমক্ষেতগুলো যেন সবুজ পাহাড়ের গায়ে সোনালি রঙের আলপনা আঁকার মত সুন্দর কোনো এক ছবি। যে ছবিতে জুমচাষীদের চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে নবান্নের হাসি। ফসল ঘরে তোলার পর কেউ কেউ পালন করছে নবান্ন উৎসবও।
জেলার সাত উপজেলায় চলতি অর্থ বছরে ৭ হাজার ৯৩৩ হেক্টর জায়গায় জুমচাষ হয়েছে। এতে সম্ভাব্য উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ধান ১৮ হাজার ৮৭ মেট্রিক টন এবং চাল ১২ হাজার ৫৮ মেট্রিক টন।
তবে আগস্ট মাসে হওয়া স্মরণকালের ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে কোথাও কোথাও জুমের সব ফসল একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। কোন ফসলই তুলতে পারেনি অনেক জুমিয়া পরিবার। বিশেষ করে থানচি উপজেলার সাঙ্গু নদীর উজানে রেমাক্রির ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী এলাকার জুমক্ষেত পাহাড়ি ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে। কোথাও নদীর পার ভেঙ্গে, কোথাও পাহাড় ধসে পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে জুমক্ষেত। ফসল তুলতে না পেরে খাবারের সংকট নিয়ে চিন্তিত অনেক জুমিয়া পরিবার।
জুমচাষীরা জানিয়েছেন, একই জায়গায় বারবার জুমচাষ করা যায় না। এক জায়গায় একবার চাষ করার পর অন্তত পাঁচ বছর সময় বিরতি দিতে হয়। যাতে জঙ্গলাকীর্ণ ও লতাগুল্ম বেড়ে মাটির উর্বরতা তৈরি হয়। বতর্মানে পাহাড়ে জুমচাষের জমি কমে আসায় একই জায়গায় অল্প সময়ের ব্যবধানে চাষের কারণে জুমধান আগের মত পাওয়া যায় না বলে জানান চাষীরা।
একসময় শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে চিম্বুক পাহাড়ে ভাল জুমচাষ হতো। আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক পরিবেশ অনুকুলে থাকলে বছর খোরাকি ধান পাওয়া যেত। কিন্তু বনজঙ্গল কমে যাওয়ায় এবং লোকসংখ্যা বাড়ার সাথে জুমচাষযোগ্য জমি না থাকায় আগের মত ধান পাওয়া যায় না। কম সময়ের ব্যবধানে একই জায়গায় বারবার চাষ হওয়ায় মাটির উর্বরতাও কমে গেছে। একমাত্র দুর্গম এলাকা ছাড়া বড় জুমক্ষেতেরও আর দেখা মেলে না।
সম্প্রতি থানচি উপজেলার রেমাক্রি ইউনিয়নের দুর্গম এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে এখনও বিশাল এলাকাজুড়ে জুমচাষ করা হয়ে থাকে। একরের পর একর জুমক্ষেতের ধান দেখা মেলে বিভিন্ন পাহাড়ে ঢালে। পাকা ধানগুলো কেটে নেওয়ার পর এখন জুমঘরে মাড়াইয়ের কাজও চলছে সমানতালে। আবার অনেক জায়গায় ধান দেরিতে লাগানোর কারণে তা মধ্য আশ্বিন মাসেও পুরোপুরি পাকেনি।
সীমান্তবর্তী এলাকা লিক্রি পাড়ার অদূরে সাঙ্গু নদীর তীরের পাশে একটি জুমক্ষেতে গিয়ে দেখা যায়, বিশাল একটি জুমক্ষেতে চারজন নারী-পুরুষ ধান কাটছেন। কাটাধান থুরুংয়ে (ঝুরি) করে জুমঘরে স্তুপ করছেন রাইংথোয়াই ম্রো।
লিক্রি পাড়ার বাসিন্দা রাইংথোয়াই ম্রো দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, পরিবারে চার সদস্য নিয়ে এক সপ্তাহ ধরে জুমধান কাটা হচ্ছে। এ বছর ১২ হাঁড়ি (১ হাঁড়ি ১০ কেজি চাল) ধান লাগানো হয়েছে। কিছু অংশ নদীর পাড়ে হওয়ায় দুই হাড়ির মত ধান এবারের ভারী বৃষ্টিতে ভেসে যায়। এ কারণে প্রায় ২০০ হাঁড়ির মত ধান কম পাওয়া যাবে। আর কিছু ধান এপ্রিল-মে মাসে কড়া রোদে মারা গেছে। সবচেয়ে নষ্ট হয়েছে তিল। বৃষ্টিতে নষ্ট না হলে এবার ৭০ হাড়ির মত তিল পাওয়া যেত। এখন এক হাড়িও তিল পাওয়া যাবে না। এক হাঁড়ি তিল ১২০০ টাকায় বিক্রি হত।
"তারপরও সবকিছু মিলে ৮০০ হাঁড়ির মত ধান পাওয়া যাবে। এতে পাঁচজনের সংসারে তিন বছর খোরাকি ধান ঘরে উঠবে। তবে জুমক্ষেতে সাথী ফসল হিসেবে পরিচিত মরিচ, ভুট্টা, মারফা ও মিষ্টি কুমড়া একবার কড়া রোদে এবং আরেকবার সম্প্রতি ভারী বৃষ্টির কারণে একেবারে নষ্ট হয়েছে। কোন রকমে খাওয়ার মত কিছু পাওয়া যাবে," বলেন তিনি।
লিক্রি এলাকার সাঙ্গু নদীর উজানে আরেকটি জুমক্ষেতে ধান কাটতে দেখা যায় আরেক দলকে।
রেংতন ম্রো নামে দলের এক সদস্য জানান, স্বামী-স্ত্রীসহ পরিবারে চার সদস্য মিলে দুই সপ্তাহ ধরে ধান কাটা হচ্ছে। ধান কাটার জন্য তার ছোট ভাই ও বোনকেও নিয়ে আসা হয়েছে। মোট ৯ হাঁড়ি ধান লাগানো হয়েছে। লোকবল কম হওয়ায় সময় বেশি লাগছে। কয়েকদিন পর কয়েকজন প্রতিবেশী ধান কাটার কাজে সহযোগিতা করার কথা। শেষ মুর্হুতে সবাই যে যার জুমের কাজে ব্যস্ত। জুমের মারফা (শসা জাতীয়) মোটামুটি ধরেছে। কিন্ত মরিচ একেবারেই ভাল হয়নি।
সীমান্তবর্তী এলাকা কোয়াইক্ষ্যং পাড়ার মাঝামাঝি সাঙ্গু নদীর তীরবর্তী পাশাপাশি আরও দুটি বড় জুমক্ষেত। জুমক্ষেত হলেও পাহাড়ে ঢালু জায়গায় নয়, একেবারে সমতল ভুমিতে। জুমের ধান পুরোপুরি পেকেছে। ধানও বেশ মোটা রয়েছে। পেকে সোনালি রঙে ধারণ করেছে জুমের ধান।
তবে নদীর তীরবর্তী অনেকের জুমক্ষেত ভারী বৃষ্টির কারণে ক্ষতি হয়েছে। একেবারেই তলিয়ে গেছে কারও কারও জুমক্ষেত। তাদের কেউ কেউ খাবার সংকট নিয়ে চিন্তিত। বছর খোরাকি তো দূরের কথা। দুয়েক মাস খাবারও ধান পাওয়া যাবে না বলে জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।
বড়মদক পাড়ার বাসিন্দা বাসিংঅং মারমা জানান, "এলাকায় আগের মত জুমচাষের জমি নাই। বড়মদক থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে আড়াই ঘণ্টার মত উজানের দিকে যেতে হয়। আসা যাওয়া পর্যন্ত দেড় হাজার টাকা তেলের খরচ হয়। সেখানে গিয়ে ১০ হাঁড়ির ধান জুমচাষ করেছি। এবারের ভারী বৃষ্টিতে সব নষ্ট হয়েছে। বৃষ্টিতে এভাবে ক্ষতি না হলে দুই বছর খোরাকি ধান পাওয়া যেত। এখন কোনরকমে দুই মাসের ধান পাওয়া যায় কিনা সন্দেহ। বাকি সময় ধারদেনা করে চলতে হবে।"
বড়মদক পাড়ার আরেক বাসিন্দা মেঅং মারমা ও ছোটমদক পাড়ার বাসিন্দা অজয় ত্রিপুরা জানান, তারা প্রত্যেকে পাড়া থেকে পাঁচ-ছয় ঘণ্টায় নৌকায় করে আসতে হয় এমন দূরে এসে জুমচাষ করেছেন। আগস্ট মাসে ভারি বৃষ্টির কারণে পুরোপুরি ক্ষতি হয়েছে। স্থানীয় ইউপি মেম্বার-চেয়ারম্যানদের জানানো হয়েছে। কারও কাছ থেকে কোন সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। পুরো এক বছর খবার সংকটে ভুগতে হবে।
এ ব্যাপারে রেমাক্রি ইউপি চেয়ারম্যান মুইশৈথুই মারমা জানান, আগস্ট মাসে ভারী বৃষ্টি ও বন্যার সময় সরকারিভাবে ২০০ জন ক্ষতিগ্রস্ত জুমচাষীর তালিকা করা হয়েছিল। সে সময় বড়মদক পর্যন্ত গিয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার নিজের হাতে নগদ অর্থ ও খাবার বিতরণ করেছিলেন। কিন্তু সীমান্তবর্তী কিছু লোকজন এত দুর্গম ও গহিন জঙ্গল বসবাস করে সে সময় প্রাকৃতিক বৈরি পরিস্থিতির মধ্যে যোগাযোগ করা যায়নি। তারপরও বাদপড়া ক্ষতিগ্রন্ত জুমচাষীর ব্যাপারে খবর নেওয়া হচ্ছে।
বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক এমএম শাহ নেওয়াজ জানান, এ বছর শুরুতে বৃষ্টিপাত কম হয়েছে আবার শেষের দিকে অতিবৃষ্টির কারণে পাহাড়ে কিছু জায়গায় জুমের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। আবার আগস্ট মাসে ভারী বৃষ্টির কারণে জুম ধানের পাশাপাশি মারফা, ভুট্টা, মরিচ, তুলা, ঢেঁড়স, বেগুন, বরবটি, তীর নষ্ট হয়েছে।