ইসরায়েলি বোমা থেকে পালাতে রাজি না ফিলিস্তিনিরা: ‘মরতে হলে মরব!’
১৯৪৮ সালে আবু সাদার পরিবারকে বর্তমান দক্ষিণ ইসরায়েল থেকে জোরপূর্বক বের করে দেওয়া হয়। শুধু যে আবু সাদার পরিবারকে বের করে দেওয়া হয়েছিল তা নয়, তাঁর মতো আরো বহু পরিবারকে নিজেদের বসতি ছাড়তে বাধ্য করেছিল দখলদার ইসরায়েল। এরপর তাঁরা গাজার ঠিক উত্তরে জাবালিয়া শহরে নতুন করে বসতি স্থাপন করে।
এ ঘটনার ৭৫ বছর পর এবার ইসরায়েলি বাহিনীর নজর এখন এই শহরটিতেও। আবু সাদার উত্তরসূরী সহ এখানকার সব বাসিন্দাকে এলাকা ছাড়তে বলেছে ইসরায়েল।
গাজার চারপাশজুড়ে বৃষ্টির মতো বোমাবর্ষণ অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েলি বাহিনী। হামলায় এ শহরের একটি পরিবারের ১০ সদস্য নিহত হয়েছেন। এরপরেও পরিবারটি নিজেদের ভিটা ছাড়তে নারাজ।
শহরের বাসিন্দা বাসিল আবু সাদা (৩৫) বলেন, 'আমি কাউকে আর পরোয়া করি না।' তাঁর ভয় হলো যদি তাঁরা নিজেদের ভিটা ছেড়ে চলে যায়, তাহলে তারা খাবার বা কোনো আশ্রয় খুঁজে পাবে না। এমনকি আবার ফিরে আসার সুযোগও নাও হতে পারে। তিনি বলেন, 'মরলে মরব'।
স্থল অভিযান শুরুর আগে এ অঞ্চলে ব্যাপক বিমান হামলা অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েল। তবুও উত্তর গাজার কয়েক লাখ ফিলিস্তিনি বাসিল আবু সাদার মতোই নিজেদের ভূমি ছাড়তে চান না। অব্যাহত হামলায় পানি ও খাদ্য সংকটের পর ফিলিস্তিনিরা এবার বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা করছেন।
১৯৪৮ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে সাত লাখ ২০ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছিল। এরপর এসব এলাকা চলে যায় ইসরায়েলের দখলে। গাজার ২১ লাখ বাসিন্দার মধ্যে বাস্তুচ্যুত ওই ফিলিস্তিনিদের উত্তরসূরীর সংখ্যাই ১৭ লাখ।
সর্বশেষ গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের আকষ্মিক হামলায় এক হাজার ৪০০ জন নিহত হয়। হামলা চলাকালে অনেককে বন্দি করে গাজায় নিয়ে যায় হামাস। জবাবে ইসরায়েলও হামলা শুরু করে। হামাসের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক বিমান হামলার পর এবার তারা স্থল অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেজন্য বেসামরিক নাগরিকদের উত্তর গাজা থেকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে ইসরায়েল।
উত্তরের অধিবাসীদের ভয়ের কারণ হলো, তারা বাড়িঘর ছেড়ে চলে গেলে তাদের গাজার বাইরে প্রতিবেশী মিশর কিংবা অন্য কোনো দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য করা হবে। কায়রো ও আরব রাষ্ট্রগুলো ফিলিস্তিনিদের আরেকবার বাস্তুচ্যুতির বিরোধিতা জানিয়েছে।
উত্তর গাজার বাসিন্দা ও পেশায় প্রকৌশলী আয়াদ সোবাকি (৪৫) জানান, তাঁর ১০ সদস্যের পরিবার গাজা ছাড়বে না। ১৯৪৮ সালে তাদের পূর্বসূরীদের বাস্তুচ্যুতিও ঠিক এভাবেই শুরু হয়েছিল। তিনি বলেন, ওই সময়েও ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলের কথায় ঘরবাড়ি ছেড়েছিল। তারা আশা করেছিল এক বা দুই সপ্তাহ পর তারা নিজেদের বাড়ি ফিরতে পারবে। কিন্তু তারা সেটি কখনোই পারেনি।
সোবাকি বলেন, 'আমি কীভাবে আমার দেশের জন্য কিছু করতে পারি? আমি আমার ঘরেই থাকব। দেশের জন্য এছাড়া আমার করার আর কিছুই নেই।
যদিও দক্ষিণ গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর বোমা হামলা চলছে, এর পরও ইসরায়েলি নেতারা উত্তর গাজার অধিবাসীদের নিরাপত্তার জন্য দক্ষিণ গাজায় চলে যেতে বলেছেন। ইসরায়েল বলছে, বেসামরিক নাগরিকদের জন্য দক্ষিণ গাজায় 'নিরাপদ আশ্রয়' এর ব্যবস্থা করা হবে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তারা গাজা দখল করতে চায় না। তাদের অভিযানের একমাত্র উদ্দেশ্যই হলো হামাসের কর্তৃত্ব শেষ করা।
গত শনিবার মিশরের রাফা সীমান্ত ক্রসিং দিয়ে দক্ষিণ গাজায় ওষুধ, খাদ্যসহ ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানোর একদিন পর গত রবিবার ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র দানিয়েল হাগারি উত্তর গাজার অধিবাসীদের দক্ষিণে সরে যাওয়ার আহ্বান জানান।
তবে অনেক ফিলিস্তিনি বলেন, তারা ইসরায়েলের মুখের কথা বিশ্বাস করেন না। নিজেদের ভূমিও তারা ছাড়বেন না। কেউ কেউ তাদের ঘরেই রয়েছেন, প্রায় এক লাখ মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন হাসপাতাল ও গীর্জায়।
সোবাকি বলেন, তার পরিবারের সদস্যরা রাতে যখন ঘুমান, তখন কোনো দুর্ঘটনার আশঙ্কায় তিনি প্রতিদিন ভোর পর্যন্ত জেগে থাকেন। দিনের বেলা তিনি সৌরবিদ্যুৎ চালিত টেলিভিশনে বাড়ির আশেপাশের এলাকায় ইসরায়েলি হামলার খোঁজখবর নেন।
ইসরায়েলের উত্তর গাজা থেকে অধিবাসীদের দক্ষিণে সরে যাওয়ার নির্দেশের মধ্যে অনেকে অতীতে ফিলিস্তিনিদের গণহারে উচ্ছেদ করে ভূমি দখলের মিল দেখতে পাচ্ছেন। উত্তর গাজায় ফিলিস্তিনিরা সরে গেলে ইসরায়েল তা দখলে নেবে- এমন কথাও বলছেন অনেকে।
হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মতে, গত ৭ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ইসরায়েলি বিমান হামলায় চার হাজার ৬০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। গাজার আবাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্যের বরাত দিয়ে জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উপত্যকাজুড়ে অন্তত ৪২ শতাংশ ঘরবাড়ি ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
গাজার মানবাধিকার বিষয়ক গবেষক হুসেইন হামাদ জানান, তিনি ও তার পরিবারের ২০ সদস্য জাবালিয়ার তেল জাতার এলাকায় বসবাস করছেন। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলি হামলা থেকে বাঁচতে তার পূর্বসূরীরা বারবারা গ্রাম থেকে পালিয়ে আসে। গ্রামটি গাজা ও ইসরায়েলের আশকেলন শহরের সীমান্তে অবস্থিত। এতে তারা নিজেদের ঘরবাড়ি সহ ১০ একর কৃষিজমি হারান।
হুসেইন হামাদ বলেন, আমরা এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি করব না। যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমরা বাড়িতেই থাকব। তিনি আরো বলেন, জাবালিয়ায় বসবাসের অবস্থা পুরোপুরি বিপর্যস্ত। বিদ্যুৎ নেই, প্রয়োজনীয় পানিটুকুও মিলছে না। রুটি ও পানির জন্য তার পরিবারকে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে।
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক ইতিহাসবিদ রাশিদ খালিদি বলেন, দ্বিতীয়বারের মতো বাস্তুচ্যুতির ঘটনায় ফিলিস্তিনিদের হয়তো গাজার বাইরে বেরিয়ে যেতে হবে না, এটি হতে পারে তাদের গাজার এক অংশ থেকে আরেকটি অংশে স্থানান্তর।
গাজায় নিহতের সংখ্যা বাড়তে থাকায় পশ্চিমারা গাজার মানুষদের আশ্রয়ের জন্য সীমান্ত খুলে দিতে মিশরের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। তবে মিশরীয় প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ আল সিসি এর বিরোধিতা জানিয়ে ইসরায়েল আর ফিলিস্তিনিদের ফেরত নেবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
যুক্তরাজ্যের কিংস কলেজ লন্ডনের ডিফেন্স স্টাডিজ ডিপার্টমেন্টের বিশেষজ্ঞ মোহান্নাদ সাবরি বলেন, 'মিশর এসব ঝামেলায় জড়াতে চায় না।'
পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকা নিয়ে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে কয়েক বছর ধরে আলোচনা চললেও তা আলোর মুখ দেখেনি। ১৯৬৭ সালে পশ্চিম তীর দখল করে ইসরায়েল। গাজা থেকে ইসরায়েল একতরফাভাবে তাদের সেনা প্রত্যাহারের দুই বছর পর ২০০৭ সালে গাজার নিয়ন্ত্রণ নেয় হামাস।
১৯৪৮ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে বাস্তুচ্যুত হওয়া অসংখ্য ফিলিস্তিনি শরণার্থী জর্দান, লেবানন ও সিরিয়া সহ অন্যান্য আরব রাষ্ট্রে আশ্রয় নেয়। সে সময় আরব রাষ্ট্রগুলো থেকেও প্রায় আট লাখ ইহুদিকে বাস্তুচ্যুত করা হয়। এদের বেশিরভাগ ইসরায়েলে বসতি গড়ে। তবে ফিলিস্তিনিদের মতো বাস্তুচ্যুত ইহুদি ও তাদের বংশধরেরা অবশ্য তাদের নিজভূমে ফিরতে কোনো আগ্রহ দেখায়নি।
বিভিন্ন দেশে আশ্রিত ফিলিস্তিনি শরণার্থীরা নানা সুবিধা থেকে বঞ্চিত। লেবাননে প্রায় দুই লাখ ১০ হাজার শরণার্থী নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে কাজ করা ও সম্পত্তি ক্রয়ের সুযোগ পান না।
২৩ বছর বয়সী আব্দুল্লাহ হাসানিন নামে এক অধিবাসী বলেন, গাজার যথেষ্ট সংখ্যক অধিবাসীকে মিশরের সিনাই অঞ্চলে চলে যেতে বাধ্য করতে পারলেই ফিলিস্তিনি ইস্যুর পরিসমাপ্তি হবে। তিনি বলেন, 'আমি মরব, তবুও সিনাই কিংবা অন্য কোথাও শরণার্থী হবো না।'
দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে চলা ইসরায়েলি হামলায় গাজা উপত্যকায় খাদ্য, পানি ও জ্বালানি সংকটে বিপর্যস্ত জনজীবন।