আমদানি শুল্ক ও বুকিং দর কমার পরও দেশের বাজারে কমছে না চিনির দাম
আমদানি শুল্ক অর্ধেকে নামিয়ে চিনির দাম কমানোর চেষ্টা করছে সরকার। কিন্তু এ চেষ্টাও বাজারে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি বলেই মনে হচ্ছে; কারণ বুকিং রেট কমার পরও দেশের বাজারে চিনির দাম কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
আন্তর্জাতিক বাজারে গত দুই মাসে চিনির বুকিং দর টনপ্রতি ১০০ ডলার পর্য়ন্ত কমে গেছে। তাতেও বাংলাদেশে পণ্যটির দাম কমেনি। উল্টো শুল্ক কমানোর পর গত এক মাসে পাইকারি বাজারে চিনির দাম প্রতি মণে ৪০০ টাকা পর্য়ন্ত বেড়েছে, আর খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি দাম বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত।
দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে গত ১ নভেম্বর থেকে অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে টনপ্রতি ১ হাজার ৫০০ টাকা এবং পরিশোধিত চিনিতে ৩ হাজার টাকা আমদানি শুল্ক কমিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, বর্তমানে অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে টনপ্রতি ১ হাজার ৫০০ টাকা এবং পরিশোধিত চিনিতে ৩ হাজার টাকা শুল্ক দিতে হচ্ছে। আগে অপরিশোধিত চিনিতে ৩ হাজার টাকা এবং পরিশোধিত চিনিতে ৬ হাজার টাকা আমদানি শুল্ক গুনতে হতো। অর্থাৎ উভয় ধরনের চিনির আমদানি শুল্ক কমিয়ে অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়েছে।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, দেশের চিনির বাজার কয়েকটি গ্রুপ অভ কোম্পানিজের হাতে জিম্মি। তাই শুল্ক কমানো কিংবা আন্তর্জাতিক বাজারে বুকিং দর কমার পরও পণ্যটির দাম কমছে না।
চট্টগ্রামের পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের পাইকারি চিনি ব্যবসায়ী মেসার্স আরএম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আলমগীর পারভেজ বলেন, প্রায় দুই মাস আগে শুল্ক কমালেও এরপর থেকে এক টাকাও দাম কমেনি।
'বরং দাম কমানোর পর আরও এক দফা বেড়ে যায় পণ্যটির দাম। গত এক মাসের বেশি সময় ধরে সেই বাড়তি দামেরই বিক্রি হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যটি,' বলেন তিনি।
আলমগীর আরও বলেন, আগে খাতুনগঞ্জসহ দেশের ছোট ও মাঝারি মানের অনেক আমদানিকারক চিনি আমদানি করত। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে এই ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা পণ্য আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছেন না।
'এতে হাতেগোনা কয়েকজন আমদানিকারকের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে ভোগ্যপণ্যের বাজার,' বলেন তিনি।
বাজার অস্থির হওয়ার বিষয়ে সিটি গ্রুপের পরিচালক (করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেরটরি অ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য হলেও ডলার সংকটের কারণে চিনি আমদানি করতে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।
তিনি বলেন, 'ঋণপত্র খুলতে এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে ধরনা দিতে হচ্ছে। কোনো ব্যাংকে পণ্য আমদানির ঋণপত্র খোলার অনুমতি দিলেও ডলারের বিনিময়মূল্য গুনতে হচ্ছে ১১৮ থেকে ১২২ টাকা পর্য়ন্ত।
'এছাড়া এলসি মার্জিন দিতে হচ্ছে ১২০ শতাংশ থেকে ১৫০ শতাংশ পর্য়ন্ত। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির বুকিং দর কমে যাওয়া, এমনকি আমদানি শুল্ক কমালেও পণ্যের দাম কমানো যাচ্ছে না।'
বুকিং দর কমার কোনো প্রভাব নেই
খাতুনগঞ্জের চিনি আমদানিকারক আহাদ ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ বশর বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে গত দুই মাসে চিনির বুকিং দর টনপ্রতি ১০০ ডলার পর্য়ন্ত কমে গেছে।
নভেম্বরের শুরুতে আন্তর্জাতিক বাজারে টনপ্রতি চিনির বুকিং দর ৬৮০ ডলার ছিল। সেটি এখন ৫৮০ ডলারে নেমে এসেছে বলে জানান তিনি।
চট্টগ্রামের মুদি ব্যবসায়ী মেসার্স জান্নাত স্টোরের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আবছার বলেন, 'আমরা গতকাল মঙ্গলবারেও খাতুনগঞ্জ থেকে প্রতি মণ চিনি কিনেছি ৫ হাজার ১০০ টাকা দামে। চিনির মিল থেকে আমাদের দোকানে আসা পর্যন্ত পরিবহন ভাড়াসহ প্রতি কেজি চিনি কেনা পড়েছে ১৩৮ টাকা দামে, যা আমরা ১৪৫-১৪৮ টাকায় বিক্রি করছি।'
চিনি আমদানির চিত্র
দেশে বছরে কমবেশি ১৮ থেকে ২০ লাখ টন পরিশোধিত চিনির চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় চিনিকলগুলো থেকে সর্বোচ্চ ১ লাখ টন চিনির জোগান আসে বলে উঠে এসেছে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের তথ্যে।
তবে গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) রাষ্ট্রীয় ১৫টি চিনিকলে মাত্র ২১ হাজার ৩০০ টন চিনি উৎপাদিত হয়েছে। অবশিষ্ট চিনির চাহিদা মেটানো হয়েছে আমদানি করে।
চাহিদা ও আমদানি তথ্য অনুযায়ী, দেশের চাহিদা মেটাতে প্রতি বছর প্রায় ৯৮ শতাংশের বেশি চিনি আমদানি করতে হয়।
দেশের পাঁচ শিল্পগ্রুপ—সিটি, মেঘনা, এস আলম, আবদুল মোনেম লিমিটেড ও দেশবন্ধু—চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশ অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে। পরে নিজেদের মিলে পরিশোধন করে এসব চিনি বাজারজাত করে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যমতে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই পাঁচ মিলারসহ ছয় আমদানিকারক ১৯.১৪ লাখ টন চিনি আমদানি করেছে।
আর অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে টনপ্রতি দেড় হাজার টাকা শুল্কছাড় দেওয়ার এই সময়ে ৫০ দিনে পাঁচ মিলার আমদানিকারক ২.৯৬ লাখ টন অপরিশোধিত চিনি আমদানি করেছে। টনপ্রতি দেড় হাজার টাকা শুল্ক ছাড়ের কারণে এই সময়ে ৪৪.৩৪ কোটি শুল্ক কম দিতে হয়েছে পাঁচ আমদানিকারককে।