টিভি চ্যানেলগুলো সংবাদ পড়ার জন্য এআই উপস্থাপক ব্যবহার করছে, তাদের কি বিশ্বাস করা যায়?
গত কয়েক বছর ধরেই প্রযুক্তি দুনিয়ায় দাপট দেখাচ্ছে এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। প্রযুক্তিটির উত্থান বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ চাকরির জায়গা দখল করার ভীতি তৈরি করেছে। কিছুদিন আগেই জাপানের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ 'আকুতাগাওয়া' সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন দেশটির জনপ্রিয় লেখক রি কুদান। তবে পুরস্কার লাভের পর এই সাহিত্যিক জানান, বইটি লিখতে তিনি বহুল আলোচিত এআই চ্যাটবট চ্যাটজিপিটির সহায়তা নিয়েছেন। খবর বিবিসির।
প্রযুক্তি বিশ্বে সব ক্ষেত্রেই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দৌরাত্ম্য এখন। গণমাধ্যমও এর বাইরে নয়। এআই-এর মাধ্যমে সংবাদ উপস্থাপনার ধারণাটি বিশ্ববাসীর জন্য ইতোমধ্যেই পুরনো খবর।
২০১৮ সালের নভেম্বরে বিশ্বের সর্বপ্রথম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন সংবাদ উপস্থাপনা শুরু করে চীনের সরকারি টেলিভিশন চ্যানেল সিনহুয়া। এরপর ২০১৯ সালে লাটভিয়ার টিভি চ্যানেলে দেখা যায় লরা নামক এআই উপস্থাপককে। এ বছর এপ্রিলে কুয়েত নিউজে দেখা মেলে এআই উপস্থাপক ফেদা'র।
একই মাসে ভারতীয় সংবাদ চ্যানেল আজ তাক-এর স্ক্রিনে দেখা যায় এআই উপস্থাপক সানাকে। সম্প্রতি ভারতের উড়িষ্যার এক টিভি চ্যানেলেও খবর পড়তে দেখা যায় লিসা নামক এআই উপস্থাপককে। এছাড়াও ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ান ও মালয়েশিয়ার টেলিভিশন চ্যানেলে দেখা গেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উপস্থাপক।
আর বাংলাদেশে ২০২৩ সালের ১৯ জুলাই চ্যানেল ২৪-এ প্রথমবারের মতো সংবাদ পাঠ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) প্রেজেন্টার 'অপরাজিতা'।
উদ্যোক্তা অ্যাডাম মোসাম এবং স্কট জাবিয়েলস্কি লস-অ্যাঞ্জেলসে চ্যানেল ওয়ান নামে একটি ভিডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান চালু করেন, যারা এআই দিয়ে সংবাদ উপস্থাপন করেন।
গত ডিসেম্বরে চ্যানেল ওয়ান প্রকাশিত একটি প্রচারমূলক ভিডিওতে দেখা যায়, এআই প্রযুক্তি স্ক্রিপ্ট এবং সাক্ষাৎকারও এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় অনুবাদ করতেও সহায়তা করতে পারে।
কিন্তু এখন যে প্রশ্নটি সবার মনে ঘুরপাক খায় তা হল: দর্শকরা কি মানুষের চেয়ে এআই দিয়ে প্রচারিত সংবাদগুলোকে বেশি বিশ্বাস করবে?
জনমত জরিপ সংস্থা ইপসোসের এক জরিপে দেখা যায়, সংবাদ উপস্থাপনকারী মানুষের ওপর আস্থা সর্বকালের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। যুক্তরাজ্যে মাত্র ৪২ শতাংশ মানুষ টিভি সংবাদ পাঠকদের ওপর আস্থা রাখে, যা এক বছরের ব্যবধানে ১৬ শতাংশ কম। আস্থার এই হ্রাস সত্যের নিরপেক্ষ বাহক হিসেবে সংবাদ উপস্থাপকদের প্রতি ভরসার জায়গায় ফাটল তৈরি করেছে। এই পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া হিসাবে, অনেক ব্যক্তি তাদের সংবাদের জন্য 'সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার'দের মতো বিকল্প উৎসসমূহের দিকে ঝুঁকছেন।
সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সাররা তাদের শ্রোতাদের সাথে সংযোগ স্থাপনের জন্য প্যারাসোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্স নামে একটি পদ্ধতি ব্যবহার করেন। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিদরা ১৯৫০-এর দশকে এ পদ্ধতি সম্পর্কে প্রথম ধারণা দেন।
প্যারাসোশ্যাল সম্পর্ক দ্বারা মূলত দর্শকদের এই উপলব্ধিকে বোঝায় যে, নিউজ অ্যাঙ্কর বা উপস্থাপকরা ক্যামেরার মাধ্যমে সরাসরি তাদের সাথে কথা বলছেন। এই উপলব্ধি দর্শকদের কাছে সংবাদ উপস্থাপকদের নিছক একজন সাংবাদিক থেকে তথ্য সরবরাহকারী পরিচিত ব্যক্তিত্বে রূপান্তরিত করে, যারা প্রত্যেক রাতে দর্শকদের বসার ঘরে স্বাগত জানায়, বন্ধুত্ব এবং ঘনিষ্ঠতার অনুভূতি জাগিয়ে তাদেরকে নিত্যনতুন খবর সরবরাহ করে।
সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সাররা শ্রোতাদের সাথে দৃঢ় সংযোগ তৈরি করতে এ 'ডাইরেক্ট-টু-ক্যামেরা' পদ্ধতিটি কার্যকরভাবে গ্রহণ করেছে। মূলত, 'প্যারাসোশ্যাল' সম্পর্কগুলো দ্বারা দূরবর্তী সংবাদ পাঠকের সাথে সংযোগকে বোঝালেও, এখন এ পদ্ধতি সাংবাদিক, স্ট্রিমার, ইউটিউবার, গায়ক এবং ইনস্টাগ্রাম ইনফ্লুয়েন্সাররাও ব্যবহার করছে।
তবে এআই মানুষের মতো দর্শকদের সাথে ব্যক্তিগত সংযোগ তৈরি করতে পারে কি-না তা এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। মোসাম শ্রোতাদের সাথে সত্যিকারের সংবেদনশীল বন্ধন গড়ে তুলতে এআইয়ের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে বলেন, 'আপনি কখনই এআইয়ের সাথে একই ধরনের মানসিক সংযোগ পাবেন না যা আপনি একজন রক্ত মাংসের গড়া মানুষের সাথে পেয়ে থাকেন।'
তবে ডিজিটাল স্বত্তা দ্বারা পাঠকৃত সংবাদকে পুরোপুরি অস্বাভাবিক বলা যাবে না। কারণ সংবাদ পাঠ সবসময় যে একজন সাংবাদিককেই করা লাগবে এমনটা নয়। এ পেশার বাইরেও অনেকের সংবাদ পাঠের উদাহরণ আছে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়টার্স ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অফ জার্নালিজমের সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট এবং বিবিসির প্রাক্তন সম্পাদক নিক নিউম্যান উল্লেখ করেছেন যে, অতীতে অভিনেতারা প্রায়শই সংবাদ পাঠ করতেন এবং দর্শকরা এই ব্যাপারটি খুব স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করেছিলেন।
নিউম্যান বিশ্বাস করেন যে, এআই প্রেজেন্টারের পাঠ করা সংবাদের গ্রহণযোগ্যতা আছে। তবে এটি সম্ভবত সংক্ষিপ্ত সংবাদ বুলেটিনগুলোর জন্যই সবচেয়ে বেশি কার্যকর হবে।
তিনি এআই উপস্থাপকের সাথে দর্শকদের পুরোপুরি প্যারাসোশ্যাল সম্পর্ক কার্যকরভাবে কাজ করবে কি-না তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন। নিউম্যান সংবাদ সরবরাহে মানব অংশগ্রহণের গুরুত্বের ওপর জোর দিয়ে বলেন, 'সংবাদ অনুষ্ঠান পরিবেশনের ক্ষেত্রে আমি মনে করি মানব স্পর্শ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।'
টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এবং ল্যাবার' বিভাগে অধ্যয়নরত ক্রিস্টিন এইচ ট্র্যান প্রশ্ন করেছেন, শ্রোতারা এআই-সৃষ্ট ব্যক্তিত্বকে আলাদাভাবে উপলব্ধি করবে কি-না যদি তারা বুঝতে পারে যে তারা মানুষের পরিবর্তে একটি কৃত্রিম সত্তার সাথে যোগাযোগ করছে।
তিনি বলেন, 'এটা এখনও অজানা যে, এআই অবয়ব দ্বারা সৃষ্ট সংবাদগুলোকে কি মানুষ একইভাবে গ্রহণ করবে? যখন সে এটা জানে যে স্ক্রিনের বাইরে এর কোনো অস্তিত্ব নেই!'
'চ্যানেল ওয়ান' এবং 'নিউজজিপিটি' দাবি করে যে, তারা বিশ্বের প্রথম সম্পূর্ণ এআই চালিত সংবাদ মাধ্যম। কিন্তু এরপরেও সংবাদ উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে মানুষের সম্পৃক্ততা সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করা সম্ভব কি-না তা নিয়ে এখনও প্রশ্ন থেকে যায়। কারণ এখনও চ্যানেল ওয়ানের প্রায় এক ডজন কর্মী রয়েছেন যারা এআই সৃষ্ট স্ক্রিপ্টগুলো পরীক্ষা করেন এবং গল্পগুলো বাছাই করেন।
মোসান জানান, কোনো সংবাদ প্রচারের আগে ১৩টি ধাপের মাধ্যমে এর প্রতিটি গল্প পর্যালোচনা করা হয় যাতে এআই সৃষ্ট সংবাদে যাতে কোনো অবাস্তব, কাল্পনিক ঘটনা না থাকে। এ ছাড়া শিগগিরই প্রধান সম্পাদক নিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির।
তবে মোসান এবং নিউম্যান স্বীকার করেছেন যে, এআই গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ ইভেন্টগুলো শনাক্ত করতে এবং তাদের ওপর কার্যকরভাবে প্রতিবেদন তৈরি করার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে। চ্যানেল ওয়ানের টেস্ট এপিসোডগুলোতে আসল সাংবাদিকরাই সংবাদ সংগ্রহ ও ফুটেজ সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
নিউম্যান আরও জানান, সংবাদ সরবরাহে এখনও মানব অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি ছাড়া এআইয়ের সাথে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানের অভাব রয়েছে।
মোসান উল্লেখ করেছেন, এআই রিপোর্টিংয়ের কিছু দিক যেমন- ড্রোন ফুটেজ বিশ্লেষণ করতে পারে। তবে এটি এখনও গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ বা সরাসরি সাক্ষাৎকার পরিচালনার মতো কাজগুলোতে মানুষকে প্রতিস্থাপন করতে পারে না। ফলে চ্যানেল ওয়ান বর্তমানে মানুষের সম্পৃক্ততা ছাড়া সংবাদ সংগ্রহের জন্য শুধু এআইয়ের ওপর নির্ভর করার পরিকল্পনা করছে না।