৩৫ বছরে জোস্না, সর্বোচ্চ আয়ের রেকর্ড এখনও জোস্নার
সাপ্তাহিক বিচিত্রা লিখেছিল: 'ঊননব্বই সাল জোস্নার বছর।'
এই সেই জোস্না, যাকে সাপে কেটেছিল, ভেলায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যৌবনে সে রাজার ছেলের মন হরণ করেছিল, সাপে কাটার পর রাজকুমারকে মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে এনেছিল। রাজা চুক্তিভঙ্গ করলে রাজপ্রাসাদের গায়ে কলঙ্ক লেপে দিয়েছিল জোস্না।
এই জোস্না তার কষ্টার্জিত ফসলের দাবিতে অনড় ছিল ছবির শেষ পর্যন্ত। নারী বলে সে অবলা নয়। তাই গাঁয়ের বধূরা ঘর উজাড় করে তাকে দেখতে হলে ভিড় জমিয়েছিল। গাঁয়ের মেয়েদের এ আগ্রহ খবর হয়ে গিয়েছিল শহরে, পরে শহরের হলগুলোতেও ভিড় বেড়েছিল। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি অর্থ উপার্জনকারী ছবি বেদের মেয়ে জোস্না।
প্রথমে কেউ গুরুত্ব দেয়নি
১৯৮৯ সালে ২০ লাখ টাকা খরচ করে বানানো হয়েছিল ছবিটি। উপার্জন করেছিল ২০ কোটি টাকা। এর আগে এবং পরেও এত বেশি অর্থ আর কোনো ছবি থেকে উপার্জিত হয়নি। অথচ ছবিটিকে ঢাকা বা নারায়ণগঞ্জের মতো বড় শহরে প্রথমে মুক্তি দেওয়া যায়নি। ১৯৮৯ সালের ৯ জুন জোস্নার সঙ্গে আরও দুটি ছবি সোনার নাও পবনের বৈঠা ও নিকাহ মুক্তি পেয়েছিল।
চলচ্চিত্র গবেষক শামছুল আলম বাবু বলেন, 'ওই দুটি ছবিই ছিল হেভিওয়েট। তুলনায় জোস্নার ঢোল বাজানোর সুযোগ ছিল কম। কারণ জোস্নার পরিচালক নতুন, জোস্নারূপী অঞ্জু ঘোষের আগের কয়েকটি ছবি ফ্লপের খাতায় নাম লিখিয়েছিল। তাই প্রদর্শকেরা ছবিটির ব্যাপারে আগ্রহ দেখাননি।'
দেশে তখন মোট সিনেমা হলের সংখ্যা ১,২০০। অথচ জোস্না দেখাতে রাজি হয়েছিল মাত্র ২০টি। মাস দুই পরে অবশ্য পরিস্থিতি এতটাই উলটে গিয়েছিল যে, জোস্নার পরিবেশকেরা ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের হলগুলোর কাছে দেড় লাখ টাকা অগ্রিম চেয়েছিলেন। আরও দাবি ছিল, যদি ছবিটি বড় ব্যবসা করে, তাহলে লভ্যাংশও দিতে হবে।
'যশোর, খুলনা অঞ্চল থেকেই খবর আসছিল বেশি; লাইন ধরে লোকে হলে ঢুকছে, হাপুস নয়নে কাঁদছে, খুশি হয়ে বের হয়ে আসছে। একই লোক পরদিন আবার যাচ্ছে, আবার কাঁদছে, আবার খুশি হয়ে বের হয়ে আসছে। নারীরাই বেশি দেখেছে ছবিটি। এফডিসিতে বসে আমরা খবর পাচ্ছিলাম, অমুক গ্রামের তমুকের বিবি গাল ফুলিয়ে বাবার বাড়ি চলে গেছেন কারণ তাকে জোস্না দেখতে নিয়ে যাচ্ছে না স্বামী,' বলেন শামছুল আলম বাবু।
বেদের মেয়ে জোস্না'র পরিচালক তোজাম্মেল হক বকুল এ সিনেমা দিয়েই পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এর আগে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা ছিল তার। সিনেমার রাজপুত্র আনোয়ার তথা ইলিয়াস কাঞ্চন তখনকার ব্যস্ততম অভিনয় শিল্পী। বকুল তার শিডিউল পাচ্ছিলেন না। আবার তাকে ছাড়া ছবিও করবেন না। শেষে বলেকয়ে আরেক বিখ্যাত পরিচালক দারাশিকোর নেওয়া শিডিউল থেকে সাতদিন ধার নিয়ে কাঞ্চনের অংশের শ্যুটিং শেষ করেছিলেন তিনি।
উর্দু ছবিকে টেক্কা দিয়ে
ঢালিউডে লোককাহিনীভিত্তিক ছবি তৈরি শুরু হয় ১৯৬৫ সালে। উর্দু ছবির সঙ্গে পাল্লা দেওয়া ছিল এর লক্ষ্য। সালাহউদ্দিনের রূপবান জনপ্রিয়তার শিখর ছুঁয়েছিল। পরের বছরই তাই লোককাহিনীভিত্তিক ১০টি ছবি মুক্তি পেতে দেখা যায়। এর মধ্যে গুনাইবিবি, আবার বনবাসে রূপবান, ভাওয়াল সন্ন্যাসী, আপন দুলাল, বেহুলা, জরিনা সুন্দরীও ছিল। খান আতা, জহির রায়হানকেও পাওয়া যায় পরিচালকদের দলে।
এ ধারাবাহিকতা চলতে থাকে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরের দশকগুলোতেও। ড. তপন বাগচীর করা দশকওয়ারি তালিকা থেকে জানা যাচ্ছে, আশির দশকে লোককাহিনীভিত্তিক ছবি নির্মিত হয়েছিল সবচেয়ে বেশি, ৫৬টি। বেদের মেয়ে জোস্নার সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নির্মিত হয় বনবাসে বেদের মেয়ে জোস্না। ড. বাগচী লিখছেন, ঢাকার চলচ্চিত্রের ৩২ বছরের ইতিহাসে বেদের মেয়ে জোস্নাই একমাত্র ছবি যেটি এক কোটি টাকার সীমিত বাজার থেকে আয় করেছে ১৫ কোটি টাকা।
বকুল বসে থাকতেন এফডিসি'র গেটে
জোস্না বহুকাল যাত্রাপালা হিসেবে সারা বাংলায় মঞ্চস্থ হচ্ছিল। লোককাহিনীভিত্তিক ছবি প্রযোজনার সিদ্ধান্ত নিয়ে মতিউর রহমান পানু দায়িত্ব দিলেন বকুলকে একটি কাহিনী রচনার। বহু চেনা, বহু শোনা কাহিনীটিতে খুব বেশিকিছু যোগ করেননি বকুল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, সারল্যই কাহিনীটির প্রাণ। সেই সঙ্গে জোস্নার জেদ বৃদ্ধি করেছিল ছবিটির মান।
স্কুলে বকুল নাটক করতেন। তখন থেকেই তার লক্ষ্য ছিল সিনেমার পরিচালক হয়ে চিরকালীন আবেদনের লোকজ সংস্কৃতিকে পর্দায় তুলে ধরা। বকুল ঢাকায় আসেন ১৯৭৬ সালে। ছবির জগতে জানাশোনা কেউই ছিল না। তবুও আশায় বুক বেঁধে দিনের পর দিন আধপেটা থেকে, কখনোবা না খেয়ে এফডিসির গেটে বসে থাকতেন।
এমনি করে ১৯৭৯ সালে আব্দুস সামাদ খোকন পরিচালিত মাটির পুতুল ছবিতে প্রথম সহকারী হিসেবে সুযোগ পান। ওই সময়ই পরিচালক মতিউর রহমান পানু ও পরিচালক-প্রযোজক দারাশিকোর সঙ্গে পরিচয়। বকুল দুজনের সহকারী হিসেবেই কাজ করেছেন।
ছবিটির কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপ ও গীত সবই লিখেছেন তোজাম্মেল হক বকুল। ছবিতে গান আছে ১২টি। এর মধ্যে 'বেদের মেয়ে জোস্না আমায় কথা দিয়েছে' এবং 'আমি বন্দি কারাগারে' গানদুটি তখন মুখে মুখে ফিরেছে। প্রেম নিবেদনের মাধ্যম হিসেবে যুবক-যুবতীরা বেদের মেয়ে জোস্নার গান ব্যবহার করছেন।
'অঞ্জু পারফেক্ট আছে'
'এখনো যখন টিভিতে দেখায়, তখনো দেখি [বেদের মেয়ে জোস্না]। জোস্না প্রথম দেখি বোধকরি পূরবী (মিরপুর ১১) হলে। তারপর এশিয়া (গাবতলী) হলে। সনিতেও (মিরপুর ২) দেখেছি। স্টোরি ভালো ছবিটির। গানগুলোও বেশ,' বলছিলেন ৫৪ বছর বয়সি শরীফউদ্দিন। মিরপুর ৬ নম্বরে বিলাস কমিউনিটি সেন্টারের পাশে একটি মুদি দোকান রয়েছে তার।
দোকানটির কাছেই ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করেন জালাল মিয়া। জোস্না যখন মুক্তি পায় তখন তার বয়স ১৫ বা ১৬। শেরপুরের নালিতাবাড়িতে থাকতেন। তিনি স্মৃতিচারণ করেন, 'হলে খুব ভিড় হতো ছবিটি দেখতে। আমার মনে হয়, নালিতাবাড়ির ৯০ ভাগ লোক ছবিটি দেখেছে।'
তোজাম্মেল হক বকুল জোস্না চরিত্রটি করার জন্য প্রথমে নায়িকা রোজিনাকেই প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তখন ফোক ছবির নায়িকার কথা উঠলে সবার আগে আসত রোজিনার নাম। রঙিন রূপবান থেকে শুরু করে জিপসি সরদার, শীষ নাগ, অরুণ বরুণ কিরণমালা পর্যন্ত সব ছবির নায়িকা রোজিনা। আর রসের বাইদানি তো দারুণ ব্যবসাসফল হয়েছিল। কিন্তু ফোক-ফ্যান্টাসির নায়িকা – এমন পরিচিতি থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টায় প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন রোজিনা। তখন অঞ্জু ঘোষকে নির্বাচন করা হয়।
রোজিনা জোস্না সাজলে কি আরো ভালো হতো? শরীফউদ্দিনের মতে, 'অঞ্জুই পারফেক্ট আছে। তার মধ্যে একটা সাদাসিধা ব্যাপার আছে। সে যখন ডায়ালগ দেয় তখন মনে হয় আসল জোস্নাই কথা বলে।'
শ্যুটিং শুরু হওয়ার পর বকুল রোজিনাকে বলেছিলেন, ছবিটা ফ্লপ হলে কিন্তু আপনাকেই দুষব। এ প্রসঙ্গ ধরে বলা যায়, ছবিটির ব্যাপক সাফল্যের পেছনে অঞ্জু ঘোষের ভূমিকা কম নয়। চিন্তাবিদ ও লেখক ফরহাদ মজহার লিখেছেন, 'জোস্নাই ছবিটির কেন্দ্রবিন্দু, নায়কসহ আর বাকী সবাই তাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়।' শরীফউদ্দিনের আরেকটি কথা এখানে এঁটে যায়, 'আমরা ইয়ংরা গিয়েছি অঞ্জুকে দেখতে আর ঘরের মেয়েরা গেছে জোস্নাকে দেখতে।'
নায়িকা অঞ্জুতে জোস্নার রূপ
ফরিদপুরের ভাঙ্গা থানার চরাঞ্চলে জন্ম অঞ্জরি ঘোষের। প্রথম জীবনে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন যাত্রাপালার নায়িকা হিসাবে। চলচ্চিত্রজগতে প্রথম নায়িকা হন ১৯৮২ সালে সওদাগর ছবিতে। নরম গরম, আবে হায়াত, পদ্মাবতী, বিবাদ, ছলনা, দুর্নাম-এর মতো ছবিতে কাজ করেছেন।
শহুরে মধ্যবিত্তের সমাদর তিনি পাননি, বরং অশালীন, অমার্জিত হিসেবে গণ্য হয়েছেন। আর সেটাই সম্ভবত জোস্নার ক্ষেত্রে শাপে বর হয়েছে। ড. তপন বাগচী লিখেছেন, 'চলচ্চিত্রটি নাচে-গানে ভরপুর। বেদের মেয়ের নাচ কিছুটা অপরিশীলিত হলেও চরিত্রের সঙ্গে মানানসই। কারণ সে বেদের ঘরে লালিত-পালিত, আধুনিক শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। তাই জোস্নার পক্ষে এটি মানিয়ে গেছে। হয়তো এ কারণেই সাধারণ মানুষ একে নিজের বলে ভাবতে পেরেছে।'
জোস্নার সাফল্য সে কালের অনেক হিসেব-নিকেশই বদলে দিয়েছিল। চিত্রালীর 'প্রবেশ নিষেধ' কলামে যেমন লেখা হয়েছিল, 'বেদের মেয়ে জোস্নাতে অঞ্জু ঘোষকে নেওয়া হয়েছে। এক হিসাবে অঞ্জু ফ্লপের পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। সেই অঞ্জুই বাজিমাৎ করল। তাহলে? তাহলে বোঝা যাচ্ছে যে, শাবানা, ববিতা, রোজিনা, শবনম ছাড়াও ছবি হিট করে।'
১,২০০ সিনেমা হলের মধ্যে মফস্বলের ২০টি হল দিয়ে জোস্নার যাত্রা শুরু হয়েছিল। মুক্তি পাওয়ার সপ্তাহখানেকের মাথায় টের পাওয়া যাচ্ছিল জোস্না কিছু একটা করতে যাচ্ছে। কিন্তু তা যে সব রেকর্ড ভেঙে ফেলবে তখনো বুঝতে বাকি ছিল।
খুলনায় গোল্ডেন জুবলি সপ্তাহ পূর্ণ করেছিল জোস্না। ওখানকার পিকচার প্যালেস, মিনাক্ষী, চিত্রালী ও ঝিনুক নামের ৪টি হলের প্রতিটিতেই ১৩ সপ্তাহ ধরে টানা চলছিল বেদের মেয়ে জোস্না। তার আগে ১৯৮৯ সালের ২৮ জুলাই উদযাপিত হয় সিলভার জুবিলি (চার হলে সাত সপ্তাহ ধরে) উৎসব। এ উপলক্ষে অঞ্জু, সাইফুদ্দিন, শওকত আকবর, নাসির খানসহ ৫০ জন কলাকুশলী প্রথমে যশোর ও খুলনা ভ্রমণ করেন। যশোরের মনিহার সিনেমা হল থেকে যখন তারা খুলনার পথে রওনা হবেন, তখন গভীর রাতেও জনতার ভিড় এত বেশি ছিল যে, ছদ্মবেশ নিয়ে কোস্টারে উঠতে হয়েছিল শিল্পীদের।
৪ আগস্ট সংখ্যায় চিত্রালী প্রতিবেদক লিখেছেন, বেদের মেয়ে জোস্নার শিল্পীদের আগমনে শুক্রবার সারাদিন খুলনা ছিল উৎসবনগরী। সারা শহরে একই আলোচনা; অঞ্জু, কাঞ্চন, সাইফুদ্দিন, দিলদারকে দেখতে পারার বর্ণনা আর না পারার আক্ষেপ।
হোটেলের আশপাশে ছিল দিনভর লাগাতার ভিড়। ভিড়ের মানুষদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, কেউ কেউ বেদের মেয়ে জোস্না ১৭–১৮ বারও দেখেছেন। বউ স্বামীকে ফাঁকি দিয়ে, কানের গহনা বিক্রি করে, কেউবা দোকানের মালপত্র বিক্রি করে জোস্না দেখেছেন একাধিকবার।
ভদ্রলোকের 'পাগল দশা'
জোস্না যে এত সাফল্য পাবে তা প্রযোজক-পরিচালকদের কেউ ভাবেননি। সে কালে মুক্তির আগেই ছবির গান বিক্রি করে দেওয়ার চল ছিল। জোস্নার ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলা ট্রিবিউন-এর সঙ্গে এক আলাপচারিতায় ইলিয়াস কাঞ্চন বলেছিলেন, "ছবিটির শ্যুটিংয়ের মধ্যে বুঝতে পারি এটি হিট হবে, কিন্তু সুপারহিট হবে তা ভাবতে পারিনি। এক ব্যবসায়ী যেমন অডিও কিনে নিয়েও পরে তা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। পরে যিনি কিনেছিলেন, তিনি অডিওর লাভেই এক কোটি টাকা দিয়ে একটি বাড়ি কিনেছিলেন। আর আগের ভদ্রলোকের তো প্রায় পাগল অবস্থা। টানা ছয়মাস অসুস্থ ছিলেন। শরীর একটু ভালো হলেই বলতেন, 'এ আমি কী করেছি!'"
জোস্নার আধিপত্যে অন্য প্রযোজক-পরিচালকেরা বসে পড়েছিলেন। কারণ নতুন কোনো ছবি মুক্তি দেওয়া যাচ্ছিল না। চিত্রালীর প্রতিবেদক বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পেয়েছেন, 'জোস্না যে হলে চলছে, সেখান থেকে আর নামছে না। যশোরের মনিহারের মতো প্রেক্ষাগৃহে ১১ সপ্তাহ উত্তীর্ণ হবার পরেও বেদের মেয়ে জোস্না চলছে। ঐ ছবির বিপরীতে অন্য হলে অন্য ছবিগুলো বেদম মার খাচ্ছে। জোস্নার কারণে যশোরের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনে এক মাসে আটটি নতুন ছবির ব্যবসা ফেঁসে গেছে।'
চিত্রালীর খবরে আরও জানানো হয়, জোস্নার অবৈধ ভিডিও ক্যাসেট দেশের অধিকাংশ স্থানে চলছে। সিনেমা হলে টিকিট না পেয়ে অনেকে ভিডিও ক্যাসেটের পেছনে ছুটছেন। ঢাকার বাইরে মফস্বল অঞ্চলে বেদের মেয়ে জোস্নার ভিডিও ক্যাসেটের ভাড়া প্রতি তিন ঘণ্টার জন্য ১০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্তও হয়েছে। যে বাসায় ঐ ক্যাসেট দেখানো হতো, সে বাসার মালিক অনেক সময় উৎসাহী পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে ১০–২০ টাকা করে নিয়ে রীতিমতো প্রদর্শনীর আয়োজন করতেন।
পশ্চিমবঙ্গেও জোস্নার জয়
জোস্নাকে ভালো না লাগা লোকেদের সংখ্যা বোধহয় লঘু। ছবিটি দেশের বাজারে এতটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যে তার রেশ চলে গিয়েছিল প্রতিবেশী ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও। ১৯৯১ সালে সেখানে মতিউর রহমান পানু ছবিটির রিমেক করেন। নায়ক চিরঞ্জিতের বিপরীতে নায়িকা ছিলেন অঞ্জুই। আরেকটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন কৌশিক ব্যানার্জি।
পশ্চিমবঙ্গেও তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল জোস্না। ছবিটি রমরমিয়ে চলছে, জানতে পেরেছিলেন সত্যজিৎ রায়ও। কোনো একদিন সত্যজিতের বাড়ি যান কৌশিক। সত্যজিৎ বললেন, তোমরা নাকি একটি ছবি করেছ, লোকে খুব দেখছে, তা ছবিটির গল্পটা একটু বলো তো। কৌশিক ভাবছেন কী বলবেন। বীণ বাজানো, কারগারে মশা কামড়ানোর কথা কি রায়বাবুকে বলা যায়? তিনি বললেন, 'না, ওসব আপনি কী শুনবেন। সেরকম মানসম্মত কোনো ছবি না। মানে…'
সত্যজিৎ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, 'না, না, না, তুমি এভাবে বলতে পারো না। ছবিটি লোকে দেখছে, তার মানে এতে কিছু একটা আছে যেটা মানুষকে টানছে। সে রকম স্পেশাল কী আছে সেটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করো।'
পঁয়ত্রিশে জোস্না
এ বছর জোস্নার বয়স হয়েছে পঁয়ত্রিশ। সুদীর্ঘ এক প্রবন্ধে ফরহাদ মজহার জোস্নার সাফল্যের সুলুকসন্ধান করেছেন। প্রথম যে জায়গাটায় তিনি আলো ফেলেছেন, তা হলো 'জোস্না' বানানে। তার মতে, জ্যোৎস্না শব্দের 'ৎ' ত্যাগ করায় নামটি সহজ ও লৌকিক হয়েছে। নইলে আভিজাত্যের ভারে ভারী হয়ে যেত। 'জোস্না বানানের মেয়েটি গ্রাম্য, সাধারণ, সহজ ও স্বতঃস্ফুর্ত। রবিবাবুর জোছনাও হয়নি নামটি। তখন এক উন্নাসিক মধ্যবিত্তের বিবাহযোগ্যা কন্যার কথা মনে পড়ে যেত।'
ফরহাদ লিখছেন, 'কোথায় যেন ছবিটি গ্রাম ও শহরের মধ্যে একটা পার্থক্য ঘটাতে পেরেছে। এটা স্পষ্ট যে শহরের আবেগ ও সংস্কৃতির সঙ্গে অভ্যস্ত ধনী, মধ্যবিত্ত বা শিক্ষিত সম্প্রদায়ের তো প্রশ্নই ওঠে না, এমনকি শহুরে শ্রমিকদের কাছেও ছবিটি তেমন গ্রহণযোগ্য হয়নি। কিন্তু গ্রামে কৃষকসুলভ গ্রামীণ চৈতন্যকে ছবিটি নাড়া দিয়েছে। ছবিতে মৌলিক সংঘাতটা বেদের মেয়ে জোস্নার সঙ্গে বঙ্গরাজার। জোস্না অনেকবারই তার ডায়ালগে বলে যে, সে গরীব এবং বেদেপাড়ায় আমরা সত্যি সত্যি গরীব অধিবাসীদের দেখি। অতএব আপাতদৃষ্টিতে সে গরীবের প্রতিনিধি।'
আগামীতে ছবিটির বয়স যখন ৫০ হবে তখনো ফরহাদ মজহারের প্রবন্ধটি সমান উপভোগ্য থাকবে বলেই মনে হয়। আর তখনো হয়তো কোনো লেখক আফসোস করে বলবেন, ৫০ বছর হয়ে গেল, আমরা জোস্নার মতো সরল, সহজ ও গীতল আর একটি ছবিও তৈরি করতে পারলাম না। সে আফসোস সত্যি না হোক, এ-ই আমাদের কামনা।