অতিধনীদের নতুন পন্থায় মানবসেবার নীতিতে আসছে পরিবর্তন
২০২০ সালে, কোভিড-১৯ মহামারীর সময় থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনহিতৈষী কর্মকাণ্ডে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। এই ঘটনা দাতব্য ক্ষেত্রগুলোর পুরনো ত্রুটি তুলে ধরে পরিবর্তনে সাহায্য করছে। এক্ষেত্রে জাতিগত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় প্রতিবাদ এবং ইউক্রেন থেকে শরণার্থীদের আগমন ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে।
আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোসের প্রাক্তন স্ত্রী ম্যাকেঞ্জি স্কটকে এই পরিবর্তনের পথিকৃৎ হিসেবে ধরা হয়। এই সময়টাতে দাতারা তাদের দানের ক্ষেত্রগুলো বিবেচনায় নেয়া শুরু করে এবং অর্থসহ অন্যান্য সাহায্য সামগ্রী বন্টনের বিষয়টিও লক্ষ্য করতে শুরু করে।
২০১৯ সালে বেজোসের সাথে বিবাহবিচ্ছেদের পর আমাজনের ৪ শতাংশ অংশীদারীত্ব লাভ করেন স্কট। যার মূল্য প্রায় ৩৪ বিলিয়ন ডলার। এক্ষেত্রে এই ধনকুবের নারী তার দাতব্য কার্যক্রম চালিয়ে যেতে চান 'যতক্ষণ পর্যন্ত তার ভান্ডার খালি না হয়'।
পুরনো দাতব্য সংস্থাগুলোর আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপরীতে স্কট সম্পূর্ণরূপে 'নো স্ট্রিং গিভিং' অর্থাৎ মনিটরিং কিংবা পর্যালোচনার নামে দান গ্রহীতার সকল সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ না করার অবস্থান গ্রহণ করেন। তিনি আবেদনপত্র পূরণের মতো দীর্ঘসূত্রিতা বাদ দেন।
এক্ষেত্রে দ্রুততম সময়ে মানুষের কাছে সাহায্য পৌছে দেয়ার জন্য কাজ করে চলেছেন স্কট। এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ২০২২ সালের মধ্যে প্রায় ১৬.৫ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা মানুষের কাছে পৌছে দিতে সক্ষম হয়েছেন তিনি।
এর ফলে চাক ফিনির জীবদ্দশায় চার বিলিয়ন ডলার এবং অ্যান্ড্রু কার্নেগির মতো সমাজসেবীদের ৩৫০ মিলিয়ন ডলারের (বর্তমান ৬.২ বিলিয়ন ডলার) অর্থ সাহায্যকে ছাড়িয়ে গিয়েছে ম্যাকেঞ্জি স্কটের সহায়তা।
'অবাধ' অনুদানের এই বিষয়টি নতুন কিছু না। উইলিয়াম ও ফ্লোরা ফাউন্ডেশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এই ব্যবস্থায় তাদের কার্যক্রম চালিয়ে থাকে। এর মাধ্যমে ২০১৫ সালের মধ্যে দুই বিলিয়ন ডলার অনুদান দিয়েছিল তারা।
'অবাধ' অনুদান পদ্ধতিকে জনপ্রিয় করার মাধ্যমে টুইটার এবং স্কয়ারের সহ-প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক ডরসির দেড় বিলিয়ন ডলার তার 'স্টার্ট স্মল ফান্ড' এর মাধ্যমে এবং হোয়াটসঅ্যাপের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ব্রায়ান অ্যাক্টন ও তার স্ত্রী টেগান উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সাহায্য করেছেন।
'জনহিতৈষী পুঁজিবাদের' বিপক্ষে দাতব্য ক্ষেত্রগুলোতে ২০০০ সালের দিকে পরিবর্তন আসে। 'অলাভজনক' এইসব ক্ষেত্রগুলোতে 'জনহিতৈষী পুঁজিবাদ' তাদের বাজারনীতি এবং ব্যবসা পরিচালনা পদ্ধতিগুলোর মাধ্যমে বৈশ্বিক পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলো। কিন্তু আমলাতন্ত্রের জটিলতায় আটকে পড়ে ব্যর্থ হয় এই ব্যবস্থা।
বোনো এবং বব গেল্ডফ সমাজসেবাকে জনপ্রিয় করে তুলতে প্রচেষ্টা চালান। গুগল তাদের লভ্যাংশের এক শতাংশ এবং তাদের ইকুইটির এক শতাংশ মানবসেবায় ব্যয় করতে অঙ্গীকার করেছে।
এক্ষেত্রে ফাউন্ডেশনগুলো এনজিওর প্রজেক্টসমূহ বাস্তবায়নে অনেক সাহায্য করে থাকে। যার মধ্যে মশার জাল গণনা করা অথবা নারী মূল্যায়নের ক্ষেত্রে কাঠামোগত পরিবর্তনে সাহায্য করার মতো বিষয়টিও রয়েছে।
২০০০ সালের মাঝামাঝিতে সমাজসেবার ক্ষেত্রে এই ধরণের পন্থা বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সাবেক সাংবাদিক ম্যাথেউ বিশপের এ বিষয়ে লেখা 'হাউ দ্য রিচ ক্যান সেভ দ্য ওয়ার্ল্ড এন্ড হোয়াই উই শুড লেট দেম' এর প্রথম সংস্করণে উঠে আসে এ পন্থার বেশ কয়েকটি দিক।
পোলিওর মত রোগ দূরীকরণসহ ২০২০ সালে আফ্রিকার বণ্য পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে দ্য বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন।
সমালোচকদের মতে, 'ফিলান্থ্রোক্যাপিটালিজম' বা 'পরহিতৈষী পুঁজিবাদের' প্রক্রিয়া এবং পরিমাপযোগ্য ফলাফলের উপর জোর দেয়া, উদ্ভাবন এবং সমাজসেবার মাধ্যমে সামাজিক উন্নয়নের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। কোভিড মহামারীর বছরখানেক আগে থেকে বড় ফাউন্ডেশনের অর্থ ব্যবস্থাপনা বা বন্টন, এনজিওর গ্রহণনীতি এবং নানা বিশারদদের তদারকি বেশ অসন্তোষের সৃষ্টি করে।
টেম্পলেটন ওয়ার্ল্ড চ্যারিটি ফাউন্ডেশন এর প্রধান অ্যান্ড্রু সেরাজিনের মতে, বড় সহায়তাকারীদের মধ্যে প্রক্রিয়া, প্রশাসনিক দলিলপত্র এবং সবকিছু সংখ্যায় বিচার করার প্রবণতা রয়েছে।
এ সম্পর্কে ভারতীয় সমাজসেবী রোহিনি নিলেকানি বলেন, "অভিজাত ফাউন্ডেশন ভবনে বসে স্থানীয় পর্যায়ে কী প্রয়োজন তা বোঝা সম্ভব না। তাই দাতারা না বরং অর্থ সহায়তা কীভাবে খরচ করা হবে তা গ্রহীতাদের দায়িত্বে থাকা উচিত।"
তবে এসব জনহিতৈষীদের সহায়তা অধিকাংশ সময় অসামঞ্জস্যপূর্ণ। আমেরিকার 'মাইক্রো' বা 'ক্ষুদ্র' দাতাগণ, যারা ১০০ ডলার বা তার থেকে কম সহায়তা করে থাকে তারাই সকল দাতাদের মোট ৬০ শতাংশ পূরণ করে। তবে এর মাত্র ৩ শতাংশই যায় দাতব্য ক্ষেত্রে।
যেসব বড় সহায়তাকারী আছে, যারা ৫০০০০ ডলারের উপর অর্থ সাহায্য দিয়ে থাকে তার মোট ৪৭ শতাংশ ব্যবহৃত হয়েছে দাতব্য ক্ষেত্রসমূহে। গত দুই দশকে ধনীরা আরও ধনী হয়েছে। বিশেষত প্রযুক্তি খাতের ব্যাপক উত্থানের ফলে ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সী বিলিয়নিয়ার সংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
চলতি বছরের ৪ জানুয়ারির হিসেব মতে, পৃথিবীতে ২৫৬২ জনের বিলিয়নিয়ারের মধ্যে আমেরিকাতে রয়েছে ৭৪৬ জন, চীনে ৪৭০ জন এবং ভারতে ১৮০জন।
ফোর্বসের মতে, ২০০৩ সালে আমেরিকার ৪০০ জন ধনী ব্যক্তির মোট সম্পদের পরিমাণ ৯৫৫ বিলিয়ন ডলার (বর্তমান সময়ের হিসাবে ১.৬ ট্রিলিয়ন ডলার) থেকে ২০২৩ সালে তা বেড়ে ৪.৫ ট্রিলিয়ন ডলার হয়েছে। এসব অতি ধনী ব্যক্তিরা তাদের উপার্জনের খুব সামান্যই জনহিতৈষী কাজে ব্যয় করে থাকেন। এদের মধ্যে গত ২০২৩ সালে মিস স্কট, জর্জ সোরোগ, ই-বে এর প্রাক্তন মালিক জেফ স্কলসহ আরও ব্যক্তিবর্গ তাদের সম্পদের মোট প্রায় ২০ শতাংশ সম্পদ দান করেছে জন সেবায়।
এদের মধ্যে যারা দাতব্য কাজে সহায়তা করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে তাদের মধ্যে ৭৩ জন ব্যক্তির, ২০১০ সালে থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সম্পদ ৩৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৮২৮ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
তবে নতুন ট্রাস্টভিত্তিক জনহিতৈষীমূলক পন্থা জনসেবার ক্ষেত্রে গতি এবং কার্যকারিতা বাড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে। আমেরিকান লেখক আনন্দ গিরিধারাসের 'উইনার্স টেক অল: দ্য এলিট শারাড অব চেঞ্জিং দ্য ওয়ার্ল্ড' বইয়ে পুরোনো ধারার জনহিতৈষীমূলক কাজগুলোকে 'স্ববিরোধী' বলেও উল্লেখ করেছেন। যার মধ্যে দিয়ে পারতপক্ষে পরিবর্তন হচ্ছে বলে মনে হলেও আদতে তার কোনো সুফল পাওয়া যায়নি।