অর্থসংকটে জর্জরিত মধ্যবিত্ত ঈদের কেনাকাটা করছে ফুটপাত থেকে
মিরপুর শেওরাপাড়া এলাকা থেকে মিম (১৯) তার মা আমেনা বেগমের সঙ্গে শনিবার (৩০ মার্চ) রাজধানীর নিউ মার্কেট এলাকায় এসেছিলেন ঈদের কেনাকাটা করতে। কিন্তু ছয় ঘণ্টা ঘুরেও তাদের বাজেটের মধ্যে কোনো পোশাক পাননি, তাই ফিরতে হয়েছে খালি হাতেই।
মিম ও তার মা এখন ফুটপাতের দোকানগুলো থেকে ঈদের কেনাকাটা করার পরিকল্পনা করছেন।
পোশাকের চড়া দাম নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে মিম বলেন, 'শপিং মলে একদাম, ফুটপাতেও একদামে কেনাবেচা চলছে। পছন্দ হলে দামে বনে না, আবার যেগুলো দাম কম সেসব আবার পছন্দ হয় না। গত বছরও একটা ওয়ান পিস জামা ৪০০-৫০০ টাকার মধ্যে কেনা যেত, এখন ফুটপাতেও এই ধরনের জামার দাম বাড়িয়ে দিয়েছে প্রতি পিসে ১০০-২০০ টাকা।'
ঈদকে কেন্দ্র করে রাজধানীর ফুটপাতের মার্কেটগুলোতে ক্রেতাদের উপস্থিতি স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বেড়েছে। তবে ফুটপাতে দেখা মেলে না আগের দৃশ্য। অল্প টাকায় দরদাম করে নিম্নবিত্তদের পোশাক কেনার পরিবর্তে একদামে মধ্যবিত্তরাই কিনছেন ফুটপাতের অধিকাংশ দোকান থেকে। আর ঈদের কেনাকাটা নিম্নবিত্তদের নাগালের বাইরে চলে গেছে।
মৌচাকের আয়শা কমপ্লেএক্সের সামনে শার্টি বিক্রি করা সাইদুল ইসলাম বলেন, পোশাকের দাম বেড়ে যাওয়ায় নিম্ন-আয়ের মানুষের কাছে বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে বিক্রিও কমেছে।
তিনি বলেন, দুপুর ১টা থেকে এখন ৩টা পর্যন্ত কোনো বিক্রিই হয়নি তার। 'ক্রেতারা আসেন, পছন্দও হয়, কিন্তু দাম শুনলে চলে যান।'
বেশি দামে কিনতে হয় বলে পোশাকের দাম কম রাখতে পারেন না বলে জানান সাইফুল। 'গত বছর যে গেঞ্জি গড়ে ১৮০ টাকায় কিনেছি, সেগুলো এখন ২৫০ টাকায় পাইকারি কিনে আনতে হচ্ছে। গ্রাহকদের ৩০০ টাকা দাম বললে তারা কেনা দামের চেয়েও কম দাম দিতে চায়।'
ক্রেতা কম
অন্যান্য বছরের তুলনায় এবারের ঈদের বাজারে ক্রেতাদের উপস্থিতি এখন পর্যন্ত কমই দেখা যাচ্ছে। অন্যন্য বছরে ১০ রজমানের পর থেকেই ঈদের বেচাবিক্রিতে দোকানিরা ব্যস্ত সময় পার করলেও এ বছর এখনও আগের বছরের তুলনায় বিক্রি প্রায় ৫০ শতাংশ কম বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
মৌচাক মার্কেটের সামনের ফুটপাতে শিশুদের পোশাক বিক্রি করা সাইম ইসলাম বলেন, গত বছরেও রমজানের এই সময়ে দিনে প্রায় ৪০ হাজার টাকার বিক্রি হতো। এখন মাত্র ৭০৮ হাজার টাকা বিক্রি হচ্ছে।
তবে ক্রেতা বাড়ার ব্যাপারে তিনি আশাবাদী। 'আশা করি ২-৩ এপ্রিল থেকে বিক্রি আরও বাড়বে।'
এদিকে বসুন্ধরার মতো উচ্চবিত্তদের মার্কেটে ক্রেতাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে, উচ্চবিত্তদের ঈদের কেনাকাটা জমে উঠেছে। তবে বেচাবিক্রি কম লক্ষ করা গেছে মার্কেটসংলগ্ন ফুটপাতে। ফুটপাতগুলোর দোকানিদেরও অলস সময় পার করতে দেখা গেছে। সেখানকার একাধিক ব্যবসায়ীরা বলেন, অনলাইন শপিংয়ের জনপ্রিয়তা বাড়ার কারণে তাদের বিক্রি অনেকটা কমে গেছে। এখন অনেকেই অনলাইন থেকে কেনাকাটা বেশি করছে। এছাড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে বেতন দেরিতে দেওয়ার কারণেও তাদের বিক্রি কম বলে দাবি করেন অনেক বিক্রেতা।
বসুন্ধরা শপিংমলের সামনে নিহন নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, আগের বছরের তুলনায় বেচাকেনা খুবই কম। তিনি বলেন, 'গত বছরে এই সময়ে রোজা ভাঙতে হয়েছে, কারণ ক্রেতার অনেক ভিড় ছিল। আর এখন মানুষ কীভাবে কিনবে, সবকিছুরই দাম প্রায় দ্বিগুণ।'
তবে সাধারণ চাকরিজীবী মানুষ বেতন পেলে বিক্রি বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করেন নিহন।
যে কারণে দাম বাড়ছে
রাজধানীর গাউছিয়া মার্কেটে কেনাকাটা করতে এসেছেন মুমেনুল নামে বেসরকারি কলেজের একজন শিক্ষক। দুই মেয়ের জন্য ৪ হাজার টাকার পোশাক কিনেছেন তিনি।
মুমেনুল বলেন, 'এসব কাপড় সবসময় ১ হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া যেত, এখন এগুলো ২ হাজার টাকায় কিনতে হচ্ছে। দোকানদাররা বলছেন, তাদের ক্রয়মূল্য আগের তুলনায় বাড়ছে বিধায় তারাও গ্রাহকদের কাছে দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।'
তিনি বলেন, 'যেখানে যাই সেখানেই দাম বেশি। চলের দোকানেও এক কথা, মাছের দোকানেও এক কথা।'
রোজিনা ইসলাম নামের আরেক ক্রেতা বলেন, 'বেশিরভাগ দোকানদার ফিক্সড প্রাইস লিখে রেখেছেন। অথচ সবশেষ সেগুলো দামাদামি করেই কিনতে হচ্ছে। দূরদূরান্ত থেকে আমরা যারা মার্কেট করতে আসি, তারা একদিনেই সব কাপড় কিনে নিয়ে যাই। এটা ব্যবসায়ীরা ভালো করেই জানে। সেজন্য দামটাও একটু বেশি চেয়ে বসে থাকে।'
অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিদ্যুৎ বিল, দোকান ভাড়াসহ আনুষঙ্গিক খরচ বেড়ে যাওয়ায় তার সব কিছু যুক্ত করতে হচ্ছে কাপড়ের দামে। সেজন্য অন্য বছরের তুলনায় এবার দাম বেশি রাখতে হচ্ছে।
ব্যবসায়ীদের কথার সঙ্গে দেশের মূল্যস্ফীতির স্পষ্ট চিত্র ফুটে উঠছে। গত দুই বছরে ধরে দেশে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি বলে জানা যায় সরকারি হিসাবে। এছাড়া কিছু কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে ৫০-৬০ শতাংশ, যদিও মানুষের আয় ৫ শতাংশের বেশি বাড়েনি।