বগুড়ার যে মেলায় মাছ কেনার প্রতিযোগিতায় নামেন জামাইরা
বিগত কয়েক বছর ধরে দেশজুড়ে মাছের জন্য আরও বিখ্যাত হয়ে উঠেছে বগুড়ার গাবতলী উপজেলায় চারশ বছরের ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ মেলা। ব্যবসায়ীদের দাবি, একদিনের এই মেলায় অন্তত ৫ কোটি টাকার শুধু মাছ-ই বিক্রি হয়। ক্রেতাদের মধ্যে অধিকাংশই জামাইয়েরা।
এই মেলাকে স্থানীয়রা জামাই মেলা নামেও অভিহিত করেন। জামাইদের শ্বশুরবাড়িতে দাওয়াত করে নিয়ে এসে তাদের হাতে কিছু টাকা গিফট করা হয়। এই টাকা দিয়ে জামাইয়েরা মেলায় মাছ কেনার 'প্রতিযোগিতায় নামেন'।
উপজেলার ইছামতি নদীর তীরের পোড়াদহ মেলা মাছের জন্যই বিখ্যাত। তবে মেলা দৃশ্যমান পরিসরে একদিনের হলেও মাছ বিক্রি হয় শুরু হয় আগের দিন সন্ধ্যা থেকে। চলে মেলার দিন গভীর রাত পর্যন্ত। প্রথমে মেলায় মাছের বড় আড়ৎ বসে। তাদের কাছ থেকে খুচরা ব্যবসায়ীরা মাছ কিনে সারাদিন বিক্রি করেন। এখানে প্রায় ৪৫০ থেকে ৫০০টি মাছের স্টল (দোকান) রয়েছে। ভোর থেকে এ মেলায় বিভিন্ন জেলার হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে।
ব্যবসায়ী ও মেলার আয়োজকেরা বলছেন, আগের বছরগুলো এই মেলায় অন্তত ৫ থেকে ৭ কোটি টাকার মাছ বিক্রি হওয়ার রেকর্ড রয়েছে।
মেলায় ব্ল্যাক কার্প, গাঙচিল, চিতল, বোয়াল, রুই, কাতলা, মৃগেল, হাঙড়ি, গ্রাস কার্প, সিলভার কার্প, বিগহেড, কালিবাউশ, পাঙ্গাস মাছ যথেষ্ট নজর কেড়েছিল ক্রেতাদের। বিশাল আকৃতির এক মণ ওজনের একটি মারলিন ফিসও (পাখি মাছ) মেলায় মাছের বাজারে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। এই মাছের দাম চাওয়া হচ্ছে ৬০ হাজার টাকা। তবে এক ক্রেতা ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত দাম বলেছেন বলে জানিয়েছেন বিক্রেতা শরিফ তালুকদার।
স্থানীয়রা জানান, মেলার শুরুটা ছিল কাঠের আসবাবপত্রের বেচাকেনা দিয়ে। কালক্রমে সেই স্থান দখল করেছে মাছ। স্থানীয়রা মেলায় ঈদের উৎসবের মতোই পালন করে থাকেন।
মেলার ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, প্রায় ৪০০ বছর আগে মেলার স্থানটিতে একটি বিশাল বটবৃক্ষ ছিল। সেখানে একদিন হঠাৎ এক সন্ন্যাসীর আবির্ভাব ঘটে। পরে সেখানে আশ্রম তৈরি করেন সন্ন্যাসীরা। একপর্যায়ে স্থানটি পুণ্যস্থানে পরিণত হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে।
প্রতি বছর মাঘের শেষ বুধবার ওই স্থানে সন্ন্যাসী পূজার আয়োজন করে হিন্দু সম্প্রদায়। ছুটে আসেন দূর-দূরান্তের ভক্তরা। দিন যত যায়, স্থানটিতে লোকজনের উপস্থিতি বাড়তেই থাকে। এভাবেই গোড়াপত্তন ঘটে পোড়াদহ মেলার।
দর্শনার্থীরা জানান, পোড়াদহ মেলা জামাইদের জন্য। মেলা উপলক্ষে জামাইরা শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে আসেন। আসার পর তাদের পোড়াদহ মেলা থেকে বড় সাইজের মাছ কিনতে হয়। মাছ কেনা নিয়ে অনেকটা প্রতিযোগিতায় নামতে হয় তাঁদের।
মাছের দোকানগুলো ঘুরে দেখা যায়, বেশিরভাগ দোকানে রুই, কাতল, গ্রাসকার্প, ব্ল্যাককার্প মাছ তোলা হয়েছে। এ ছাড়া নদীর মাছের মধ্যে আইড়মাছ, বোয়াল, চিতল মাছ নিয়ে এসেছেন ব্যবসায়ীরা। মাছের আকার ভেদে একেক ব্যবসায়ী একেক রকম দাম হাকাঁচ্ছেন। দুই বিক্রেতা নিয়ে এসেছেন সামুদ্রিক তলোয়ার মাছ্। দাম চাচ্ছেন প্রতি কেজি এক হাজার টাকা।
স্থানীয়রা জানান, পোড়াদহ মেলা জামাইদের জন্য। মেলা উপলক্ষে জামাইরা শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে আসেন। তাদের হাত খরচ দেওয়া হয় শ্বশুরবাড়ি থেকে। এরপর পোড়াদহ মেলা থেকে বড় সাইজের মাছ কেনার 'প্রতিযোগিতায়' নামতে হয় তাদের। মাছ কেনা নিয়ে অনেকটা প্রতিযোগীতায় নামতে হয় তাদের।
মহিষাবান ইউনিয়নের বাসিন্দা রেজাউল করিম মাইদুলের বিয়ে হয়েছে একই এলাকায়।শ্বশুরের সঙ্গে মেলায় এসে দুই হাজার টাকায় মাছ কিনেছেন। রেজাউল করিম বলেন, আমাদের জন্মের আগে থেকে এই মেলা।এখন এটা জামাই মেলা হিসেবেও পরিচিত। শ্বশুররা জামাইদের দাওয়াত করে নিয়ে আসে। জামাইরা বড় বড় মাছ কিনে নিয়ে আসে।
মেলার জৌলুস আগের থেকে আরও বেড়েছে বলে জানান রেজাউলের শ্বশুর মহিষাবান মণ্ডলপাড়ার মোয়াজ্জিম হোসেন মণ্ডল। জানালেন, আগে মেলা বিখ্যাত ছিল কাঠের জন্য। পরে মাছের জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠে।
বিগত সময়ে একাধিকবার মেলা পরিচালনায় ছিলেন লুৎফর রহমান সরকার স্বপন। বগুড়ার গাবতলীর পোড়াদহ মেলাটি ঐতিহ্যবাহী মেলা। এর মূল ঐতিহ্যের বিষয় হলো মাছ। আমরা মেলায় জামাইদের দাওয়াত করি। মেলায় তাদের টাকা গিফট করি। তারা সেই টাকার সঙ্গে আরও টাকা যুক্ত করে বাজার করে। মেলাটি আমাদের পূর্বপুরুষদের সময় থেকে হয়ে আসছে, আমরাও এই ধারা ধরে রেখেছি।
মেলা উপলক্ষে বগুড়া শহরের কৈপাড়া এলাকার মনির হোসেন এসেছেন শ্বশুরবাড়ি মহিষাবান ইউনিয়নের মরিয়া গ্রামে। মেলায় জামাইদের ভূমিকা নিয়ে মনির হোসেন বলেন, মেলায় দাওয়াত পেলে আমরা প্রস্তুতি নিয়ে আসি। আসার পর সব শ্বশুরবাড়ি থেকে আমাদের মাছ কেনার টাকা দেয়া হয়। সেই টাকা দিয়ে জামাইরা বাজার করেন। এখানে জামাইরাও নিজে থেকে আরও টাকা যোগ করে। এ ছাড়া এই মেলায় মাছের পাশাপাশি মিষ্টিও বিখ্যাত। শালা-সমন্ধীরা যারাই থাকবে তাদের মেলা থেকে মিষ্টি খাওয়াতে হয়। জামাইদের টাকা দেয়ার এই রেওয়াজ থেকে দেখা গেছে অনেকে প্রয়োজনে ঋণ করে মেলার খরচ মেটায়।
বিয়ের পর প্রথমবারের মতো পোড়াদহ মেলায় এসেছেন সাব্বির আহমেদ। জানান, আমিও এসেছি মেলা থেকে মাছ কিনতে। এই এলাকায় ঈদের চেয়েও পোড়াদহ মেলার আনন্দ বেশি। তবে জামাইদের মাছ কেনা নিয়ে প্রতিযোগীতাটা তার কাছে বাড়াবাড়ি মনে হয়।
পোড়াদহ এলাকার বাসিন্দা ও মাছ ব্যবসায়ী আমির হোসেন বলেন, মেলা উপলক্ষে সব ধরনের মাছ নিয়ে আসছি। যমুনা নদী থেকে ধরা পড়ছে আইড়, বাউস, রুই, কাতল, ২৬ থেকে ২৭ কেজি ওজনের ব্ল্যাককার্প।এখন আল্লাহপাক রহমত করলে বিক্রি হলে মনটা শান্তি পাবে।
দাম সম্পর্কে এই মাছ ব্যবসায়ী বলেন, এক হাজার টাকা কেজির বিগহেড, ব্ল্যাককার্প। বাউস দুই হাজার টাকা দামে বিক্রি করছি।
গতবারের চেয়ে এবার মাছের আমদানি কম ও তবে বেলা বাড়ার সাথে সাথে ক্রেতা বাড়ছে বলে জানান কাহালু উপজেলার মোহাম্মদ আলী। তিনি বলেন, আমাদের কাছে পাঙ্গাস আছে ৩ থেকে ৫ কেজি। দাম চাওয়া হচ্ছে ২৪০ টাকা কেজি।বিগহেড প্রতি কেজি ৩৮০ থেকে ৪০০ টাকা। রুই, কাতল প্রতি কেজি দাম চাওয়া হচ্চে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা কেজি।
গতরাত সাড়ে তিনটা থেকে আজ বুধবার দুপুর পর্যন্ত প্রায় ৭০ লাখ টাকার মাছ বিক্রির কথা জানিয়ে খাজা বাবা আড়তের মালিক জয়নাল আবেদীন বলেন, তার দোকানে মাঝারি ও বড় আকারের বিভিন্ন প্রজাতির বহু সাইজের মাছ রয়েছে। তবে এবার মেলায় চাহিদা বেশি পাঁচ থেকে ১৫ কেজি ওজনের মাছের।
এই মেলাকে কেন্দ্র করে দেশের বড় বড় মাছ ব্যবসায়ীরা ছয় মাস আগে থেকেই প্রস্তুতি নেন বলেন জানান পোড়াদহে আসা মাছ ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, এই মেলায় ৫ কোটি টাকার মাছ বিক্রি হওয়া কোনো বিষয়ই নয়। ঐতিহাসিক এই মেলায় আগেও কোটি কোটি টাকার মাছ বিক্রি হওয়ার রেকর্ড আছে। এই কারণে দেশের বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীরা এই মেলার দিকে চেয়ে থাকেন। করোনার মধ্যে দেশের সব এলাকায় গণজমায়েত বন্ধ থাকলেও মেলা বন্ধ হয়নি।
পোড়াদহ মেলা কমিটির সদস্য ও মহিষাবান ইউপি সদস্য সুলতান মাহমুদ বলেন, চারশ বছরের বেশি সময় ধরে চলা পোড়াদহ বা সন্ন্যাসী মেলাটি অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। মেলাটি মূলত মাছের জন্য এবং প্রচুর মাছও বিক্রি হয় এখানে। এবার অন্তত ৫০০টি মাছের দোকান। ধারণা করা হচ্ছে সাড়ে ৪ থেকে সাড়ে ৫ কোটি টাকার মাছ বিক্রি হবে এবার পোড়াদহ মেলায়।
এছাড়া পোড়াদহ মেলার আরেকটি আকর্ষণের জায়গা মিষ্টির দোকান। মেলার একেবারে দক্ষিণ অংশে বসানো হয়েছে এই মিষ্টির দোকানগুলো। মেলায় মাছ মিষ্টি ৪০০ টাকা কেজি, সাদা মিষ্টি ২০০, স্পঞ্জ মিষ্টি ৩০০, হাসিখুসি ৫০০, বালিশ ৫০০ টাকা কেজি।
মেলাটি এক দিনের জন্য হলেও পরদিনই একই স্থানে বউ মেলাও বসে। এ সময় সাধারণত নারীরা তাদের নানা রকম পণ্য সংগ্রহ করেন।