মিয়ানমার সীমান্তরক্ষীদের দলে দলে পালিয়ে আসার ঘটনায় বিস্মিত সীমান্ত এলাকাবাসী
"এত বছর দেখেছি, সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হামলার ভয়ে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষ বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে ঢোকে। এবার আরাকান আর্মির হামলা থেকে বাঁচতে দেশটির বর্ডার গার্ড পুলিশ-বিজিপির সদস্যরা বাংলাদেশে ঢুকছেন। আমরা তো কখনই এমন পরিস্থিতি দেখিনি। আমাদের বাপ-দাদারাও দেখেনি।"
বুধবার (৭ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব আবদুল গফুর (৬০) দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে কথাগুলো বলছিলেন। এর আধঘন্টা আগেই মিয়ানমার সীমান্ত পারি দিয়ে আসা বিজিপির ৬৩ সদস্যকে স্থানীয় বিজিবি ক্যাম্পে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। এখানে ভিড় করেছেন স্থানীয়রা। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন আদুল গফুরও।
মিয়ানমারের শক্তিশালী জান্তা সরকারকে বড় রকমের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করছে দেশটির আরাকান রাজ্যের সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান আর্মি। গত তিন দিনের সংঘাতে দেশটির সীমান্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে সরকার। আর প্রাণে বাঁচতে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের প্রবেশ করেছেন ৩২৮ জন বিজিপি, কাস্টমস কর্মকর্তা ও সেনা সদস্য। গত রোববার (৪ ফেব্রুয়ারি) ভোর থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছেন তারা। এখনো তাদের অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে।
হোয়াইক্যং ইউনিয়নের কেরেমতলী গ্রামের বাসিন্দা বশির আহম্মদ (৬৫) পালাংখালী বাজারে কাঁচা সবজির ব্যবসা করেন। তিনিও দেখতে এসেছেন বিজিপির সদস্যদের। টিবিএসকে বশির বলেন, "গত পরশু রাত থেকে এখানকার সীমান্তে গোলাগুলি চলছে। আজ ১২টায় খবর পেয়েছি, বিজিপি বর্ডার পারি দিয়ে আসছে। তাই তাদের দেখতে এসেছি।"
"একটি দেশের মিলিটারিরা অস্ত্রশস্ত্র থাকার পরও পালিয়ে পালিয়ে আসছেন– এটি আসলেই বিস্ময়ের" বলেন তিনি। পাশ থেকে আরেক স্থানীয় বাসিন্দা নুরুল ইসলাম (৫৩) বলেন, "প্রাণের ভয়েই তারা পালিয়ে এসেছে। আহত অবস্থায়ও অনেকে এসেছে। তাদের এছাড়া কিছু করার নেই।"
একই এলাকার মাছের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ লালু (৪৫) টিবিএসকে বলেন, "পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ, তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। বিজিপি সদস্যরা অস্ত্রশস্ত্রসহ পালিয়ে আসছেন। এর মানে তারা কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। তাদের যখন ওই দেশে পাঠানো হবে, তখন পালিয়ে যাওয়ার অপরাধে জেল হবে। এরপরও তারা প্রাণের ভয়ে পালিয়ে আসছেন।"
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তমব্রু বাজারের পাশ্ববর্তী কোনারপাড়ার বাসিন্দা আবু সিদ্দিক (৭৩) গত ঘর ছেড়েছেন শনিবার সীমান্তে গোলাগুলি বেড়ে যাওয়ার পর। তিনি টিবিএসকে বলেন, "এমন পরিস্থিতি আর দেখিনি। এর আগে ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় পালিয়ে আরাকানে আশ্রয় নিয়েছিলাম। এরপর এবারই প্রথম ঘরছাড়া।"
উখিয়ার হলাদিয়া পালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইমরুল কায়েস চৌধুরী মন্তব্য করেন, "এটি আসলে মিয়ারমারের জন্য লজ্জার। জান্তা সরকার যে দুর্বল, আবারো তা প্রমাণিত হলো।"
গত চার দিন ধরে সীমান্তে সংঘাত চলছে। মিয়ানমার থেকে ছুটে আসা গোলাগুলিতে সোমবার বাংলাদেশ দুজন নিহতও হয়েছেন। মঙ্গলবার আরো ৫ জন আহত হন। এপর্যন্ত মোট ১০ বাংলাদেশি আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সংঘাতের কারণে ঘুমধুম সীমান্তের বহু মানুষ ঘড় ছাড়া।
বান্দরবান জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, সীমান্তবর্তী ঘুমধুম এলাকার প্রায় ২৪০ পরিবার নিরাপদে সরে গিয়েছেন। আরাকান আর্মির হামলা থেকে বাঁচতে মঙ্গলবার পর্যন্ত মিয়ানমারের জান্তা সরকারপন্থী ৩২৭ জন বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। এরমধ্যে বেশিরভাগ দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির সদস্য। একজন সেক্টর কমান্ডারও আছেন বলে জানা গেছে। এছাড়া কাস্টমস কর্মকর্তা, সেনা সদস্য ও সাধারণ নাগরিকও আছে।
শনিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন বিজিপি শিবির দখলকে কেন্দ্র করে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী দলগুলোর সংঘর্ষ চলছে। ক্রমাগত গুলি, মর্টার শেল ও রকেট বিস্ফোরিত হচ্ছে। মিয়ানমার থেকে আসা গোলায় বাংলাদেশের বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় এক বাংলাদেশিসহ দুজন নিহত হয়েছেন। বাংলাদেশের সীমান্তে দুজন নিহত হওয়ার পর স্থানীয়দের মধ্যে ক্রমশ আতঙ্ক বাড়তে থাকে। সোমবার ও মঙ্গলবার গোলাগুলি বেশি থাকলেও বুধবার কিছুটা কম। এপর্যন্ত ঘুমধুম ইউনিয়নের ১৮০ পরিবার নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে বাড়ি ছেড়েছেন। সংঘর্ষের জেরে সীমান্ত-লাগায়ো বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত শনিবার দিবাগত রাত ৩টা থেকে ঢেঁকিবনিয়ার পাশে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) তুমব্রু রাইট ক্যাম্প দখলকে কেন্দ্র করে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরকান আর্মির সঙ্গে গোলাগুলি শুরু হয়। তুমব্রু রাইট ক্যাম্প সীমান্তচৌকিটি বাংলাদেশের বান্দরবানের নাইক্ষ্যাংছড়ি উপজেলার লোকালয়ের একদম কাছাকাছি। ঢেঁকিবনিয়া সীমান্তচৌকি থেকে বাংলাদেশের লোকালয় প্রায় ৮০০ মিটার দূরে। ঢেঁকিবনিয়া ও ঘুমধুমের মাঝখানে নাফ নদীর সরু একটি শাখা ও প্যারাবন রয়েছে। এ কারণে তুমব্রু রাইট ক্যাম্পে গোলাগুলির সময় বাংলাদেশের বসতঘরে গুলি ও মর্টার শেল এসে পড়েছে।
থাইল্যান্ড থেকে প্রকাশিত মিয়ানমারের গণমাধ্যম দ্য ইরাবতীর প্রতিবেদন অনুসারে, গত চার দিনে রাখাইনে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বেশিরভাগ ঘাঁটি আরাকান আর্মি দখল করে নিয়েছে। পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফ) এবং সশস্ত্র সংগঠনগুলো মিয়ানমারের বিভিন্ন অঞ্চল ও রাজ্য, সাগাইং, মগওয়ে এবং মান্দালয় অঞ্চলের পাশাপাশি কাচিন ও কারেন রাজ্যে সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে তাদের হামলা জোরদার করার কারণে এই হতাহতের ঘটনা ঘটছে।
(উখিয়া-ঘুমধুম সীমান্ত থেকে জানিয়েছেন টিবিএসের প্রতিবেদক জোবায়ের চৌধুরী)