‘ভাসা ভাষা ভালোবাসা’য় ২১টি দেয়াল হলো বিভিন্ন ভাষার ক্যানভাস!
র্কমব্যস্ততা মানুষের জীবনের অন্যতম তিক্ত বাস্তবতার একটি। নিজের জন্য দু'দণ্ড শান্তির ব্যবস্থা করতে পারাই যেন দায় এখন। সেখানে সময় নষ্ট করে অন্যের জন্য ভাবনা অকল্পনীয় ব্যাপারই বটে। তবে কেউ কেউ আছে যারা এই অকল্পনীয় ব্যাপারকেই বাস্তবিক করে তুলতে পারেন।
তাদের চিন্তার জগৎ হয়ত অন্যদের চেয়ে আলাদা। যে কারণে তাদের ভাবনাজুড়েই শুধু থাকে কীভাবে অন্যের কল্যাণ নিশ্চিত করা যায়। মোর্শেদ মিশু এমনই একজন। সামাজকি যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে যাদের নিয়মিত চলাফেরা, তারা এই নামটির সঙ্গে পরিচিত অনেকটাই। মোর্শেদ মিশু নিত্য নতুন উদ্যোগ নিয়ে সবার আর্কষণ কেড়ে নেন।
৩০ বছর বয়সী মিশু পেশায় র্কাটুনিস্ট। সহকারী সম্পাদক হিসেবে র্কমরত আছেন উম্মাদ পত্রিকায়। অভিনয়, উপস্থাপনার কাজ ছাড়াও মিশু সাধারণের কাছে জনপ্রিয় তার অসাধারণ সব কাজের কারণে।
'ভাসা ভাষা ভালোবাসা' তার অনন্য কাজগুলোর একটি। এমন অদ্ভুত নাম শুনে অবাক হতে পারে অনেকেই। আমার বেলায়ও ব্যতিক্রম হয়নি। তাই উৎসুক মনের জিজ্ঞাসা নিবারনের জন্য মিশুর দ্বারস্থ হলাম। নামের পেছনের গল্প জানতেই যত আয়োজন। কথা বলতে বলতে উদঘাটন করা গেল এ নামের রহস্যও।
চলছে ভাষার মাস। আকাশে-বাতাসে এখন ফাগুনের রঙছটা। মিশু ভাবছলিনে এবার একটু ভিন্নভাবে মাতৃভাষা দিবস পালন করবেন। ঠিক করলেন দেয়াল রাঙাবেন তিনি। সেখানে ফুটিয়ে তুলবেন নানা জাতির মাতৃভাষা। পরিকল্পনাও চূড়ান্ত হলো, বাস্তবায়নও হলো। একটা বা দুইটা নয়, রাজধানীর মিরপুর এলাকায় ময়লা-আর্বজনায় পড়ে থাকা ২১টি দেয়ালকে রাঙিয়ে তুললেন তিনি। দেয়াল রাঙানোর এই কাজে রঙ দিয়ে তাকে সহযোগিতা করে নিপ্পণ পেইন্ট বাংলাদেশ।
তবে তার এই কাজটা এতটাও সহজ ছিল না। পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি প্রথমে বিভিন্নজনের কাছে যান। তার কাজের কথা শুনে অনেকেই তার সহযোগিতার জন্য সাড়া দিলেন।
এর পর দলের ৩০-৪০ জন সদস্যকে নিয়ে ১৫ ফেব্রুয়ারি কাজে নামেন মিশু। তাদের লক্ষ্য মহান মাতৃভাষা দিবসকে প্রতিপাদ্য করে ২১টি দেয়াল রাঙিয়ে তোলা। ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই তারা মিরপুর-১৪ এলাকার ২১টি দেয়ালে হরেক রঙের বৈচিত্র্যে ফুটিয়ে তুললেন বাংলা ভাষাসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষা। দুইদিন আগেও যে দেয়ালগুলো আবর্জনায় নোংরা হয়ে ছিল, যেসব দেয়ালের পাশ দিয়ে পথচারীদের হাঁটাচলাও ছিল ভোগান্তির, তা এখন দেখে বোঝার উপায় নেই।
রঙরে দুনিয়ার মানুষ মিশু। তার চিন্তা-ভাবনাজুড়ওে সবকিছু রঙিন। ঢাকা শহরের দেয়ালগুলো এ অবস্থায় দেখতে কখনোই ভাল লাগে না তার। দেয়ালগুলো কেমন যেন নিষ্প্রাণ। তিনি সবসময়ই চাইতেন আর্বজনায় নোংরা হয়ে থাকা এসব দেয়ালকে প্রাণবন্ত করে তোলা যায় কি না। শেষ পর্যন্ত তার এই কল্পনা বাস্তব হয়ে উঠল।
সাঁওতালী 'দুলোডু' (ভালোবাসা), গারোদের 'নাম্মি' (ভালো), চাকমা 'ফাত্তো' (ভবঘুর), ত্রিপুরাদের 'দাওফ্রিওফাইদি' (তাড়াতাড়ি এসো), ম্রো ভাষায় পাওমুম (ফুলরে কলি)। এমন আরও বহু শব্দে মিরপুরের এসব দেয়াল যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। মাতৃভাষার যে বৈচিত্র্য, তারই জানান দিচ্ছে এগুলো।
বিশ্বের সব শিল্পীর মতোই মিশুও শৈল্পিক জগতে বাস করতে ভালোবাসেন। তিনি কেবল নিজেই সেই জগতে সীমাবদ্ধ থাকতে চান না। এই জগতের শৈল্পিক চিন্তা-ভাবনাগুলো ছুঁইয়ে দিতে ও ছড়িয়ে দিতে চান সাধারণের অন্তরেও। এজন্যই তার এমন আয়োজন।
মিশু বলেন, 'যদি আপনি নোংরা বা ময়লাযুক্ত পরিবেশে থাকেন, তাহলে আপনার চিন্তা-ভাবনাতেও ময়লা জমে যাবে। আর চারপাশ সুন্দর, পরিষ্কার-পরচ্ছিন্ন ও রঙিন হলে, তা মনকেও রাঙিয়ে তুলবে।'
'ভাসা ভাষা ভালোবাসা' প্রজক্টটি মিশুর এমন চিন্তাধারারই প্রতিফলন। ময়লামুক্ত পরিবেশ, রঙিন দেয়াল, তাতে শৈল্পিক তুলিতে ফুটে ওঠা নানা জাতির মায়ের ভাষা নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে।
মিশুর এমন সামাজিক ও ভিন্নধর্মী উদ্যোগ এটিই প্রথম নয়। মিরপুর-১৪ এর পুলিশ ফাঁড়ির বিপরীতে অবস্থিত যাত্রী ছাউনিসংলগ্ন দেয়ালটি দীর্ঘদিন ধরেই নোংরা হয়েছিল। ২০২৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ইউএনডিপি বাংলাদেশ আর এশিয়ান পেইন্টসের সহযোগিতায় সেই দেয়ালটিও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাঙিয়ে তোলেন তিনি। তার সেই প্রজেক্টের নাম ছিল 'ফ্ল্যাশমপ'। এই উদ্যোগ মানুষের মনে বেশ সাড়া জাগিয়েছিল।
দেয়ালটি আবারও নোংরা হয়ে পড়তে পারে এমনটাও ভেবে রেখেছিলেন মিশু। দুই-তিন মাস না যেতেই হলোও তাই। দেয়ালের গায়ে যাতে কেউ প্রসাব করতে না পারে সেজন্য একটি উপায়ও বের করে ফেললেন মিশু। দেয়ালে এঁটে দেওয়া হলো স্টেইনলেস স্টিলের মিরর শিট।
সেপ্টেম্বরের ২৮ ও ২৯ তারিখ 'খালে হবে' নামে একটি প্রজেক্টের অংশ হিসেবে মোহাম্মদপুররে একটি খাল ময়লামুক্ত করেন তিনি। সেই সঙ্গে খালের সঙ্গে যুক্ত কালভার্টগুলোও নানা রঙের আল্পনায় রাঙিয়ে তোলেন।
গত ২৫ ডিসেম্বর 'ফেলনা খেলনা টেলনা' নামে আরেকটি উদ্যোগ নেন তিনি। পুরনো একটি দেয়াল রাঙিয়ে সেটিকে খেলনার দেয়ালে পরিণত করেন। কারও ফেলে দেওয়া বা অব্যবহৃত খেলনাগুলো সেই দেয়ালে সংযুক্ত একটি শেল্ফে রেখে যায় মানুষ। সেখান থেকে যে কেউ চাইলে খেলনাটি নিয়ে যেতে পারেন। একজনের ফেলে দেওয়া বা অব্যবহৃত খেলনা হতে পারে অন্যের খুশির উৎস- এমন চিন্তা থেকেই তার এই উদ্যোগ।
মিরপুর-১৪ এলাকার এই ২১টি দেয়ালও হয়ত আবার নোংরা হয়ে উঠবে। তবে মিশু আশাবাদী। তার মতে, মানুষের অভ্যাস বদলাতে কিছুটা সময় লাগবে। ছোট ছোট এসব পরিবর্তনই ধীরে ধীরে মানুষের মনে সচেতনতা ও বোধশক্তি তৈরি করবে।
তিনি বললেন, 'মানুষের অভ্যাস পরিবর্তন সম্ভব, যদি নতুন কোনো অভ্যাস তৈরি করা যায়। আমি সেই চেষ্টাই করছি।'