রাজনীতির অলংকার রাজনৈতিক কৌশল, কিন্তু বক্তব্য প্রদানে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন!
সকল নেতাকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হবে, নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া হবে ইত্যাদি পর্দার অন্তরালের রাজনীতিকে সামনে নিয়ে আসা রাজনীতির কৌশল হতে পারে, কিন্তু তার সামগ্রিক প্রতিক্রিয়া অনুধাবন করা দেশের রাজনৈতিক নেতাদের দায়িত্ব। এক্ষেত্রে সেই দায়িত্ব পালিত হয়েছে কিনা– তা এক মূল্যবান প্রশ্ন। দেশ-বিদেশে এতে নানান প্রশ্নের সৃষ্টি হচ্ছে।
আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থাকে নিয়ে এমন কিছু কিছু ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে, যা জনজীবনে বিচার ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থার উদাহরণ বলা যেতে পারে। নির্বাচনপূর্ব রাজনৈতিক বিতর্ক, রাজনৈতিক কর্মসূচি, এবং স্বীকৃত কর্মসূচি পালনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যে আচরণ করা হচ্ছে তা প্রকাশ্যে নিয়ে আসা হয়েছে, যেটি উদ্দেশ্যমূলক। অর্থাৎ, দেশের সাম্প্রতিককালের বিচার ব্যবস্থায় ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা, যেমন দ্রুতগতিতে কোর্ট থেকে সাজা প্রদান করা, ৮-১০ বছরের পুরনো মামলায় রাতারাতি বিচার সম্পন্ন করা - এসবই জনগণের কাছে প্রশ্ন সৃষ্টি করেছে।
একইসঙ্গে এটাও স্মরণ করতে হয় যে, বিএনপিকে নির্বাচনে আনার জন্য দলটির সব কারাবন্দি নেতাকে মুক্তি দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক। তবে বিএনপি সেই প্রস্তাবেও রাজি হয়নি বলে জানান তিনি। কৃষিমন্ত্রীর এই বক্তব্য জনমনে কি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল? বিশ্ব আঙ্গিকে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার ভাবমূর্তি কোথায় গেল– এই দায়িত্ববান মানুষটি কি ভেবে দেখেছেন? কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটেছে এই বক্তব্যে।
এ ধরনের আরো উচ্চমাত্রার বিভিন্ন বক্তব্য আরো অনেক নেতা-নেত্রীদের মুখ থেকেই প্রকাশ্যে আসছে। রাজনৈতিক বিভাজন এড়িয়ে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পরিপূর্ণভাবে কার্যকরী করার জন্য এই বক্তব্যগুলো কতটা অন্তরায়– তা দেশের রাজনীতিবিদরা ভেবে দেখেছেন কি?
রাজনীতির অলংকার হচ্ছে রাজনৈতিক কৌশল। পৃথিবীব্যাপী রাজনৈতিক কৌশলে বহু কিছু থাকে। পর্দার অন্তরালের কৌশলের পাশাপাশি কিছু থাকে প্রকাশ্য কৌশল। এবার যারা নির্বাচন বর্জন করে দেশে আন্দোলন করার চেষ্টা করছে– তারা যখন ক্ষমতায় ছিল ১৯৯৬ সালের নির্বাচনেও এরকম একটি সংকট তৈরি হয়েছিল। ফেব্রুয়ারি মাসের সেই নির্বাচনে পর্দার অন্তরালের একটি সমঝোতা হয়েছিল, সেই সমঝোতার অংশ হিসেবেই একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৯৬ সালে এবং সেই নির্বাচনের পরে রাতারাতি পার্লামেন্টে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার বিল পাস করানো হয়েছিল।
কিন্তু সমঝোতার সেই দিনগুলোতেও কিন্তু প্রকাশ্যে এই ধরনের বক্তব্য আসেনি– যে আমরা রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে সাংবিধানিক প্রয়োজনে এই নির্বাচন করছি। যদিও সেই নির্বাচনে বিরোধীদলসমূহ অংশ নেয় নাই, এমনকি আজকে যে বৃহত্তর রাজনৈতিক দলটি ক্ষমতায় আছে তাদের সঙ্গে মিলে আন্দোলন করা জামায়াতে ইসলামী ( যারা এখন ক্ষমতার বাইরে) তারাও সেই ৯৬ সালে নির্বাচনে অংশ নেয়নি। ফেব্রুয়ারি নির্বাচন ছিল একতরফা নির্বাচন। কিন্তু সেই কৌশলী নির্বাচন, যার বিষয়বস্তু জনগণের সামনে তখনও প্রকাশ্যে আসেনি। পর্দার অন্তরালে যে আলোচনাই হয়ে থাকুক না কেন, তা যখন কার্যকর হয়নি, এবং তার ভিত্তিতে যখন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে না– তখন প্রকাশ্যে এই বক্তব্য নিয়ে আসা সরকারের জন্য কতটা লাভজনক হয়েছে? নিশ্চয়ই মন্ত্রী সাহেব এই বক্তব্য দিয়েছেন জেনেবুঝেই।
এই বক্তব্য কি দেশের পুলিশি ব্যবস্থা ও বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করল না! যদিও দলটির সাধারণ সম্পাদক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন এমন দেউলিয়া দল আওয়ামী লীগ নয়। এ ধরনের প্রস্তাব আমরা দেইনি। অন্যদিকে কৃষিমন্ত্রীমন্ত্রী নিজে তাঁর বক্তব্যের স্বপক্ষে যুক্তি দিয়ে বলেছেন, আইনি প্রক্রিয়ায় তাঁদেরকে (বিএনপি নেতা-কর্মীদের) মুক্তি দেওয়া হবে। মন্ত্রী সাহেবের এই বক্তব্য কিংবা ব্যাখ্যার সমালোচনায় বলা যায়, মুক্তি দেওয়ার ক্ষমতা বিচার বিভাগের। নির্বাহী বিভাগের নির্দেশে আইন বিভাগ এই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রশ্নটি বারবার সামনে উঠে আসছে, তারই একটি উদাহরণ হল কৃষিমন্ত্রীর এই বক্তব্য। নিজ ব্যাখাকে পরিষ্কার করতে যেয়ে তিনি আরেকবার যা বলেছেন– তাও যথার্থ নয়। নির্বাহী বিভাগ আইনি প্রক্রিয়ায় কাউকে মুক্তি দেওয়ার অধিকার রাখে না। যদিও আমাদের দেশে এই ঘটনা অতীতে বহুবার ঘটেছে। ২০০৭-এর সেই সেনা-সমর্থিত সরকার একাধিকবার ঘটিয়েছে, তার উদাহরণ আছে।
আগামী প্রজন্মের জন্য এসব নেতিবাচক শিক্ষা। আমাদের যে সন্তানেরা এখন জীবনের সর্বোচ্চ মেধা দ্বারা বিচারবিভাগে যোগদান করছেন, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা করার স্বপ্ন দেখছেন— তাদের জন্য, কিংবা যে পুলিশ কর্মকর্তা আজ মাঠে আসছেন, তাদের জন্য কি উদাহরণ তৈরি করা হলো এই বক্তব্য দিয়ে, তা কি এই মন্ত্রী সাহেব ভেবেছেন? আমাদের রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের বহু কাল আমরা এই ধরনের বক্তব্য দিতে দেখছি।
বলার অপেক্ষা রাখে না দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক সমঝোতায় এক বিরাট প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অভাব। দেশের রাজনীতিবিদরা কবে ভেবে দেখবেন– ক্ষমতা কখনো চিরস্থায়ী নয়, আজ মঞ্চে যারা উপবিষ্ট, তারা একদিন মঞ্চের সামনের শ্রোতা হবেন– সেই কথাটি আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা মনে করেন না।