ঢাকায় কেন ঠাণ্ডা-কাশির প্রকোপ বাড়ছে?
রাজধানীর মগবাজার এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ মাহফুজ উল্লাহ (৩৬)। তিন দিন ধরে ঠাণ্ডা ও কাঁশিতে ভুগছেন তিনি। চিকিৎসকের পরামর্শে এন্টিহিস্টামিন ও অন্যান্য ওষুধ খেলেও হাঁচি ও কাশি থামছেই না তার। অসুস্থতার কারণে অফিসেও যেতে পারছেন না তিনি।
রামপুরা এলাকার জিনারুল ইসলাম নামে একজনের অবস্থাও মাহফুজ উল্লাহর মতোই। তবে তিনি কাঁশিতে ভুগছেন সপ্তাহ দুই ধরে। অসুস্থতার কারণে ঠিকভাবে ঘুমও হয় না তার।
এদিকে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খাওয়ার পরও ২০ দিন ধরে কাঁশিতে ভুগছেন আড়াই বছরের শিশু এলমাসরি।
গত দুই সপ্তাহ ধরে ঢাকার প্রায় প্রতিটি ঘরেই মানুষের মধ্যে হাঁচি, কাশি, সর্দি-জ্বরের প্রকোপ বেড়েছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, বায়ু দূষণ এর জন্য অন্যতম দায়ী। পাশাপাশি ঋতু পরিবর্তন ও কভিডের সংক্রমণ বাড়ার কারণেও সর্দি, কাশি, জ্বর বাড়ছে।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ঢাকার হাসপাতালগুলোর বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগে সর্দি, কাশি ও জ্বর নিয়ে আসা রোগীর সংখ্যা প্রায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি রোগীর ভিড় মেডিসিন ডিপার্টমেন্টে।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের আউটডোরে (বহির্বিভাগ) সাধারণত প্রতিদিন গড়ে ৯০০ রোগী চিকিৎসা নেয়। বর্তমানে সেই সংখ্যা বেড়ে এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৩০০ তে দাড়িঁয়েছে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের তথ্য বলছে, বছরের অন্য সময় আউটডোরে প্রতিদিন গড়ে ৭০০ থেকে ৮০০ রোগী চিকিৎসা নেয়। এখন সেটি হাজার ছাড়িয়ে গেছে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগ রোগীই জ্বর, ঠাণ্ডা ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত।
ঢামেক হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শাহনুর শারমিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, হাসপাতালে ও চেম্বারে কাশি, জ্বরের অনেক রোগী পাচ্ছি। বেশিরভাগ রোগী আউটডোরে ট্রিটমেন্ট নিচ্ছে। তবে নিউমোনিয়ার রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে। এই সিজনে আমরা বেশি রোগী পাচ্ছি, এনভারমেন্টাল পলিউশন এর একটি বড় কারণ।
তিনি যোগ করেন, 'ঢাকার মারাত্মক দূষণের কারণে এসব অসুস্থতা বাড়ছে। তবে এবারের সমস্যা হলো মেডিসিনে কাশির ইমপ্রুভ হচ্ছে না। দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ থাকছে রোগীরা। ঘরে ঘরে ঠাণ্ডা, কাশির রোগী, কিন্তু স্লোলি ইমপ্রুভ করছে।'
ডা. শাহনুর শারমিন বলেন, 'এখন কভিড নানা ফর্মে দেখা দিচ্ছে, সে কারণেও সর্দি, জ্বর ও কাশির রোগী বাড়তে পারে। এ পরিস্থিতিতে বাইরে বের হলে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। ঠাণ্ডা যাতে না লাগে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আর ইনফ্লুয়েঞ্জার ভ্যাকসিন নেওয়া ভালো।'
এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন জানান, ঠাণ্ডা, কাশি বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ পরিবেশ দূষণ। ঢাকায় দূষণ ভয়াবহভাবে বেড়েছে। পাশাপাশি নতুন ভেরিয়েন্টের কারণে কভিড রোগীও বাড়ছে। সে কারণে এখন সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, দূষণ ও কোভিড থেকে বাঁচতে মাস্ক পরতে হবে নিয়মিত।
বিশ্বের অন্যতম দূষিত শহর হিসেবে পরিচিত ঢাকার গতকাল সোমবার বিকেলে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) স্কোর ১৫১ নিয়ে ঢাকার বাতাসের মান 'অস্বাস্থ্যকর' অবস্থায় ছিল। একিউআই স্কোর ১৫১ থেকে ২০০ পর্যন্ত অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচিত হয়, যা প্রত্যেকের স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। এটি সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য আরও মারাত্মক হতে পারে।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম উল্লেখ করেন, ঋতু পরিবর্তনের কারণে শিশু রোগী বেড়েছে। বেশিরভাগই জ্বর, ঠাণ্ডা, কাশি, ডায়রিয়া, অ্যাজমা, হাঁপানি, নিউমোনিয়া, ব্রংকিওলাইটিস ও শ্বাসকষ্টের রোগী। শিশুদের বাইরে কম বের করতে হবে, ধুলাবালি থেকে দূরে রাখতে হবে, শ্বাষকষ্ট দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কাশির সিরাপ খাওয়ানো যাবে না।
ঢাকার বাইরেও সর্দি-কাশির রোগী বেড়েছে
আবহাওয়া পরির্তনের সঙ্গে সঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও বাড়ছে সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। সোমবার দুপুরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেছে, ২৫ শয্যা বিশিষ্ট ওয়ার্ডটিতে ভর্তি আছে ৬০ জন। শয্যা সংকটে অর্ধেকের বেশি রোগী হাসপাতালের মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. সায়েমুল হুদা টিবিএসকে বলেন, হাসপাতালের আউটডোরে গড়ে প্রতিদিন এক হাজার ৪০০ থেকে দেড় হাজার রোগী আসেন, যার মধ্যে ৩০০-৪০০ শিশু রোগী। মোট রোগীর প্রায় ৪০ শতাংশই এখন আসছেন ঠাণ্ডা, জ্বর, সর্দি কাশিজনিত সমস্যা নিয়ে।
খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. নিয়াজ মুস্তাফি চৌধুরী বলেন, আমাদের ৫০০ বেডের হাসপাতালে বর্তমানে রোগী ভর্তি রয়েছে দেড় হাজারেরও বেশি। সব থেকে বেশি রোগী ভর্তি রয়েছে মেডিসিন ওয়ার্ডে।
কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে খবর নিয়ে জানা গেছে, সোমবার দুপুর ২টা পর্যন্ত ১৫৫ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন, যার মধ্যে শতাধিক রোগীই ঠাণ্ডাজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত।
হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক চিন্ময় কুমার সাহা বলেন, ঋতু পরিবর্তনের প্রভাবে রোগী বাড়ছে। হাসপাতালের আউটডোরে বেশি রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে।
রাজশাহীর পরিস্থিতি ভালো
তবে এদিক থেকে রাজশাহীর অবস্থা তুলনামূলক ভালো। রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইর্মাজেন্সী মেডিক্যাল অফিসারের ইনচার্জ ডা. শঙ্কর কে বিশ্বাস জানান, সর্দি কাশি বা জ্বরের রোগী উল্লেখযোগ্য বাড়েনি। অন্যান্য সময়ে সচরাচর যে রকম সর্দি জ্বরের রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়, সে রকম রোগীই আছে।
কভিড রোগী বাড়ছে
এ বছরের শুরু থেকে গতকাল সোমবার পর্যন্ত কভিড আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ১১ জন। এর আগে গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বরে কভিডে একজন মারা গিয়েছিল। তারপর চার মাস আর কোনো মৃত্যু হয়নি। সোমবার কভিড সংক্রমণের হার ছিল ৮.৪৬ শতাংশ। দুই মাস আগে সংক্রমণের হার ছিল ৫ শতাংশেরও কম।
ডা. মুশতাক হোসেন সতর্ক করে বলেন, বাংলাদেশে সাধারণত গরমে কভিডের সংক্রমণ বাড়ে। নতুন ভেরিয়েন্টের কারণে এ বছরও কভিডের সংক্রমণ বাড়তে পারে।
[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি আজিজুল সঞ্চয়, সাভার প্রতিনিধি নোমান মাহমুদ, খুলনা প্রতিনিধি আওয়াল শেখ, কুমিল্লা প্রতিনিধি তৈয়বুর রহমান সোহেল ও রাজশাহী প্রতিনিধি বুলবুল হাবিব।]