অস্থির খেজুর বাজার, উচ্চ কাস্টমস ভ্যালুয়েশন ও শুল্ককে দুষছেন আমদানিকারকরা
রমজানের বাকি আর সপ্তাহ খানেক। এরই মধ্যে অস্থির খেজুর বাজার। আমদানিকারকরা অবশ্য এর কারণ হিসেবে রাজস্ব কর্তৃপক্ষকে দায়ী করছেন। তারা বলছেন, এ বছর খেজুর আমদানিতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এতে দামও বেড়েছে অনেক।
প্রতি বছরই রমজান মাসে বাংলাদেশে খেজুরের চাহিদা বাড়ে। সারাদিন শেষে ইফতারে রোজাদারদের কাছে সুস্বাদু এই ফলটি অপরিহার্য।
বাজারে নিম্ন মানের খেজুরটির দামও গত বছরের তুলনায় এ বছর প্রায় দ্বিগুণ।
চট্টগ্রাম জেলা সিনিয়র কৃষি বিপণন কর্মকর্তা শাহ মোহাম্মদ মোর্শেদ কাদের দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বর্তমানে সাধারণ মানের খেজুর কেজি প্রতি বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ৩০০ টাকায়। গত বছর যা ছিল ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা।
আমদানিকারদের তথ্যমতে, আন্তর্জাতিক বাজারে এসব খেজুরের ক্রয়মুল্য কেজি প্রতি ৬৫ থেকে ৭৪ টাকা। কিন্তু এ বছর ১২০ টাকা অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু (আমদানি মুল্য) নির্ধারণ করে এই খেজুরের শুল্কায়ন করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ কারণে ভোক্তা পর্যায়েও খেজুরের দাম বাড়ছে।
রমজান ঘিরে আমদানি হওয়া সবচেয়ে কম দামের খেজুর এসেছে ইরাক, দুবাই ও তিউনেশিয়া থেকে। আন্তর্জাতিক বাজারে এসব খেজুরের দাম প্রতি কেজিতে ৬৫ টাকা থেকে ৭৪ টাকা। কিন্তু চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস এসব খেজুরের অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু নির্ধারণ করেছে ১২০ টাকা।
স্থানীয় বাজারে খেজুরের এই অস্থির দামের জন্য বাড়তি শুল্কায়নকে দায়ী করছেন আমদানিকারকরা। তাদের বক্তব্য- ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত খেজুর আমদানিতে টোটাল ট্যাক্স ইন্সিডেন্স (টিটিআই) ছিল ১০ শতাংশ। তখন এই মানের খেজুরের অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু ছিল টন প্রতি ৫০০ ডলার। সব মিলে এই খেজুরে কেজি প্রতি শুল্ক দিতে হতো ৫ টাকা ৪৫ পয়সা।
কিন্তু চলতি অর্থবছরে অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু দ্বিগুণ করার পাশাপাশি কাস্টমস ডিউটি (সিডি), রেগুলেটরি ডিউটি (আরডি) এবং ভ্যাট মিলে নতুন ৪৮.৬০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।
যদিও গত ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে সরকার খেজুর আমদানিতে কাস্টমস ডিউটি ২৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ কমিয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করে, তারপরও অতিরিক্ত মূল্য নির্ধারণের কারণে খেজুরের দাম উচ্চই রয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফআইএ) সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, নতুন অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু কার্যকর হওয়ায় পিপি ব্যাগে আসা প্রতি কেজি খেজুরে ৫.৪৫ টাকা থেকে ৬৪.৪১ টাকা, ড্রাই কন্টেইনারে কার্টুনে আসা খেজুরে ১০.৯৩ টাকা থেকে ১৬৯.৯৭ টাকা, রিফার কন্টেইনারে আসা কার্টুন খেজুরে ১০.৯৩ টাকা থেকে ২৭২ টাকা, রিটেইল প্যাকেটজাত খেজুরে ২১.৮৪ টাকা থেকে থেকে ১৮০.৩৭ টাকা শুল্ক দিতে হচ্ছে।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) জানিয়েছেন, কম দামের এবং বেশি দামের খেজুরের শুল্কায়ন যথাযথ না হওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে নিম্নবিত্তরা। কারণ বাড়তি শুল্কায়নের ফলে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে অনেক কম দামে কেনা খেজুরে তাদের বাড়তি মূল্য দিতে হচ্ছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বেশি দামে কিনলেও ভালো মানের খেজুরে কম শুল্কায়নের ফলে লাভবান হচ্ছেন আমদানিকারক-ব্যবসায়ীরা।
ক্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, রোজার আগেই খেজুরের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজার দরের সঙ্গে অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু কতটুকু সামঞ্জস্য রয়েছে সেটিও ভোক্তা পর্যায়ে পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। খেজুরসহ আমদানি পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হলে শুল্ক আরোপে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাকে খুব সতর্ক হতে হবে।
দেশে খেজুরের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৯০ হাজার টন। এর মধ্যে শুধু রমজান মাসেই ৪০ হাজার টন খেজুর প্রয়োজন হয়। চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আসা ২৪ হাজার ৯৬০ মেট্রিক টন খেজুর আমদানি হয়েছে।
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৮৮ হাজার ৫৬৭.৬৪ মেট্রিক টন খেজুর আমদানি হয়েছে। ২০২৩ সালে আমদানি হয়েছে ৬৮ হাজার ৫১৫.২৯ মেট্রিক টন।
আমদানিকারকরা জানিয়েছেন, এমনিতেই ডলার সংকটের কারণে তারা চাহিদা অনুযায়ী খেজুর আমদানি করতে পারছেন না। এর মধ্যে প্রকৃত মুল্যের চেয়েও বাড়তি দামে শুল্কায়ন খেজুরের বাজার অস্থিতিশীল করে তুলছে। যৌক্তিক অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু নির্ধারণে কাস্টম কর্তৃপক্ষ, বাণিজ্য ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েও তারা কোনো প্রতিকার পাননি।
সম্প্রতি সাথি এন্টারপ্রাইজ, আল বারাকা ডেটস ফ্যাক্টরি বিডি লিমিটেড, সিয়াম ফ্রুটস, সাফওয়ানা ফ্রুটস ট্রেডিং করপোরেশন, এশিয়ান ফ্রুটস বিডি লিমিটেড এ নিয়ে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে চিঠি দেয়।
তবে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার ফাইজুর রহমান টিবিএসকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে খেজুরের দামের উপর ভিত্তি করে অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু নির্ধারণ করা হয়েছে। তাই বিদ্যমান অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালুকে অযৌক্তিক দাবি করার সুযোগ নেই। রমজান ঘিরে যে পরিমাণ খেজুর আমদানি হয়েছে তার ৯৫ শতাংশ ইতোমধ্যে খালাস হয়ে গেছে।
তিনি যোগ করেন, আমদানি শুল্কও কমানো হয়েছে ১০ শতাংশ। তাই বাজারে অস্থিরতার কোনো সুযোগ নেই।