মিয়ানমারের ছোড়া গোলার আঘাতে বাংলাদেশে নিহত ২, আতঙ্কে ঘরছাড়া বহু মানুষ
সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, মিয়ানমারের ছোড়া মর্টার শেলের আঘাতে ঘুমধুম সীমান্তের জলপাইতলীর বাসিন্দা হোসনে আরাসহ (৬০) দুজন নিহত হয়েছেন।
ঘটনাস্থল থেকে আমাদের প্রতিনিধি জোবায়ের চৌধুরী জানান, সোমবার দুপুর ২টা ২০ মিনিটে বাদশা মিয়ার বাড়িতে একটি মর্টার শেল এসে পড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই এক রোহিঙ্গা শ্রমিক (৫৫) নিহত হন। আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান হোসেন আরা। তিনি স্থানীয় ব্যবসায়ী বাদশা মিয়ার স্ত্রী। ওই রোহিঙ্গা ব্যক্তি ওই বাড়িতে দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে কাজ করতেন। তার পরিচয় জানা যায়নি।
ভাত খাওয়ার সময় পড়ল মিয়ানমারের ছোড়া মর্টার শেল
নিহত হোসনে আরার খালাত ভাই শাহ আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'রান্নাঘরে ওই রোহিঙ্গা শ্রমিককে আমার বোন ভাত খেতে দিয়েছিলেন। ঠিক সেই সময় বিকট একটি শব্দ শোনা যায়। এতে ঘটনাস্থলেই ওই শ্রমিক নিহত হন। আহত অবস্থায় আমার বোনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান।
ঘুমধুম ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের সদস্য আনোয়ারুর ইসলাম জানান, সোমবার দুপুরে নিজ ঘরে ভাত খাচ্ছিলেন হোসনে আরা। এ সময় তার বাড়িতে গোলা আঘাত হানে।
স্থানীয় ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর আজিজ সাংবাদিকদের বলেন, 'দুজনের মৃত্যু হয়েছে। আমরা প্রশাসনকে জানিয়েছি। এলাকার মানুষেররা অনেকে নিরাপদে সরে যাচ্ছেন। প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল মান্নান জানান, মরদেহ এখনও ঘটনাস্থলে রয়েছে। মরদেহ উদ্ধারে সেখানে পুলিশ ও বিজিবি সদস্যরা গেছে। এ ঘটনায় প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
র্যাব-১৫ এর সহকারী পরিচালক মো. আবদুস সালাম চৌধুরী বলেন, 'বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সঙ্গে র্যাব সতর্ক রয়েছে। এটি মিয়ানমারে অভ্যন্তরীণ সংঘাত। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিষয়গুলো অবগত করা হচ্ছে। সদর দপ্তরের নির্দেশনা অনুযাযী কাজ করব।'
ঘুমধুম এলাকায় আজ ভোর থেকে থেমে থেমে গোলাগুলি চলছিল। দুপুর ৩টা পর্যন্ত ঘুমধুম এলাকার মিয়ানমার সীমান্তেও ওপারে ঢেঁকিবনিয়া বিজিপি ক্যাম্পে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। মিয়ানমার সীমান্তে হেলিকপ্টার থেকেও গুলিবর্ষণ করা হচ্ছে। এতে সীমান্তবাসী আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে।
আতঙ্কে ঘরছাড়া বহু মানুষ
মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের জেরে সীমান্তবর্তী জেলা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু বাজার এলাকার কোনারপাড়ার বাসিন্দা আবুল কালাম (৭০) গত শনিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) থেকে সপরিবারে ঘরছাড়া। ঘরবাড়িতে মর্টার শেল ও গুলি এসে পড়ায় পরিবারের নারী ও শিশুদের এক মাইল দূরে ঘোনাপাড়া এলাকায় ভাগ্নির বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন তিনি। তবে গৃহপালিত পশু, জমি ও ঘরবাড়ি দেখাশোনার জন্য তিনি আশেপাশে থাকলেও আতঙ্কে বাড়ি ফিরতে পারছেন না।
সোমবার সকাল ১১টা ২২ মিনিটে আবারও মিয়ানমার সেনাবাহিনী হেলিকপ্টারে করে আরাকান আর্মির ওপর হামলা চালালে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়। তার কিছুক্ষণ আগেই বাড়িতে গিয়েছিলেন আবুল কালাম। কিন্তু গোলাগুলির শব্দে আতঙ্কিত হয়ে আবারও বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান তিনি।
এ অবস্থা কেবল আবুল কালামেরই নয়, তার মতো এভাবেই ঘর-বাড়ি ছেড়ে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন ঘুমধুম ইউনিয়নের কোনারপাড়া, হিন্দুপাড়া, পশ্চিমকুল, উত্তরপাড়া ও মধ্যমপাড়ার বহু বাসিন্দা। নিরাপত্তার কথা ভেবে তারা পরিবারের অন্য সদস্যদের কক্সবাজারের উখিয়ায় পাঠিয়ে দিয়েছেন।
স্থানীয়রা জানান, গত শনিবার রাত ৩টায় ঢেঁকিবনিয়ার পাশে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) তুমব্রু রাইট ক্যাম্প দখলকে কেন্দ্র করে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে গোলাগুলি শুরু হয়। তুমব্রু রাইট ক্যাম্প সীমান্তচৌকিটি বাংলাদেশের বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার লোকালয়ের খুব কাছাকাছি। ঢেঁকিবনিয়া সীমান্তচৌকি থেকে বাংলাদেশের লোকালয়ের দূরত্ব প্রায় ৮০০ মিটার। এ কারণে তুমব্রু রাইট ক্যাম্পে গোলাগুলির সময় বাংলাদেশের বসতঘরে গুলি ও মর্টার শেল এসে পড়েছে।
শনিবার মধ্যরাত থেকে শুরু হওয়া সংঘাত চলে রবিবার (৪ ফেব্রুয়ারি) বিকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত। এরপর আবার রাত ১১টার পর থেকে সারারাতই থেমে থেমে সংঘাত চলেছে। আজ সোমবার (৫ ফেব্রুয়ারি) সকাল ৮টার পরও কিছু সময়ের জন্য সংঘর্ষ হয়েছে।
সোমবার সংঘাত থামার খবরে আজ সকাল সাড়ে ১০টার পর কোনারপাড়ায় নিজ বাড়িতে ফেরেন ৪৫ বছর বয়সী দিল খুশ বেগম। বাড়িতে এসে দেখেন তার ৮টি মুরগী মারা গেছে। পরে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ঘর-বাড়ি পরিষ্কার শুরু করেন। সকালে আবারও গোলাগুলি শুরু হলে ফের পালিয়ে যান তিনি।
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমরা খুব আতঙ্কে আছি। ঘর-দুয়ার ফেলে যাযাবর জীবন পার করছি। আমাদের এখানে এক প্রকার যুদ্ধ হচ্ছে।'
একই এলাকার বাসিন্দা মো. ইউনুছ। শনিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে মর্টার শেল পড়ায় তার ঘরের ছাদ ফেটে যায়। তবে তার পরিবারের কেউ আহত হননি। ওই রাতেই তিনি পরিবারের মোট ১৯ সদস্যকে উখিয়ায় পাঠিয়ে দেন। সোমবার সকাল ১১টার দিকে বাড়িতে এলেও গোলাগুলির শব্দে আবারও পালিয়ে যান তিনি।
মো. ইউনুছ টিবিএসকে বলেন, 'দেখছেনই তো, কীভাবে দিন পার করছি। আমাদের দেশে যুদ্ধ না হলেও আমরা বাড়ি ছাড়া।'
স্থানীয়রা জানান, কোনারপাড়ার ৩৪টি পরিবারের দুই শতাধিক মানুষ ঘরছাড়া। তারা আশপাশে আত্মীয়স্বজনদের বাড়ি আশ্রয় নিয়েছেন। এছাড়াও হিন্দুপাড়া, পশ্চিমকুল, উত্তরপাড়া ও মধ্যমপাড়ার শতাধিক পরিবার ঘরছাড়া।
তুমব্রু বাজারের নবী হোসাইন নামে এক দোকানি টিবিএসকে বলেন, 'থেমে থেমে গোলাগুলির কারণে সবাই আতঙ্কিত। আমরা দোকান খুলেছি। নাস্তা বানাচ্ছি। মানুষজন বাড়ি যায়। হেলিকপ্টারের শব্দ শুনলে আবার দোকানে এসে আশ্রয় নেয়।'
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য দিল মোহাম্মদ ভুট্টো টিবিএসকে বলেন, 'সীমান্তঘেঁষা এলাকার বাসিন্দারা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে। আমরা এখন পর্যন্ত সরকারি নির্দেশনা বা সহায়তা পাইনি। লোকজন নিজ দায়িত্বে নিরাপদে চলে গেছে। এখনও মানুষ আতঙ্কে দিন পার করছে।'
মিয়ানমারের বিদ্রোহী দল আরাকান আর্মির সঙ্গে সংঘর্ষের মধ্যে দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) মোট ১০৬ সদস্য বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) তাদের নিরস্ত্র করে আশ্রয় দিয়েছে। যারা আহত হয়েছেন তাদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
বিজিবির সদর দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরিফুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'রবিববার সকাল থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত মোট ৯৫ জন বিজিপি সদস্য বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এ ব্যাপারে পরবর্তী কার্যক্রম চলমান রয়েছে।'