ইসরায়েলকে এখনি থামান — মধ্যপ্রাচ্য আরেকটি বড় যুদ্ধ সামলাতে পারবে না
গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের হামলা অব্যাহত রয়েছে। আল-আহলি আরব হাসপাতালে এক আক্রমণেই কয়েকশ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। চলমান অবরোধ ও ইসরায়েলি হামলার মধ্যে এ যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে মধ্যপ্রাচ্যে একাধিক রণাঙ্গনে লড়াই শুরু হওয়ার আশঙ্কাও ক্রমশ বাড়ছে।
ইসরায়েলের মিসাইল লেবানন ও সিরিয়ায়ও হামলা করেছে। সিরিয়ায় ইসরায়েলের মিসাইল হামলায় দুটি বড় বিমানবন্দর অচল হয়ে পড়েছে। লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে ইসরায়েলি গোলাবর্ষণে রয়টার্স-এর সাংবাদিক ইসাম আবদাল্লাহ নিহত এবং অনেকে আহত হয়েছেন।
এ সংঘাতের সরাসরি আক্রান্ত প্রভাব পড়েছে মিশরের ওপরেও। ইসরায়েল গাজা ও মিশরের মধ্যকার রাফা ক্রসিংয়ে নিয়মিত বোমা হামলা করছে।
গাজায় হাসপাতালে হামলার প্রতিক্রিয়ায় বুধবার ইরান ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য 'প্রতিরোধমূলক' ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলে সতর্কতা জানিয়েছে। এর আগে ইরাকের শক্তিশালী পপুলার মবিলাইজেশন ফোর্সেস-এর সদস্যরা গাজায় হামলা চলমান থাকলে প্রয়োজনে হস্তক্ষেপ করার ইঙ্গিত দিয়েছে।
অন্যদিকে লেবাননের হিজবুল্লাহও ইসরায়েলের লেবাননে হামলার প্রতিবাদে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে রকেট হামলা চালিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য আগে থেকেই অস্থিতিশীল ভূমধ্যসাগরে বিমানবাহী রণতরী বহর ও যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক ইসরায়েল ভ্রমণ করেছেন।
আর এসবের মাঝে ওয়াশিংটন ডিসি থেকে লন্ডন, ইস্তাম্বুল থেকে বৈরুত — বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ইসরায়েলের সমর্থনে এবং গাজায় হামলা বন্ধের আহ্বানে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমেছেন।
এটা স্পষ্ট যে, চলমান সহিংসতা থামানো না গেলে আমরা বিশ্বকে বদলে দেওয়া একটি যুদ্ধের মুখোমুখি হতে পারি। এ কাণ্ডজ্ঞানহীন সহিংসতা যদি মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে এ দুই অঞ্চলে মানুষের মৃত্যু আর দুঃখ — দুটোই নজিরবিহীন হবে।
কয়েক দশক ধরে সংঘাত সামলানোর পর মধ্যপ্রাচ্যের বেশিরভাগ দেশ এখন ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই করছে, স্থিতিশীলতা বজায় রাখার চেষ্টা করছে। এ দেশগুলোর পক্ষে নতুন আরেকটি যুদ্ধ সামলানো একদমই সম্ভব নয়। আর বর্তমান আশঙ্কার মতো একাধিক ময়দানে, একাধিক পক্ষের লড়াই শুরু হলে তো পরিস্থিতি আরও ভয়ানক হয়ে উঠবে।
আমার জন্মভূমি ইরাকের কথাই ধরা যাক। ইরাক বর্তমানে তুলনামূলক ভালো করছে। বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি ইরাকের। কিন্তু ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন আক্রমণের পর দেশটিকে আজকের অবস্থানে আসতে ২০ বছর সময় লেগেছে।
২০০৩ সালে আক্রমণের কয়েকদিন মধ্যেই প্রায় ১৫ হাজার বেসামরিক ইরাকি নিহত হয়েছিলেন। ২০০৬ সালের শেষ নাগাদ এ সংখ্যা ছয় লাখে পৌঁছায়। পরের বছরগুলোতেও দ্রুতহারে মৃত্যুসংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
গাজার বর্তমান সংঘাত যদি এ অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে এটি নিঃসন্দেহে ইরাককে আবার অস্থিতিশীল করে তুলবে এবং অনেক সাধিত উন্নয়ন বিপরীতমুখী হয়ে উঠবে। বড় কোনো আঞ্চলিক যুদ্ধ যে নিরাপত্তা-শূন্যতা তৈরি করবে, তা গভীরে প্রোথিত ভূরাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাকে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে পুনরায় জাগিয়ে তুলবে।
দীর্ঘ কয়েক বছরের যুদ্ধের পর ইরাকের মতো সিরিয়াও এখন সেরে ওঠার পর্বে রয়েছে। ইসরায়েলের সঙ্গে বড় কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে দেশটি আবারও বিশৃঙ্খলায় ডুবে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
সিরিয়ার প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষের মানবিক সহায়তা প্রয়োজন। দেশটির ৯০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। দেশটি আরেকটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে সাধারণ সিরিয়ানদের দুঃখের কোনো সীমা থাকবে না।
একইভাবে ইয়েমেনও দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশ। নিজেদের বিধ্বংসী যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে ইয়েমেন যদি আরও একটি নতুন যুদ্ধে আটকা পড়ে, তাহলে দেশটি ধ্বংসের মুখে পড়বে।
লেবানন অতীতে ইসরায়েলের সঙ্গে একাধিক যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। দেশটি গত চার বছর ধরে আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ইসরায়েলের সঙ্গে নতুন যুদ্ধে লেবাননের দীর্ঘমেয়াদি অস্তিত্বও হুমকির মুখে পড়তে পারে।
শুরু থেকেই ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলাকে ৯/১১-এর সঙ্গে তুলনা করছে। আমেরিকার 'সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের' মতো মানুষের জীবন ও আন্তর্জাতিক আইনের থোড়াই কেয়ার করে পালটা জবাব দেওয়ার ইচ্ছের ইঙ্গিত দিচ্ছেন ইসরায়েলি কর্মকর্তারা।
এটা স্পষ্ট যে, ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের ভুল থেকে কোনো শিক্ষা নেয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের মতো ইসরায়েলও যতটা সম্ভব রক্তপাত করতে চায়, কিন্তু এ সংঘাতের মূল সমস্যা সমাধানে বা সহিংসতার চক্র বন্ধ করতে আগ্রহী নয় এটি।
ইসরায়েল যদি এ পথ আঁকড়ে থাকে এবং মধ্যপ্রাচ্যে নতুন একটি বহুমুখী যুদ্ধের সূচনার কারণ হয়, তাহলে ইসরায়েলি, ফিলিস্তিনি, এ অঞ্চলের অন্যদের এবং বিশ্বের ওপর এর প্রভাব হবে অচিন্তনীয়।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সক্রিয় হয়ে উদ্যোগ নিতে হবে এবং তা করতে হবে এখনই। অতীতের ভুল যেন আবার না হয়, তা নিশ্চিত করতে আমাদের হাতে সময় খুব কমই আছে। মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি যুদ্ধ অনেক দেশকে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করার ঝুঁকি রাখে।
আর এ অঞ্চলে আরেকটি বড় যুদ্ধ প্রতিরোধে বিশ্বকে প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে পদক্ষেপটি নিতে হবে তা হলো ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের চলমান ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধ করা।
মধ্যপ্রাচ্যের পক্ষে আরেকটি বড় যুদ্ধ সামলানো সম্ভব নয় — কিন্তু গাজায় ফিলিস্তিনিদের হত্যাকাণ্ডও এটি আর বেশিদিন বসে বসে দেখবে না।
আহমেদ তাওয়াইজ: ফ্রিলান্স সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রনির্মাতা
বিশেষ দ্রষ্টব্য: আংশিক সংক্ষেপিত। নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।