'তোমার স্ত্রী তোমার দেখা পেতে চায়': ১৮ শতকের চিঠি, খোলা হলো এতো দিনে!
১৭৪৭ সালে স্বামী মিগেল আতোচার উদ্দেশে একটি চিঠি লিখেছিলেন স্ত্রী ফ্রান্সিসকা মুইনোস। কিন্তু সেই চিঠি শেষ পর্যন্ত পৌঁছায়নি স্বামীর হাতে। এমনকি কেউ খুলেও দেখেনি চিঠিটি। প্রায় ৩০০ বছর পর খামবন্দি সেই চিঠি খোলা হলো। চিঠিটিতে স্বামীর প্রতি ফ্রান্সিসকার ভালবাসা আর দুঃখগাঁথা চিত্র ফুটে উঠেছে।
১৮ শতকে ব্রিটিশ বাহিনী কর্তৃক আটক করা একটি স্প্যানিশ জাহাজের হাজারো কাগজপত্রের ভেতরে এ চিঠি পাওয়া যায়। এখন অনলাইনে প্রকাশ করা হয়েছে চিঠিটি।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, আমেরিকা ভ্রমণে যাওয়ার পর আতোচা তার স্ত্রী ফ্রান্সিসকাকে পরিত্যাগ করেছিলেন।
স্পেনের সেভিল থেকে মেক্সিকোতে আতোচার উদ্দেশে ১৭৪৭ সালের ২২ জানুয়ারি চিঠিটি লিখেছিলেন ফ্রান্সিসকা। শুধু তিনিই নন, তার মতো আরো বহু স্প্যানিশ নারী ভিনদেশে থাকা তাদের স্বামীর উদ্দেশে চিঠি লিখেছিলেন। এমন ১০০টি চিঠি পাওয়া গেছে স্পেনের কাদিস শহর ও মেক্সিকোর ভেরাক্রুজের মধ্যে চলাচলকারী নিবন্ধিত বাণিজ্যিক জাহাজ লা নিনফা থেকে।
এসব চিঠিতে সঙ্গীর অবর্তমানে স্ত্রীরা যে আবেগ ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখী হয়েছিলেন তারই আদ্যোপান্ত লেখা রয়েছে। জাহাজটি আটক করেছিল তৎকালীন কুখ্যাত ব্রিটিশ সশস্ত্র জাহাজ 'রয়্যাল ফ্যামিলি।
ফ্রান্সিসকার চিঠিতে লেখা, 'প্রিয় স্বামী, চিঠিটি আপনার হাতে পৌঁছালে এবং আমি নিজের জন্য যেমন সুস্থতা কামনা করি, আপনিও ঠিক তেমন সুস্থ রয়েছেন জানতে পারলে আমি অত্যন্ত আনন্দিত হবো। আমি এর আগে আপনাকে লেখা ১৩টি চিঠির একটিরও উত্তর না পাওয়ার কারণ জানতে চাই। আমি জানতে চাই সেখানে কি চিঠি লেখার জন্য কোনো কলম, কাগজ বা কালি নেই।'
তিনি আরো লিখেন, তিনি 'দুঃখী, বিশ্বের যে কারো চেয়ে বেশি দুঃখ তার। অনেক যন্ত্রণা তার। ফ্রান্সিসকা লিখেন, 'আরো দুঃখ আপনার (আতোচা) এই দুই সন্তানকে নিয়ে যাদের প্রতি আপনার ভালবাসা উবে গেছে।'
ফ্রান্সিসকা লিখেন, তাদের সন্তান মিগেল তার বাবার চেয়েও সুঠাম দেহের অধিকারী হয়েছে। কিন্তু তাকে কোনোকিছু না পরিয়েই রাখতে হয়। কারণ তিনি (ফ্রান্সিসকা) যেখানে আছেন সেখানে কাজ করার মত কোনো অবস্থা নেই।
চিঠিতে ফ্রান্সিসকা লিখেছেন, অসুস্থতা সত্ত্বেও তিনি এবং তাদের মেয়ে মারিয়া বাধ্য হয়ে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করছেন। তার নিজের গলায় ফোঁড়া হয়েছে। অর্থের অভাবে তিনি চিকিৎসাও করাতে পারছেন না। এমনকি ঠিকমতো খাবারও জোটে না তাদের। এমনও দিন গেছে যেদিন সামান্য পানির স্বাদও পাননি ফ্রান্সিসকা। কারণ আশপাশ থেকে পানি সংগ্রহের তেমন কোনো জায়গাও নেই। ফ্রান্সিসকা লিখেছেন, তিনি এতটাই অসুস্থ যে মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে যে ভিক্ষা করবেন, সেটিও সম্ভব নয়।
তিনি লিখেন, তার ছেলের এমন কাউকে প্রয়োজন যে তাকে একটি পোশাক ধার দেবে। তাদের মেয়ে মারিয়ার এস্তাসিও হিদালগোর ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। তার দুর্ভোগের সীমা নেই। মারিয়া একটি শিশুর জন্ম দেয়, কিন্তু শিশুটি মাত্র ১৪ মাস বেঁচে ছিল।
চিঠির শেষ অংশে ফ্রান্সিসকা স্বাক্ষর করে লিখেছিলেন, 'আপনার স্ত্রী আপনাকে দেখতে চায়, ফ্রান্সিসকা মুইনোস।'
জেনকিন্স ইয়ার যুদ্ধ (১৭৩৯-৪৮) এবং অস্ট্রিয়ান উত্তরাধিকার যুদ্ধের (১৭৪০-৪৮) সময় ব্রিটিশদের দ্বারা বন্দি প্রায় ১৩০টি স্প্যানিশ জাহাজ থেকে এমন অনেক চিঠির পাশাপাশি বিভিন্ন কাগজপত্র ও প্রত্নবস্তু পাওয়া গেছে।
যুক্তরাজ্যের স্প্যানিশ রাষ্ট্রদূত হোসে প্যাসকুয়াল মার্কো বলেছেন, এসব নথি বিশ্বকে বোঝার জন্য অমূল্য। এসব চিঠিতে আমেরিকার মানবিক গল্পগুলো ফুটে উঠেছে।
১৬৫২ থেকে ১৮১৫ সালের মধ্যে ব্রিটিশ সশস্ত্র স্কোয়াড্রন ও নৌজাহাজ প্রায় ৩৫ হাজার জাহাজ আটক করেছিল। তারা প্রাপক পর্যন্ত না পৌঁছানো ২০টি ভাষায় লেখা এক লাখ ৬০ হাজার চিঠিসহ কয়েক লাখ কাগজপত্র জব্দ করেছিল, যা আজও প্রাইজ পেপার হিসেবে টিকে আছে।
যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল আর্কাইভস ও জার্মানির ওল্ডেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ২০ বছরের যৌথ প্রকল্পে এগুলো ডিজিটাইজ করা হচ্ছে।
এসব কাগজপত্রের মধ্যে নুয়েস্ত্রা সেনোরা দে কোভাদঙ্গা জাহাজ থেকে পাওয়া একটি বইয়ের দুটি খণ্ডও রয়েছে। জাহাজটি ১৭৪৩ সালে মেক্সিকোর আকাপুলকো থেকে ফিলিপাইনের ম্যানিলায় যাওয়ার পথে আটক করা হয়েছিল। এছাড়াও ১৭৪২ সালে রাজা পঞ্চম ফিলিপের পক্ষ থেকে ফিলিপাইনের গভর্নরের উদ্দেশে পাঠানো পত্রও রয়েছে।
কাগজপত্রগুলোর মধ্যে বন্ধুর উদ্দেশে লেখা স্পেনের সানলুকার দে বারামেরার ১৬ বছর বয়সী কিশোর ওয়াকিন রুইজ দে এসপানার একটি চিঠিও রয়েছে। সে তার বাবার সাথে মেক্সিকোর ভেরাক্রুজে চলে গিয়েছিল। জাহাজে উঠতে গিয়ে সে যে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিল চিঠিতে সেই গল্প লিখেছিল এই কিশোর।
সে লিখেছিল, 'সন্ধ্যায় মই বেয়ে জাহাজে ওঠার সময় হাত ও পা পিছলে আমি পানিতে পড়ে যাই। নিজের দক্ষতার চেয়ে ঈশ্বরের দয়াতেই ভেসে থাকতে পেরেছিলাম।' পরে তার বাবা তার দিকে দড়ি উপর থেকে দড়ি নিক্ষেপ করেছিলেন।
সে এও লেখে, 'আমি নিজেকে তখন মৃত্যুর কিনারে দেখতে পাচ্ছিলাম। একজন পাপী হিসেবে আমি তখন ভাবছিলাম ঈশ্বর নিশ্চয়ই আমার প্রাণ নিয়ে নেবেন।'