শক্তিশালী কয়েকটি দেশ মানবাধিকার, গণতন্ত্র, নির্বাচনকে শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
নির্দিষ্ট কোন দেশের নাম উল্লেখ না করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, এটা 'লজ্জাজনক' যে কিছু দেশ গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশের উপর চাপ সৃষ্টি করে তাদের স্বার্থ হাসিল করে।
তিনি বলেন, 'শক্তিশালী কয়েকটি দেশ নিজেদের ক্ষুদ্র জাতীয় স্বার্থ হাসিল করার জন্য কিছু দেশকে বাছাই করে মানবাধিকার, গণতন্ত্র, সুশাসন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, গুমকে তাদের শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। যা দেশগুলোর মধ্যে আস্থা ও সংহতি হ্রাস করছে, বর্তমানে এটি সব সংকটের মধ্যে বড় সংকট।'
শনিবার এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মোমেন বলেন, মজার ব্যাপার হলো বিদেশে অবস্থানরত কিছু অসন্তুষ্ট বাংলাদেশি এবং কিছু স্বার্থান্বেষী মহল তাদের অর্থ দিয়ে দেশ-বিদেশে মিথ্যা ও বানোয়াট অপপ্রচারের মাধ্যমে তাদের এই ক্ষুদ্র স্বার্থ অর্জনে সহায়তা করছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, 'বাছাইকরণ ও রাজনীতিকরণ মানবাধিকার ও গণতন্ত্র প্রচারের মূল বাধা। এটি তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর সামনে উদ্ভূত একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ।'
বাংলাদেশ যেহেতু গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো দেশে গণমাধ্যম ও বাকস্বাধীনতা রয়েছে এবং দেশের জনগণের প্রতি আমাদের আস্থাও আছে। তাই বাংলাদেশ এসব প্রোপাগান্ডা মেশিনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
কূটনৈতিক ম্যাগাজিন ডিপ্লোম্যাটস ওয়ার্ল্ড রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে 'নেভিগেটিং চ্যালেঞ্জস: বাংলাদেশে'স রেসপন্স টু দ্য কারেন্ট গ্লোবাল সিচুয়েশন'- শীর্ষক সেমিনারের আয়োজন করে।
সেমিনারে সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী, বাংলাদেশে দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত পার্ক ইয়ং-সিক, কূটনীতিক শাহেদ আখতার প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
মোমেন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অসংখ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, যার মাধ্যমে টেকসই গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের উন্নয়নে তার অঙ্গীকারের প্রতিফলন দেখেছে বাংলাদেশ।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার পূর্ববর্তী দায়মুক্তির সংস্কৃতির অবসান ঘটিয়েছে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করেছে, সন্ত্রাস ও সহিংস চরমপন্থার প্রতি শূন্য সহনশীলতা দেখিয়েছে এবং জনগণের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করেছে।
'তার (শেখ হাসিনার) লক্ষ্য তার দেশের জনগণের মঙ্গল এবং তাদের খাদ্য, বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা প্রদান করা।'
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, নির্বাচন কমিশন (ইসি) পূর্ণ স্বাধীনতা, বিশ্বাসযোগ্যতা ও দক্ষতার সঙ্গে তার দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে জাল ভোটের সম্ভাবনা দূর করতে ছবিযুক্ত ভোটার আইডি কার্ড ইস্যু করা হয়েছে, এবং ভোটারদের পাশাপাশি ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা ও এজেন্টদের মধ্যে আস্থা তৈরির জন্য স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স তৈরি করা হয়েছে।
মোমেন বলেন, বাংলাদেশ স্থানীয় ও জাতীয় সরকার পর্যায়ে কয়েকটি নির্বাচন করেছে এবং এসব নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে।
মোমেন বলেন, 'আমার নিজের শহর সিলেটসহ এসব নির্বাচনে বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রার্থীদের একটি বড় অংশ জয়লাভ করেছে এবং নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।'
'আমাদের বৈদেশিক নীতির অগ্রাধিকারগুলো অর্জনের জন্য বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক উদ্বেগগুলো কাটিয়ে উঠতে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে এবং চলমান উন্নয়নমূলক লক্ষ্য অর্জনের পাশাপাশি দীর্ঘকালের লালিত স্বপ্ন অর্জনের জন্য আমাদের সক্ষমতাকে শক্তিশালী করাটা গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ হবে।'
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যূত মিয়ানমারের নাগরিকদের প্রত্যাবাসন (এফডিএমএন) বাংলাদেশ এবং এ অঞ্চলের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
তিনি বলেন, 'বিশ্ব সম্প্রদায়ের দায়িত্বশীল সদস্য হিসেবে আমরা রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী আশ্রয় দিয়েছি। এমনকি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ভূমিকা পালনের আগেই প্রথম সাড়াদানকারী হিসেবে আমরা আমাদের খাদ্য ভাগাভাগি করে এবং তাদের মৌলিক মানবিক চাহিদা নিশ্চিত করার মাধ্যমে ভূমিকা পালন করেছি।'
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদার পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশ প্রতি বছর রোহিঙ্গাদের খাদ্য, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নে ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, 'আন্তর্জাতিক সহায়তা কমলেও খরচ বাড়ছে। দীর্ঘ ছয় বছর রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া পরও শুধু বাংলাদেশ এই বোঝা বহন করতে থাকবে, এটা অন্যায্য।'
তিনি বলেন, একটি ছোট ভূখণ্ডে এক মিলিয়নেরও বেশি মানুষ, যারা গণহত্যা ও জাতিগত নিধনের অতীত স্মৃতি নিয়ে এসেছে, এসব মানুষের কট্টরপন্থা ও চরমপন্থার প্রবণতা থাকবে এটাই স্বাভাবিক।
'তাই আমরা আশঙ্কা করি এই জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত লোকদের যদি তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসন না করা হয়, যদি তাদের আশা ও ভরসা না দেওয়া হয়, তাহলে তারা এই অঞ্চল এবং এর বাইরের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য মারাত্মক হুমকিতে পরিণত হতে পারে। এমনকি তারা বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তা ঝুঁকি হতে পারে।'
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, এই অসহায় মানুষদের নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে তারা অংশীদারদের সঙ্গে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
তিনি বলেন, 'আমরা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, শান্তি ও উন্নয়নের বৃহত্তর স্বার্থে বহুপক্ষীয়, আঞ্চলিক, ত্রিপক্ষীয় ও দ্বিপক্ষীয় সবদিক থেকে এই সংকটের একটি টেকসই সমাধান আশা করছি।'
মোমেন বলেন, বাংলাদেশ একা এই সংকটের সমাধান করতে পারে না এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সংকট সমাধানে তাদের দায়িত্ব থেকে পিছিয়ে যাওয়া উচিত নয়। মিয়ানমার বাংলাদেশের ওপর যে বোঝা চাপিয়েছে তা থেকে বাংলাদেশকে মুক্তি দিতে হবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, 'রোহিঙ্গাদের প্রতি যাতে আমাদের সম্মিলিত মনোযোগ থাকে তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংস্থা এবং অন্যান্য অংশীজনদের। যারা তাদের মানবিক ও জবাবদিহির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ন্যায়সঙ্গত বৈশ্বিক সংহতি ও সমর্থন প্রাপ্য।'