সরকার-বিরোধী আন্দোলনের সময় পুলিশ ও বিচারিক আদালতের কর্মদক্ষতা কেন বেড়ে যায়?
গণমাধ্যমের প্রতিদিনই যেসব তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে, তাতে বোধ হয়– বিচার বিভাগের দক্ষতা, পুলিশের কার্যক্ষমতা যেন নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। একইদিনে বহু আসামির সাজা নির্ধারিত হচ্ছে। বছরের পর বছর পড়ে থাকা মামলাগুলোয় যাদেরকে সাজা দেওয়া হচ্ছে, তাদের মধ্যে মৃত ও গুম ব্যক্তির সাজা হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে। মাঠের রাজনৈতিক আন্দোলন (বিরোধী দলের) জোরালো হলেই বিচারিক আদালতের কর্মদক্ষতা বেড়ে যায়। দ্রুত মামলাগুলো নিষ্পত্তি হতে থাকে, এবং প্রায় অধিকাংশ মামলায় আসামিদের সাজা দেওয়া হয়।
ভারতীয় উপমহাদেশের তিনটি দেশের বিচারিক আদালতের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তবে মানদণ্ডে বোধহয় আমরা সবার পেছনে। উপমহাদেশের অন্য দুটি বড় সাংবিধানিক গণতন্ত্রের দেশে, বিচারিক আদালত পরিচালিত হয় উচ্চ আদালতের তত্ত্বাবধানে। অর্থাৎ, বিচারিক আদালতের পদায়ন, কর্মস্থল নির্ধারণ সবটাই হাইকোর্ট স্বাধীনভাবে সম্পন্ন করেন। দেশ দুইটিতে একাধিক হাইকোর্ট অবস্থিত। পাকিস্তানের মোট ছয়টি এবং ভারতের ২৫টি'র উপরে হাইককোর্ট আছে, পাশাপাশি সুপ্রিমকোর্ট প্রদেশ-ভিত্তিক প্রশাসনিক কাঠামো থাকার ফলে আলাদা আলাদা হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । প্রদেশগুলোর বিচারিক আদালতের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে আছেন এ হাইকোর্ট-সমূহ। সেখানে রাজ্যের কোন হস্তক্ষেপ নাই।
মাসদার হোসেন মামলার মাধ্যমে আমাদের বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা বলা হলেও বাস্তবে তা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। অতীতে যা ছিল তাই আছে। এই মামলার দিকনির্দেশনা আজও পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। এই মামলাটির ফলে বিচার বিভাগের লোক-নিয়োগের ক্ষেত্রে আলাদা একটি ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন নামক একটি ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু অন্যান্য দিক থেকে দেখতে গেলে ফলাফল সে আগের জায়গাতেই আছে।
এরমধ্যে এক বিরল ঘটনা ঘটেছে সোমবার আদালত পাড়ায়; বিরোধী দলের মূল রাজনৈতিক নেতার জামিন মামলার শুনানি স্থগিত হয়ে গেছে সরকারি কৌশলীর অনুপস্থিতির কারণে। এরপর যখন সেই নেতার আইনজীবীরা জামিন শুনানির পরবর্তী তারিখ নির্ধারণের জন্য আদালতের কাছে আবেদন জানান, তখন বিচারক আদালত কক্ষ ত্যাগ করে নিজ খাস কামরায় চলে যান। এই উদাহরণ অসংখ্য ঘটছে রাজনৈতিক মামলাগুলোতে। অনেক ক্ষেত্রেই বিচারক আদালতের শুনানিস্থল ত্যাগ করে খাস কামরায় যান। এবং সেখান থেকে ফিরে এসে আদেশ দেন।
দীর্ঘকাল আদালতে শুনানি শেষে সরাসরি আদেশ দেওয়ার যে বিধি-বিধান চালু ছিল তাতে এখন ঘাটতি দেখা যাচ্ছে।
এর সাথে সাথে আছে আরেকটি দিক, যেকোনো মামলায় যেকোনো ধারায় মামলা করা হোক না কেন, তার সঙ্গে যদি রাজনীতির কোন ন্যূনতম যোগাযোগ থাকে – তাহলে বিচারিক আদালতে জামিন পাওয়ার সুযোগ কমে যায়। সকল মামলার জামিন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে উচ্চ আদালতের কাছে। ফলে উচ্চ আদালত তার স্বাভাবিক কাজকর্ম ফেলে রেখে এই সমস্ত জামিন শুনানিতে অংশ নিতে থাকেন। ভারতের বিচারিক আদালতগুলো রাজ্য নিয়ন্ত্রিত না হওয়ায়– আমরা বহু মামলায় দেশটির বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের আদালতের কাছ থেকে সঠিক বিচারিক আদেশ পেতে দেখি ।
এদিকে পাকিস্তানে যেখানে সেনা কর্তৃত্ব, সেখানেও আমরা কখনো কখনো বেশ কিছু স্বাধীন আদেশ-নির্দেশ দেখি। অপরদিকে আমাদের দেশের বিচারিক আদালতে হস্তক্ষেপের অভিযোগ রয়েই গেছে। একজন পাবলিক প্রসিকিউটার অনুপস্থিত থাকার জন্য একটি মামলায় গ্রেফতারকৃত আসামি জামিন শুনানি হবে না, এ বোধহয় পৃথিবীর বিরল ইতিহাস। উচ্চ এবং বিচারিক আদালত সর্বক্ষেত্রেই আমরা এই বিরল চর্চার ঘটনা দেখছি। হাইকোর্ট বিভাগ কিংবা সুপ্রিমকোর্টে রাষ্ট্রপক্ষের কাছ থেকে সময় প্রার্থনার আবেদন দেখতে পাচ্ছি। ফলে মামলার জটিলতা আরো বাড়ছে, দীর্ঘকাল অপেক্ষমান তালিকার মামলাও আপিল বিভাগের সরকারি পক্ষের টাইম পিটিশনের কারণে আবার নতুন করে দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় ঢুকে পড়ছে। কত সহস্র মামলা, কত সহস্র মানুষ মামলার জটিল জালে আবদ্ধ। সে বিষয়গুলোকে মানবিকভাবে কেউ দেখছে কিনা সন্দেহ।
বিচারিক আদালত সমূহকে স্বাধীনভাবে চলতে দেওয়ার স্বার্থে, কিংবা উচ্চ আদালতের স্বাধীনতাকে অখণ্ড রাখার প্রয়োজনে, ভারতীয় উপমহাদেশের অন্য দুটি দেশের উদাহরণকে আমরা গ্রহণ করতে পারি কিনা– তা রাজনৈতিক নেতাদের ভেবে দেখতে হবে। আদালতের দুর্বলতা নিয়ে আলোচনা কমে গেছে। অতীতের দু-একটি ঘটনায় উচ্চ আদালতের আদালত অবমাননার নির্দেশ দেওয়ার কারণে– গণমাধ্যম এ বিষয়গুলো নিয়ে খুবই সতর্ক।
মাঠের ক্ষমতার লড়াই আমরা দেখছি, কিন্তু যারা ক্ষমতায় আসতে আগ্রহী, যারা এই বিচার বিভাগের নানান বিষয়গুলোর মুখোমুখি হচ্ছে– তারাও কখনোই মুখ দিয়ে বিচার ব্যবস্থার প্রকৃত সংস্কারের কথা বলছেন না। হয়তো তারাও ভাবছেন, প্রতিশোধ নেওয়ার এই ক্ষমতা ভবিষ্যতে আমাদের হাতেই থাকুক। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা গণতন্ত্রের প্রধান বিষয় হিসেবে সারা পৃথিবীতে স্বীকৃত। সেই বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়টি গণমাধ্যম সমাজে সুস্পষ্টভাবে আলোচনা হতে দেখা যায় না। আর বর্তমানে তো গণমাধ্যমের এক বিশাল পরিধিজুড়ে আনুগত্য-প্রিয়তাই প্রধান দিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অতীতের গণমাধ্যম স্বাধীনতার আন্দোলনকারীরা এখন কালের গর্ভে হারিয়ে গেছেন, জনস্বার্থে পরিচালিত হওয়ার কথা– গণমাধ্যমের মালিকানা মূলত হচ্ছে শীর্ষ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানসমূহের। ফলে সমাজের মূল সমস্যার বিষয়গুলো নিয়ে তাদের মাথাব্যথার কোন কারণ নেই। সাধারণ মানুষ যে সমস্ত বিষয়ে আকর্ষিত হয়, তেমনই সব বিষয় নিয়ে তারা ব্যস্ত থাকেন সারাক্ষণ। অথচ ইতিহাস বলে সমাজ বিকাশের পূর্বশর্তটি হচ্ছে বিচারিক আদালত সমূহের স্বাধীনতা। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশের প্রতিটি উদাহরণ একই।
- লেখক: মনোয়ারুল হক একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফল। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।