সাবাংগী: এক প্লাটফর্মে পাহাড়ি নারী উদ্যোক্তারা
সাবাংগী। চাকমা শব্দ। এর অর্থ, একসঙ্গে সমানভাবে কাজ করেন যারা, এ রকম কর্মসঙ্গী।
আমাদের পার্বত্য অঞ্চলের পণ্যের কদর দারুণ। রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যও। এ সময়ে পণ্য কেনা-বেচার সহজ প্লাটফর্ম- অনলাইন। তাই কম-বেশি সব বিক্রেতা বা উদ্যোক্তারই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রয়েছে নিজস্ব পেজ। পাহাড়ি সব অনলাইনে পণ্য বিক্রেতাকে একত্র করে একটি সম্মিলিত প্লাটফর্ম বানানোর ভাবনা থেকে 'সাবাংগী'র জন্ম। নেপথ্যে ভাবনা- এভাবে সবাইকে একসঙ্গে এক জায়গায় পাওয়া যাবে এবং সম্মিলিতভাবে কাজ করা গেলে একত্রে এক বিশাল মার্কেট সৃষ্টি করা যাবে।
'সাবাংগী'র (SABANGEE) আইডিয়া কীভাবে এলো- জানতে চাইলে এর অন্যতম উদ্যোক্তা ত্রিশিলা চাকমা বলেন, 'আমাদের পার্বত্য অঞ্চলে এখনো উচ্চশিক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই। স্কুলের গণ্ডি পেরোলে অনেক অভিভাবক ছেলেমেয়েকে মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ানোর উদ্দেশ্যে ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামে পাঠান। সে কারণে পাহাড়ি ছেলেমেয়েরা কলেজে পড়ার সময় থেকে পড়াশোনার পাশাপাশি আত্মনির্ভরশীল হওয়ার শিক্ষা পরিস্থিতির সঙ্গে অর্জন করেন। পড়াশোনার পাশাপাশি কিছু অতিরিক্ত হাত খরচ মেটানোর আশায় অনেকে টিউশনি করেন, আবার কেউ ছোটখাট ব্যবসা করেন।'
'যারা পড়াশোনার পাশাপাশি ব্যবসা করেন, তাদের জন্য ব্যবসার প্রচারণা পরিচালনার সহজ উপায় এখন ফেসবুক। অনেকে ফেসবুকে পেজ বা গ্রুপ খুলে সহজে ব্যবসা শুরু করে দিতে পারেন। কিন্তু ইন্টারনেটের দুনিয়া এত বিশাল, প্রত্যেক গ্রুপ বা পেজে মেম্বার হওয়া সম্ভব নয়। তাই সবার প্রোডাক্ট আপডেট পাওয়াও সম্ভব হয় না', এ কারণে এ রকম বিক্রেতাদের এক প্লাটফর্মে নিয়ে আসার ভাবনা থেকেই 'সাবাংগী'র পথ চলা শুরু বলে জানান তিনি।
এর যাত্রা শুরু ২০১৯ সালের এপ্রিলে। মূলত রাজধানীর কাজীপাড়ায় অবস্থিত পাহাড়ি রেস্টুরেন্টের সত্বাধিকারী বিপলি চাকমা তার রেস্টুরেন্টের পাশে একটি ছোট প্রোডাক্ট পিকআপ পয়েন্ট রাখার প্রস্তাব দেন 'তারেঙ টিশার্ট'-এর কো-ফাউন্ডার ত্রিশিলাকে।
শুধু একটি অনলাইন পেজ থেকে ফিজিক্যাল পিকআপ পয়েন্ট পাওয়ার প্রস্তাব, তা-ও ঢাকায়, ত্রিশিলার মনে এ যেন আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো অনুভূতি এনে দেয়! মুহূর্তেই সেই প্রস্তাব লুফে নেন তিনি। বিপলি চাকমার কথামতো ফ্লোরটি দেখতে গিয়ে তার মনে হয়, 'এখানে আমি কেন, আমার মতো আরও চার-পাঁচজন অনলাইন সেলার প্রোডাক্ট পিকআপ পয়েন্ট দিতে পারবে।'
মুহূর্তেই সেই ভাবনা প্রকাশ করেন ত্রিশিলা, "দিদিকে (বিপলি) বললাম এ কথা। দিদি বললেন, 'সেটা হলে তো ভালো হয়।' তিনি পরিচিত পাহাড়ি অনলাইন সেলার খুঁজতে বললেন।"
ত্রিশিলার বান্ধবী ঈশি তালুকদারও একজন অনলাইন উদ্যোক্তা। নিজস্ব ডিজাইনের ঐতিহ্যবাহী পোশাক নিয়ে কাজ করেন। তার পেজের নাম 'তুংগোবী'। প্রথম প্রস্তাবটি তাকেই দিলেন ত্রিশিলা। প্রথমে একটু দ্বিধায় থাকলেও রাজি হয়ে গেলেন ঈশি। এরপর তার মাধ্যমে 'রানজুনি' পেজের স্বত্বাধিকারী উপমা নেলী, 'বক্স অফ অরনামেন্টস'-এর স্বত্বাধিকারী রিতিসা রিতি এবং 'কোরিয়ান গ্ল্যাম বাংলাদেশ'-এর স্বত্বাধিকারী জিলিয়ান তালুকদারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়।
"আমরা একত্র হয়ে প্রথমে ঠিক করি, যেখানে পিকআপ পয়েন্ট করার কথা, সেখানে আগে একটি ইনডোর মেলা বসাব। আমাদের সঙ্গে আরও ছিলেন বিপলি দিদির ছোট বোন, 'বিয়ং' পেজের স্বত্বাধিকারী সুচিন্তা চাকমা। সবার সম্মিলিত সিদ্ধান্তে আমরা গত বছরের ২৩ থেকে ২৫ মে পর্যন্ত তিনদিনের জন্য প্রথমবারের মতো 'সাবাংগী মেলা' নামে ৬ জন মিলে একটি ইনডোর মেলার আয়োজন করি।"
একে তো ইনডোর মেলা, তার ওপর একদম নতুন আইডিয়া- সব মিলিয়ে প্রথম থেকেই তারা প্রস্তুত ছিলেন, খুব একটা সাড়া পাবেন না। মেলার ঠিক দুদিন আগে উপমা নেলি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে মেলায় অংশ নিতে অপারগতা জানান তিনি। সে সময় তাৎক্ষণিক যোগাযোগ করা হয় 'গার্লস ব্যাকআপ' পেজের স্বত্বাধিকারী টুংকি চাকমার সঙ্গে। মেলায় অংশ নিতে তিনি রাজি হন।
'অবিশ্বাস্যভাবে মেলায় আমরা প্রচুর সাড়া পাই। এমনকি এত সাড়া পাই, আমাদের মেলার মেয়াদ আরও দুইদিন বাড়াতে হয়। শেষের দিন উপমা নেলি দিদিও সুস্থ হয়ে আমাদের সঙ্গে যোগ দেন। মেলায় সাড়া পাওয়ার পর মূলত আমরা প্রচুর অনুপ্রাণিত হই এবং প্রোডাক্ট পিকআপ পয়েন্ট থেকে সবাই মিলে চেইন শপ দেওয়ার চিন্তা করি,' বললেন ত্রিশিলা।
এরপর গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর, হেবাং রেস্টুরেন্টের ওপরের ফ্লোরে তারা ৬ জন মিলে 'সাবাংগী শপ' নামে একটি যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ওই ফ্লোর তাদের বাজেটের মধ্যে ব্যবস্থা করে দেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন বিপলি চাকমা।
'সাবাংগী' নিয়ে মূল পরিকল্পনার ব্যাপারে ত্রিশিলা বলেন, 'এটি যে পাহাড়ি নারী অনলাইন উদ্যোক্তা ও সেলারদের একটি মিলন ক্ষেত্র হবে, তা অবশ্য আগে থেকে ঠিক করা ছিল না। এক সময় খেয়াল করলাম, যেহেতু আমরা ছয়জনই নারী, তাই পাহাড়ি নারী অনলাইন সেলার ও উদ্যোক্তাদের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরির কথা ভাবতে পারি।'
'আমাদের পাহাড়ে অনেক জাতির বাস, আর প্রত্যেকটি জাতির রয়েছে বৈচিত্র্যময় ঐতিহ্য ও জীবনধারা। আদিবাসী সংস্কৃতি ও চারপাশের প্রাকৃতিক সম্পদ পুঁজি করে অনেক পাহাড়ি উদ্যোক্তা নতুন উপযোগ সৃষ্টি করে যাচ্ছেন। তাদের এবং অনলাইন রিসেলারদের একসঙ্গে এক প্লাটফর্মে নিয়ে আসা, যারা নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করছেন- তাদের সৃষ্টিশীলতাকে প্রদর্শন করা, প্রোডাক্টের ওপর কপিরাইট সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি এবং সর্বোপরি সময়োপযোগী স্টোরি টেলিংয়ের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে অভিজ্ঞতা শেয়ার করে পাহাড়ি অনলাইন ব্যবসায়ীদের ঐক্য বাড়িয়ে অনলাইনে বিশ্বাসযোগ্য এক বিশাল মার্কেট সৃষ্টি করা'- মূলত এসব লক্ষ্য নিয়েই 'সাবাংগী' কাজ করে যাচ্ছে বলে ত্রিশিলা জানালেন।
অনলাইন বুটিক শপ 'তুংগোবী'র ঈশি তালুকদার, বুটিক শপ 'রানজুনি' উপমা নেলি, টিশার্ট শপ 'তারেঙ'-এর ত্রিশিলা চাকমা, ঐতিহ্যবাহী বেইনে বোনা পোশাক শপ 'বিয়ং'-এর সুচিন্তা চাকমা, অরনামেন্ট শপ 'বক্স অফ অরনামেন্টস' রিতিসা রিতি এবং কোরিয়ান কসমেটিকস শপ 'কোরিয়ান গ্ল্যাম বাংলাদেশ'-এর জিলিয়ান তালুকদার 'সাবাংগী' উদ্যোগের মূল হোতা। পরোক্ষভাবে যুক্ত রয়েছেন 'সাবাংগী'র বিশেষ উপদেষ্টা বিপলি চাকমা ও 'সাবাংগী নেটওয়ার্ক'-এর প্রায় শতাধিক পাহাড়ি নারী উদ্যোক্তা ও রিসেলার।
'সাবাংগী'র সদস্য হওয়ার শর্ত খুবই সহজ। পাহাড়ী নারী উদ্যোক্তা বা অনলাইন রিসেলার হলেই হবে।
ত্রিশিলা আরও জানান, 'সাবাংগী'র কার্যক্রম মূলত অফলাইন থেকে অনলাইনে বেশি দৃশ্যমান। বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯-এর কারণে ঢাকার চেইন শপটি আড়াই মাস ধরে বন্ধ। কিন্তু 'সাবাংগী' তার নেটওয়ার্কের পাহাড়ি নারী উদ্যোক্তা ও অনলাইন রিসেলার সদস্যদের নিয়ে একই নামে একটি পাবলিক গ্রুপ পরিচালনা করে। পাবলিক গ্রুপে শুরুর দিকে শুধু নারীদের যার যার পণ্য প্রমোশনের নিয়ম ছিল। তবে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল পাহাড়ি উদ্যোক্তা ও রিসেলারদের পণ্য প্রমোশনের এবং অভিজ্ঞতা বিনিময়ের জন্য প্লাটফর্মটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।
'অল্প কদিনের মধ্যে এখানেও আমরা বেশ সাড়া পাচ্ছি। এটিকে পাহাড়ি নারীদের পরিচালিত অনলাইন শপিংয়ের একটি বিশ্বাসযোগ্য প্লাটফর্মে পরিণত করতে চাই,' বললেন ত্রিশিলা।
এছাড়াও ঢাকা, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান- এই চার জায়গায় বিভিন্ন সময়-সুযোগে পাহাড়ি নারীদের নিয়ে পণ্য প্রদর্শনী ও বিক্রি মেলা করার ইচ্ছা রয়েছে। বিঝু উৎসবের আগে এ রকম প্রথম আউটডোর মেলা মার্চের শেষের দিকে হওয়ার কথা ছিল রাঙামাটি কালচারাল ইনস্টিটিউটে। কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হওয়ায় সেই মেলা বাতিল করতে বাধ্য হন 'সাবাংগী'র উদ্যোক্তারা।
'সাবাংগী' চালু করতে গিয়ে কী কী অসুবিধার মুখে পড়েছিলেন এবং কীভাবে সামলিয়েছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে ত্রিশিলা চাকমা বলেন, 'সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল অর্থনৈতিক। একে তো সবার পুঁজি কম, তার ওপর ফ্লোর ভাড়া ছাড়াও মেইনটেইনেন্স, ডেকোরেশন, আনুষঙ্গিক নানা খরচ লেগেই ছিল। তবে আমরা খরচগুলো প্রতিবার ছয় ভাগে ভাগ করে নিতাম; এ কারণে তেমন বোঝা মনে হয়নি। একসঙ্গে কাজ করার এই সুবিধা আমরা পেয়েছি, যা একা করতে গেলে অনেক বেশি বোঝা মনে হতে পারত।'
'তাছাড়া একসঙ্গে কাজ করতে গেলে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় অনেক ক্ষেত্রে মতের অমিল হয়। তখন মেজরিটি ভোটিংয়ের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিই আমরা।'
'সাবাংগী'র মাধ্যমে বর্তমান প্রজন্মকে বেকারত্বের হতাশার বাইরে নিজ প্রচেষ্টায় উদ্যোক্তা হতে নানাভাবে উৎসাহিত করে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার পথ দেখানোর স্বপ্ন দেখেন এর উদ্যোক্তারা। 'এটাকে এমন এক আদর্শে পরিণত করতে চাই, যার কার্যক্রম দেখে শুধু পাহাড়িরা নয়, সারা দেশের নতুন প্রজন্ম উপকৃত হবে,' বললেন ত্রিশিলা চাকমা।