টাঙ্গাইল শাড়ি থেকে জামদানি: জিআই নিয়ে যত কথা
বাংলায় একটি চমৎকার বাগধারা আছে, 'ডিম পাড়ে হাঁসে, খায় বাগডাশে'। এই হাঁস আর বাগডাশের টানাটানিই যেন বাস্তব হয়ে ধরা দিল ডিম, অর্থাৎ টাঙ্গাইল শাড়িকে ঘিরে। এক ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার, বাংলাদেশের বিখ্যাত 'টাঙ্গাইল শাড়ি'কে নিজস্ব জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়। ভারতের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় তাদের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক পোস্টে বলে, 'টাঙ্গাইল শাড়ি পশ্চিমবঙ্গ থেকে উদ্ভূত। এটি ঐতিহ্যবাহী হাতে বোনা মাস্টারপিস। এর মিহি গঠন, বৈচিত্র্যময় রং এবং সূক্ষ্ম জামদানি মোটিফের জন্য বিখ্যাত। এটি এ অঞ্চলের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক।'
ব্যস! শুরু হলো শোরগোল, 'টাঙ্গাইল শাড়ি' কী করে পশ্চিমবঙ্গের হয়, তা নিয়ে রীতিমতো তোলপাড় হয়ে গেল। কেউ দুষছে ভারতকে, কেউ নিজেদের অবহেলাকে। তবে অবশেষে গত বুধবার বাংলাদেশী জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে টাঙ্গাইল শাড়ি। ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে এ স্বীকৃতি দিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেড মার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি)। ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল তাঁতের শাড়ির জিআই স্বত্ব পেতে ৬ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসক কায়ছারুল ইসলাম পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেড মার্কস অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর আবেদন করেন। কিন্তু কাজ এখানেই শেষ নয়। ভারতের টাঙ্গাইল শাড়ির দাবির বিরুদ্ধে আপিল করতে হবে।
যে স্বীকৃতিকে ঘিরে এত কিছু, তা হলো 'ভৌগোলিক নির্দেশক' বা জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেটর (জিআই)। জামদানি শাড়ি থেকে শুরু করে কুষ্টিয়ার তিলের খাজা কিংবা টাঙ্গাইল শাড়ি নিয়ে টানাটানি, বুঝতে হবে কেন এই স্বীকৃতি গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে এটি নিজস্বতার স্বীকৃতি, অন্যদিকে রয়েছে অর্থনৈতিক গুরুত্ব। কাজেই জেনে নেওয়া যাক, ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই স্বত্বের আদ্যোপান্ত।
জিআই স্বত্ব
ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই স্বত্ব হলো কোনো ভৌগোলিক অঞ্চলের কোনো পণ্যকে তাদের নিজস্ব পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া। কোনো পণ্যের উৎপত্তিস্থল যদি ওই ভৌগোলিক অঞ্চল হয়, সে দেশের পরিবেশ, আবহাওয়া ও সংস্কৃতি যদি কোনও একটি পণ্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখে; সেই সাথে, ভৌগোলিকভাবে ও ঐতিহ্যগতভাবে যে পণ্যগুলোকে 'নিজস্ব' হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যায়, তাহলে সেটিকে ওই দেশের 'ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য' হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। পণ্যের গুণগত মান, স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও খ্যাতির সাথে এর উৎপত্তিস্থলের সরাসরি সম্পর্কের ভিত্তিতে এ স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ববিষয়ক সংস্থা 'ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস অর্গানাইজেশন (ডব্লিউআইপিও)'-এর নিয়ম মেনে এ স্বীকৃতি ও সনদ দেওয়া হয়। নিয়ম অনুযায়ী, কৃষিপণ্য, প্রকৃতি থেকে আহরিত সম্পদ ও কুটির শিল্পকে এ সনদ দেওয়া হয়ে থাকে। সনদটি পণ্যের মেধাস্বত্বের আইনি সুরক্ষার পাশাপাশি এটি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের অধিকার দিয়ে থাকে। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ২০১৩ সালে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন হয়। এরপর ২০১৫ সালে জিআই পণ্যের নিবন্ধনের আবেদনপত্র নিতে আহবান জানায় ডিপিডিটি। তথ্য-প্রমাণসহ জমা দেওয়া আবেদনপত্র যাচাইয়ের ভিত্তিতে জিআই সনদ প্রদান করা হয়।
আবেদন প্রক্রিয়ায় রয়েছে নানা ধাপ এবং এর যেকোনো ধাপে জটিলতা দেখা দিলে রয়েছে আবেদন বাতিল হবার সম্ভাবনা। আবেদনের কাগজপত্র পরীক্ষার পর যদি দেখা যায় যে সব ঠিক আছে, তখন তা জার্নালে প্রকাশ করা হয়। জার্নালে প্রকাশ হওয়ার পর দুই মাসের মাঝে যদি কেউ এগুলোর বিরোধিতা করে এবং সেই অভিযোগ খণ্ডানোর মতো যথেষ্ট প্রমাণ না থাকে, তাহলেও তা বাদ যেতে পারে।
স্বতন্ত্রতার পরিচায়ক
প্রতিটি ভৌগোলিক অঞ্চলের মানুষ, আবহাওয়া, সংস্কৃতি ও পরিবেশের রয়েছে নিজস্বতা। আর তার সবকিছুকে ধারণ করে জিআই পণ্য। নিজস্ব কাজের ধারা, কাঁচামাল ব্যবহারের মাধ্যমে এসব পণ্য তৈরি করা হয়। কাজেই একদিকে সে পণ্য ধারণ করে স্নেহের ঋণ, পণ্যটিও তাদের জীবনযাপনের অপরিহার্য অংশ হয়ে ওঠে। সাংস্কৃতিক গুরুত্ব বহনের মাধ্যমে জিআই পণ্য বিভিন্ন প্রজন্মের জন্য নিজেদের নিজস্ব পণ্য ধরে রাখতে উৎসাহিত করে।
জিআই স্বত্ব এর পণ্য তৈরির চিরায়ত পদ্ধতির একটি নিয়ম সংরক্ষণ করে যার ফলে একটি পণ্যের নিজস্ব ধারা সংরক্ষিত হয়। যখন একজন কারিগর দেখবেন, বিশ্বব্যাপী তার কাজের কদর করা হচ্ছে, তখন তিনি তার পরবর্তী প্রজন্মের হাতেও তার কাজের ধারা ছড়িয়ে দেবেন। যা একটি জাতির নিজস্বতা বাঁচিয়ে রাখতে সহায়ক।
বাজার সৃষ্টি
জিআই পণ্যের নিজস্ব পরিচয় বিশ্বব্যাপী এর ব্র্যান্ডিংয়ে নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি করে। একজন ভোক্তা নিজস্বতাসম্পন্ন যেকোনো পণ্যের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয় এবং তার যথাযথ মূল্য দিতে আগ্রহী হয়। পণ্যের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য তাকে আগ্রহী করে তোলে। এর ফলে এ ধরণের পণ্যের ব্র্যান্ডিং এর মাধ্যমে তা সবার কাছে পৌছানোর সু্যোগ তৈরি হয়।
এর প্রতিফলন দেখা যায় বিগত কয়েক বছরে জামদানি শাড়ির বাজারের দিকে তাকালে। কানের গালিচা হোক বা বিয়ের শাড়ি, সবখানে দেশি জামদানির জয়জয়কার। আন্তর্জাতিক বাজারে ভালো দাম পেতে দেশীয় হেরিটেজ ম্যাটেরিয়ালের (জামদানি) ফ্যাশন আইটেম তৈরির কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)। ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি ও বৈশ্বিক পোশাক বাজারের ১২ শতাংশ দখলের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এই উদ্যোগ নিয়েছে বিজিএমইএ। এসব অনেকটাই সম্ভব হয়েছে জামদানির জিআই পণ্যের স্বীকৃতিকে ঘিরে।
গ্রামীণ উন্নয়ন
অধিকাংশ জিআই পণ্য কৃষিজ ও কুটিরশিল্পকেন্দ্রিক। জিআই পণ্যের নিজস্বতা এবং এর ফলে যে বাজার সৃষ্টি হয়, তাতে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হতে পারে এ পণ্যের কাঁচামাল সরবরাহকারী ও কারিগররা। যখন একটি পণ্যের গুণগত মান ও প্রকৃত পণ্যটির প্রতি বাজার আকৃষ্ট হয়, তখন আসল পণ্যের চাহিদা বাড়বে।
জিআই পণ্যের গুণগত মান রক্ষার আইনের মাধ্যমে এর কমদামি, নিম্নমানের পণ্য তৈরি কমে গিয়ে প্রকৃত কারিগরদের কদর বাড়বে। এখানে ব্যবসায়ীদের নিম্নমানের পণ্যের বাজারের রাজত্ব তৈরি হবে না, নিয়ন্ত্রিত হবে। একদম প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষেরও বাণিজ্যিকীকরণ ও অর্থনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের সু্যোগ তৈরি হচ্ছে। এক্ষেত্রে ঐতিহ্যবাহী কুটিরশিল্পও আধুনিক ব্র্যান্ডিং এর স্পর্শে সর্বস্তরে পৌছে যেতে পারছে, যা গ্রামীণ অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন আনতে পারে।
জিআই পণ্যগুলো তৈরির বিভিন্ন ধাপে নারীদের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। নারিকেল নাড়ু হোক বা নকশীকাঁথা, বাংলার নারীরা খুব সহজে, গল্পে গল্পে কাজগুলো করে থাকেন; কিন্তু এর মাধ্যমে সামগ্রিক অর্থনীতিতে পিছিয়ে পড়া নারীরাও জিআই পণ্য উৎপাদনে সহায়ক হতে পারছেন।
জিআই স্বত্ব: কেন এত শোরগোল
বাসমতী চাল—সুগন্ধী এই চাল যেন রীতিমতো ত্রিমুখী আইনি যুদ্ধ বাধিয়ে রেখেছে ভারত-পাকিস্তান-নেপালের মধ্যে। আবার, বিতর্ক উঠেছে বাংলাদেশ-ভারতের টাঙ্গাইল শাড়িকে ঘিরে। এ তো নতুন নয়। ফজলি আম, নারকেলের মোয়া, সুন্দরবনের মধু, রসগোল্লা এবং নকশীকাঁথার জিআই স্বত্ব ভারতের হয়েছে। সারাবিশ্বে জিআই স্বত্ব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর সাথে রয়েছে ভূরাজনীতির মারপ্যাঁচ, অর্থনৈতিক নানা সমীকরণ।
যেকোনো দেশ বা অঞ্চলকে নিজস্বতা দান করে তার স্বতন্ত্রতা। জিআই পণ্যগুলো দেশটির স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ। জিআই স্বত্ব হারানো মানে নিজস্বতার স্বীকৃতি, নিজেদের ঐতিহ্যকে হারিয়ে ফেলা। এ অঞ্চলের মায়েদের নিজ হাতে পরম যত্নে দীর্ঘ বছর ধরে বানানো নারিকেল মোয়া, আনন্দ-দুঃখের গল্পকে ঘিরে বোনা নকশী কাঁথা অন্য কারও হয়ে যাওয়া হচ্ছে নিজেদের পরিচয় হারানো। এজন্য জিআই স্বত্ব হয়ে ওঠে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও ভূ-রাজনীতির অংশ।
বাংলাদেশের জিআই
ভাবুন তো, ভিনদেশে বসে বসে কেউ রঙিন মোড়কের প্যাকেট খুলে কুষ্টিয়ার তিলের খাজার মিষ্টিতে কামড় বসিয়ে নস্টালজিয়ায় শৈশবের সেসব দিনের কথা ভাবছে; যখন সে মায়ের কাছে খুচরো পয়সার খুচরো বায়না করত তিলের খাজা খাওয়ার। জিআই যে সুযোগটা করে দিচ্ছে, তা হলো দেশীয় পণ্যের আন্তর্জাতিকীকরণ ও ব্র্যান্ডিংয়ের। জিআই পণ্যের ব্র্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে আমরা আমাদের এই চেনা-পরিচিত পণ্যগুলোকেই দেশ-বিদেশে পৌঁছে দিতে পারছি।
বাংলাদেশের মোট ২১টি পণ্য জিওগ্রাফিক্যাল আইডেন্টিফিকেশন (জিআই) বা ভৌগোলিক নির্দেশক হিসেবে নিবন্ধিত এবং নতুন করে মোট ১৪টি পণ্যের জন্য আবেদন জমা পড়েছে। ২০২৪ সালে যেন জিআই পণ্য ১০০টি অতি ক্রম করে, এই আশা ব্যক্ত করে বিবিসি বাংলার একটি প্রতিবেদনে ডিপিডিটি মহাপরিচালক মো. মুনিম হাসান বলেন, 'জিআই আইন হওয়ার পর থেকে যে কটা আবেদন আমরা পেয়েছি, গত এক বছরে সেটা বেড়েছে। গত চার মাসে ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসক ও কমিশনারের কাছে চিঠি দিয়েছি আমরা। তাদেরকে আমরা বলেছি যে আপনার এলাকায় কী কী জিআই পণ্য আছে, সেটা নিয়ে আমাদের কাছে অ্যাপ্লাই করেন। আমরা আপনাদের সহায়তা করব। এসব উদ্যোগের কারণেই অগ্রগতি হয়েছে।'
জিআই পণ্যগুলো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের পরিচায়ক। কখনও তা পর্যটনে মানুষকে আকৃষ্ট করছে, কখনও তা ফ্যাশন দুনিয়ায় নতুনত্ব আনছে। জিআই পণ্য মূলত কৃষিভিত্তিক ও কুটিরশিল্পকে ঘিরে। বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর, এ অঞ্চলের মানুষের ছোট ছোট কাজেও শৈল্পিকতার স্পর্শ রয়েছে। কাজেই, বাংলাদেশের মতো একটি রাষ্ট্রের জন্য জিআই পণ্য অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে পারে।
আমাদের প্রতিটি জেলার ঐতিহ্যবাহী নানা শিল্প এখনও রয়েছে যা হয়তো এখনও লোকচক্ষুর আড়ালে আমাদের জীবনের অংশ হয়ে আছে, সেগুলোকে স্বীকৃতি দিয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিচয়কে তুলে ধরতে পারবে। বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটি অন্যতম উপায় হতে পারে এসব পণ্য।
তবে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের অভাব, চাহিদার বিচারে জোগান না থাকায় বহু পণ্য বিশ্ববাজারে নিজেদের মেলে ধরতে পারছে না। চাহিদা অনুযায়ী জোগান না পাওয়ার একটা বড় কারণ সাবেকি ধাঁচে জিআই পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া। বাণিজ্যিকীকরণ জরুরি হলেও পণ্যের গুণগত মানের সাথে কোনোভাবেই সমঝোতা করার সুযোগ নেই।
জিআই পণ্য টেকসই উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। সেজন্য প্রয়োজন এর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বজায় রেখে যথাযথ উপায়ে বাণিজ্যিকীকরণ। মনে রাখতে হবে, জিআই পণ্যকে বিশেষ করে তোলে এর বিশ্বস্ততা, নিজস্বতা। যেকোনো মূল্যে তা রক্ষা করা জরুরি।