গাজাকে ধ্বংসের পরিকল্পনা ইসরায়েলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এসেছে; আইসিজেতে দক্ষিণ আফ্রিকা
গাজা উপত্যকাকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা ইসরায়েল রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এসেছে; এমনটাই দাবি করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকা। আর এক্ষেত্রে দেশটির আইনজীবীরা জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) তেল আবিবের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ তুলেছেন। খবর বিবিসির।
জাতিসংঘের সর্বোচ্চ এ আদালত অভিযোগগুলো শুনেছে। একইসাথে গাজায় যাতে ইসরায়েল সামরিক কার্যক্রম বন্ধ করে, সেজন্য আদালতকে নির্দেশ দিতে দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষ থেকে মামলা করা হয়েছে।
তবে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার এমন অভিযোগকে 'ভিত্তিহীন' বলে দৃঢ়ভাবে প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে। একইসাথে আজ (শুক্রবার) দেশটির পক্ষ থেকে আত্মপক্ষ সমর্থন করার কথাও রয়েছে।
এক্ষেত্রে দক্ষিণ আফ্রিকার হাইকোর্টের আইনজীবী টেম্বেকা এনগকুকাইতোবি আইসিজে-এর আদালতে বলেন যে, "সামরিক হামলা চালানোর ধরণ দেখেই ইসরায়েলের 'গণহত্যার অভিপ্রায়' সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে গাজাকে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রটির সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে গ্রহণ করা হয়েছে।"
আর দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষে আইনজীবী আদিলা হাসিম আদালতকে বলেন, "প্রতিদিন ফিলিস্তিনি জনগণের জীবন, সম্পত্তি, মর্যাদা এবং মানবতার অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। এই আদালতের আদেশ ছাড়া আর কিছুই চলমান দুর্ভোগকে থামাতে পারবে না।"
মামলার শুনানির আগে দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষ থেকে অভিযোগের স্বপক্ষে আদালতে তথ্য-প্রমাণ হাজির করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বলা হয় যে, ইসরায়েলের পদক্ষেপগুলি 'ফিলিস্তিনি জাতীয়, জাতিগত এবং জাতিগত গোষ্ঠীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে ধ্বংস করার উদ্দেশে' গ্রহণ করা হয়েছে।
যদিও গাজায় সামরিক হামালাকে প্রথম থেকেই 'যুক্তিযুক্ত' বলে দাবি করে আসছে ইসরায়েল। তেল আবিবের দাবি, হামাসের গত ৭ অক্টোবরের হামলার পাল্টা জবাব হিসেবে এই আক্রমণ করছে দেশটি।
গতকাল (বৃহস্পতিবার) এই বিষয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার আইনমন্ত্রী রোনান্ড ল্যামোলা বলেন, "কোনো আক্রমণই 'গণহত্যা' কনভেনশন লঙ্ঘনের ন্যায্যতা দিতে পারে না বা রক্ষা করতে পারে না।"
ইসরায়েল ১৯৪৮ সালে গণহত্যার বিরুদ্ধে যে কনভেনশন হয়েছে সেটির স্বাক্ষরকারী দেশ। এতে গণহত্যাকে স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এবং স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রগুলিকে এটি প্রতিরোধে বাধ্য করার কথা বলা হয়েছে।
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলা
মূলত দক্ষিণ আফ্রিকা আইসিজে-তে ইসরায়েলকে 'গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ডে' অভিযুক্ত করে মামলা দায়ের করেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় গতকাল (বৃহস্পতিবার) দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দক্ষিণ আফ্রিকার এই আচরণকে 'ভণ্ডামি' বলে দাবি করেন। একইসাথে সিরিয়া ও ইয়েমেনে 'হামাসের অংশীদারদের' দ্বারা সংঘটিত নৃশংসতার প্রতিক্রিয়া জানাতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য দেশটির সমালোচনা করেন।
নেতানিয়াহু আরও বলেন, "আজ আমরা একটি উল্টোপাল্টা পৃথিবী দেখেছি। যেখানে ইসরায়েল গণহত্যার বিরুদ্ধে লড়াই করছে সেখানে আমাদের বিরুদ্ধে উল্টো গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। ইসরায়েল হত্যাকারী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে যারা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে।"
এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করে যে, ইসরায়েল গণহত্যা করেছে বলে দক্ষিণ আফ্রিকা যে অভিযোগ করেছে সেটির কোনো যৌক্তিকতা নেই।
হোয়াইট হাউজের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক মুখপাত্র জন কিরবি বলেন, "ইসরায়েল এখনও একটি কার্যকর হুমকির বিরুদ্ধে নিজেদের রক্ষা করছে।"
আইসিজে জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালত। নেদারল্যান্ডের হেগ শহরে এটি অবস্থিত। এর রায়গুলি তাত্ত্বিকভাবে আদালতের পক্ষগুলির জন্য আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক; যার সদস্য হিসেবে রয়েছে ইসরায়েল ও দক্ষিণ আফ্রিকা। তবে আদালত এটি পালন করতে দেশগুলোকে বাধ্য করতে পারে না৷
২০২২ সালে আদালতটির পক্ষ থেকে রাশিয়ায় প্রতি ইউক্রেনে অতিসত্বর সামরিক কার্যক্রম বন্ধের আদেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেটিকে তোয়াক্কা করেনি মস্কো।
আন্তর্জাতিক আইনে গণহত্যা বলতে একটি জাতীয়, জাতিগত কিংবা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার অভিপ্রায়ে এক বা একাধিক কাজ করাকে বোঝায়।
এদিকে 'পিস প্যালেস' নামে পরিচিত আইসিজে ভবনের বাইরে ছিল ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের ক্ষুব্ধ জনতা। সহিংসতা এড়াতে ডাচ পুলিশ ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি সমর্থকদের আলাদা রাখতে হিমশিম খাচ্ছিল।
ফিলিস্তিনি পতাকা হাতে শত শত মানুষ আদালতের বাইরে জড়ো হয়ে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছিল। অন্যদিকে ইসরায়েলি সমর্থকরা একটি স্ক্রিন স্থাপন করে সেখানে গাজায় এখনও বন্দী থাকা কিছু জিম্মির ছবি দেখাচ্ছে।
এদিকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু সাফ জানিয়ে দিয়েছেন যে, গাজার জনগণকে স্থায়ীভাবে বাস্তুচ্যুত করার কিংবা ভূখণ্ড দখল করার কোনো ইচ্ছা তেল আবিবের নেই।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) এর মতো আইসিজে গণহত্যার অপরাধের জন্য ব্যক্তিদের বিচার করতে পারে না। তবে এর মতামত জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে।
এদিকে গত বুধবার দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা বলেছেন, "গাজার জনগণের চলমান হত্যার বিরুদ্ধে আমাদের বিরোধিতা একটি দেশ হিসাবে আমাদের আইসিজে-তে যেতে বাধ্য করেছে।"
এদিকে ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজগ দক্ষিণ আফ্রিকার অভিযোগগুলোকে 'নৃশংস ও অযৌক্তিক' বলে অভিহিত করেছেন।
তিনি বলেন, "আমরা আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে থাকব এবং মানবিক ও আত্মরক্ষামূলক যুক্তির মাধ্যমে গর্বের সাথে আমাদের বিরুধে করা মামলা লড়বো।"
ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, "ইসরায়েলি সেনাবাহিনী কোন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতি এবং কোনও বেসামরিক হতাহতের ঘটনা যাতে না ঘটে তা নিশ্চিত করতে স্থলভাগে অত্যন্ত জটিল পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে।"
ইসরায়েলের সামরিক অভিযান স্থগিতে করা দক্ষিণ আফ্রিকার মামলার রায় হয়তো আইসিজে দ্রুতই দিতে পারে। তবে ইসরায়েল গণহত্যা করছে কি-না সে বিষয়ে চূড়ান্ত রায় আসতে কয়েক বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
দক্ষিণ আফ্রিকা গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান নিয়ে সবসময়ই বেশ সমালোচনা করেছে। আর দেশটির ক্ষমতাসীন দল আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের ফিলিস্তিনের সাথে একাত্মতার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।
এদিকে চলমান ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত গাজায় অন্তত ২৩,৩৫০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। যাদের মধ্যে বেশিরভাগ নারী ও শিশু।
এদিকে গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে হামাসের হামলায় প্রায় ১৩০০ জন নিহত হয়েছিল। এছাড়াও প্রায় ২৪০ জনকে জিম্মি করেছিল স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠীটি।