রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলো ঋণের ৬,০০০ কোটি টাকা সুদ মওকুফ চায়
রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোকে ঋণের বোঝা থেকে মুক্ত করতে বিশেষ বিবেচনায় সুদ মওকুফ সুবিধা দিতে অর্থ বিভাগকে সুপারিশ করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়। একইসঙ্গে বন্ড ইস্যু করে এসব চিনিকলের বিপুল পরিমাণ ঋণের মূল টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করেছে মন্ত্রণালয়।
গত ৫ ডিসেম্বর পাঠানো এক চিঠিতে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) অধীনে পরিচালিত ১৫টি চিনিকলের জন্য এই বিশেষ বিবেচনা নিশ্চিত করতে অর্থ বিভাগের সচিবকে অনুরোধ জানায় মন্ত্রণালয়।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, যুগোপোযোগী ব্যবসা-কৌশল ও কাঁচামালের অভাবে বছরের পর বছর ধরে লোকসানে চলতে থাকা চিনিকলগুলোকে দায়মুক্তির মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ দিতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের রুগ্ন প্রতিষ্ঠান চালু রাখা এবং বিশেষ সুবিধা দেওয়ার মানেই হচ্ছে রাষ্ট্রের অপচয় বাড়ানো।
সূত্রমতে, রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালীসহ মোট ৬টি ব্যাংকের কাছে সুদ-আসলে বিএসএফআইসির ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ২৯১ কোটি টাকা।
এর এক-তৃতীয়াংশ মূল ঋণ। বাকিটা দীর্ঘদিনের সুদ। অর্থাৎ চিনিকলগুলোর জন্য ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি সুদ মওকুফ সুবিধা চাচ্ছে শিল্প মন্ত্রণালয়।
প্রধানত আখ চাষে কৃষকদের দাদন দেওয়ার জন্য ব্যাংক থেকে বেশিরভাগ ঋণ নেওয়া হয়েছে। কৃষকরা আখ চাষ করে টাকা ফেরত দিলেও মিলগুলো বা বিএসএফআইসি ব্যাংককে টাকা ফেরত দেয়নি।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অতিরিক্ত সচিব দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আলোচনার পর শিল্প মন্ত্রণালয় চিঠিটি দিয়েছে। তবে এই মুহূর্তে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাবে না।
'আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের পর গঠিত নতুন সরকার এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।'
শিল্প মন্ত্রণালয় চিঠিতে বলেছে, বিএসএফআইসির অধীন চিনিকলগুলোর ব্যাংকঋণের সুদ মওকুফের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর মৌখিক নির্দেশনা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এসব চিনিকলের চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকা ঋণের সুদ যেন আর নতুন করে আরোপ করা না হয়। সেই প্রেক্ষিতে এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সচিবের সঙ্গে আলোচনা করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়। এরপর গত ২৬ সেপ্টেম্বর এসব মিলের ঋণ, ঋণের সুদ মওকুফ ও পরিশোধ-সংক্রান্ত বিষয়ে ১১ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়।
ওই কমিটি বিভিন্ন পর্যালোচনা শেষে বলেছে, চিনিকলগুলোর সক্ষমতা না থাকায় ঋণের সুদের বোঝা থেকে বাঁচতে সুদ আরোপ স্থগিত রাখতে হবে। পাশাপাশি মিলগুলোর ঋণের আরোপিত সুদ মওকুফ করতে হবে।
কমিটি সুপারিশ করেছে যে, মওকুফ করা সুদের পরিমাণ একটি সুদবিহীন ব্লক হিসাবে রাখতে হবে। এরপর আদায়যোগ্য যে পাওনা থাকবে, তার সাথে কষ্ট অভ ফান্ড অথবা সহনীয় সুদহার যোগ করে ঋণ হিসাব করতে হবে।
এই হিসাবে যে পরিমাণ অর্থ হবে, তার জন্য বিএসএফআইসির পক্ষে সরকার বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে অর্থ তুলে ব্যাংকগুলোকে পরিশোধ করবে—এর আগে যেভাবে বাংলাদেশ জুট মিল কর্পোরেশন (বিজেএমসি) ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) জন্য করা হয়েছিলো।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জাকিয়া সুলতানা টিবিএসকে বলেন, চিনিকলগুলোর নিজস্ব ব্যবস্থায় ঋণ শোধ করার সক্ষমতা নেই। এমনকি পেনশন, গ্র্যাচুইটির টাকাও দিতে পারছে না মিলগুলো। যে কারণে সময়ের সাথে সাথে চক্রবৃদ্ধি হারের সুদের কারণে মোট ঋণের বোঝা বাড়ছে।
'এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী এসব ঋণের সুদ যাতে আর না বাড়ে, সেরকম ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দিয়েছেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষকে নিয়ে অনেক পর্যালোচনার মাধ্যমে এই সুপারিশ করা হয়েছে,' বলেন তিনি।
জাকিয়া সুলতানা বলেন, চিনিকলগুলোর উৎপাদন বাড়াতে উন্নত জাতের আখ চাষ ও নতুন ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহারের উদ্যোগ ইতিমধ্যে নেওয়া হয়েছে। আরও কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। এই বিপুল ঋণের বোঝা থেকে মিলগুলোকে মুক্ত করা গেলে আগামীতে নিজস্ব আয়ে চলার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
ঋণদাতা জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল জব্বার বলেন, সুদ মওকুফের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে।
'সেই নীতিমালার আওতায় সুদ মওকুফ সুবিধা দিতে কোনো বাধা নেই। এ ধরনের প্রস্তাব এলে ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে,' বলেন তিনি।
জনতা ব্যাংকের ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বৃহৎ ঋণগ্রহীতা গ্রাহকের তালিকা থেকে জানা গেছে, ব্যাংকটিতে বিএসএফআইসির ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৫১১ কোটি টাকা।
বিএসএফআইসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ শোয়েবুল আলম সংস্থাটিতে সদ্য যোগদান করায় কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
তবে একজন শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মিলগুলোর ঋণ এত পুরোনো যে এর আসল কত, সুদ কত—এই হিসাব করে বের করাই কঠিন।
তিনি বলেন, সরকারের বিশেষ হস্তক্ষেপ ছাড়া মিলগুলোকে এখন আর টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।
আয়-ব্যয়
বিএসএফআইসির অধীনে ১৫টি চিনিকল, দুটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানা রয়েছে। কেরু অ্যান্ড কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেডের সাথে একটি ডিস্টিলারি প্লান্ট ও জৈব সার কারখানা রয়েছে।
এসব প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পদে ৮ হাজার ৬৮১ জন কর্মী কাজ করছেন। প্রতিষ্ঠানগুলো লোকসানে চললেও কর্মকর্তাদের দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণ, ভ্রমণ থেমে নেই।
২০২২-২৩ অর্থবছরে বিএসএফআইসি তাদের সব মিল ও কারখানা থেকে ৮১৯ কোটি টাকা আয় করেছে। আর ওই সময়ে সংস্থাটির এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত অর্থবছরে সংস্থাটি ৭১৫ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। বহু বছর ধরে মিলগুলো বছরে গড়ে ১ হাজার কোটি টাকার লোকসান দিয়ে আসছে।
মিলগুলোকে চালু রাখতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকার বিএসএফআইসিকে ২০০ কোটি টাকা পরিচালন ঋণ দিয়েছে। সংস্থাটির অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে চলতি মূলধন জোগানো ও ব্যাংকঋণ পরিশোধ।
কোন মিলের কত লোকসান
গত অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি ৯৮.৭৭ কোটি টাকা লোকসান করেছে ঝিনাইদহের মোবারকগঞ্জ সুগার মিলস। এরপরেই ৯১.৩৪ কোটি টাকা লোকসান করেছে ঠাকুরগাঁও সুগার মিলস।
এছাড়া রাজশাহী সুগার মিলস ৮৪.১৫ কোটি, জয়পুরহাট সুগার মিলস ৮০.৭২ কোটি, নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস ৭২.৯৫ কোটি ও নাটোর সুগার মিলস ৬৫.৯৯ কোটি টাকা লোকসান করেছে।
তাছাড়া ৫৯.৯৭ কোটি টাকা লোকসান করেছে জিলবাংলা সুগার মিলস। ফরিদপুর সুগার মিলসের লোকসান ৫৮.৫৬ কোটি টাকা। আর পাবনা সুগার মিলস ৪৬.৮৯ কোটি, কুষ্টিয়া সুগার মিলস ৪১.৮৩ কোটি, শ্যামপুর সুগার মিলস ৩২.৬৫ কোটি, পঞ্চগড় সুগার মিলস ২২.৫৭ কোটি, রংপুর সুগার মিলস ২১.৩২ কোটি, সেতাবগঞ্জ সুগার মিলস ১২.২২ কোটি এবং রেণউইক, যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোং লিমিটেড ৫.১৮ কোটি টাকা লোকসান করেছে।
এর মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে কুষ্টিয়া, পাবনা, পঞ্চগড়, শ্যামপুর (রংপুর), রংপুর ও সেতাবগঞ্জ (দিনাজপুর) চিনিকল বন্ধ রয়েছে। এসব বন্ধ মিলের আড়াই হাজারের বেশি কর্মীকে নিয়মিত বেতন দিতে হয়। এসব মিলের ঋণের সুদ ও ইউটিলিটি বাবদও নিয়মিত ব্যয় করতে হচ্ছে। লোকসান কমাতে এসব মিল বন্ধ করা হয়।
পুঞ্জীভূত ঋণের সুদ দায়কে লোকসানের কারণ হিসেবে বিএসএফআইসি তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। এছাড়া আখের চাষ কমে যাওয়া, কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি, উন্নত জাতের আখের উদ্ভাবন না হওয়ার কারণেও লোকসান হচ্ছে বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এই সংস্থার অধীনস্থ কেরু অ্যান্ড কোম্পানি একমাত্র লাভজনক প্রতিষ্ঠান। গত অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি ৮০.৫৭ কোটি টাকা লাভ করেছে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের(পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর টিবিএসকে বলেন, এ ধরনের রুগ্ন প্রতিষ্ঠান চালানোর চেষ্টা থেকে সরকারকে বেরিয়ে আসতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহজ শর্তে বেসরকারিকরণ করা যেতে পারে। এতে ব্যাংক, রাষ্ট্র সব পক্ষেরই লাভ।
উৎপাদন
১৫টি চিনিকলের বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ২.১০ লাখ টন। কিন্তু পর্যাপ্ত আখের সবরাহ না থাকায় এবং অদক্ষ যন্ত্রপাতির কারণে মিলগুলো উৎপাদনক্ষমতার পুরোটা উৎপাদন করতে পারে না। গত অর্থবছরে মাত্র ৬০ হাজার টন উৎপাদন করেছে।
দেশে বছরে প্রায় ২০ লাখ টন চিনির চাহিদা রয়েছে। ফলে বেসরকারি খাতে ৬টি চিনি পরিশোধনকারী কারখানা স্থাপন হয়েছে। এসব কারখানা লাভজনকভাবে পরিচালিত হচ্ছে এবং বছরে বছরে এদের পরিসর বড় হচ্ছে।