শুভ জন্মদিন অ্যাঙ্গেলা মার্কেল
গত ১৭ জুলাই ছিল জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল এর ৬৬তম জন্মদিন। এক অনাড়ম্বর পরিবেশে নিজের জন্মদিন উদযাপন করেন তিনি। অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের সম্পর্কে ইতোমধ্যে বেশ কিছু ঘটনা জানা যায়: তিনি বাস্তববাদী মানুষ, মোটেও অহংকারী নন, স্বামীর সঙ্গে থিয়েটার অপেরাতে যেতে পছন্দ করেন এবং প্রতিবছর একই জায়গায় ছুটি কাটাতে পছন্দ করেন।
এরপরও কয়েকটি কারণ তাঁকে জনগনের অনেক কাছে পৌঁছে দিয়েছে। কারণগুলো এখানে উল্লেখ করছি-
তিনি তার ক্ষমতা টিকে রাখতে পঞ্চমবারের জন্য কল্পনা না করে আগামী নির্বাচনে না দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ইতোমধ্যেই তিনি নিজ দল ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন (সিডিইউ) প্রধানের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন।
চ্যান্সেলর মার্কেল করোনার মহামারি শুরুর পর থেকেই একটি অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন। সংক্রমণ এবং ভুক্তভোগীদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যার পরে ফেডারেল প্রজাতন্ত্রের সমস্ত জনজীবন বন্ধ ছিল। টানা তিন মাস সম্পূর্ণ লকডাউন ছিল দেশটিতে। এর ফলে চ্যান্সেলর এবং তার অনেক সহকর্মীদেরও দীর্ঘ সময়ের জন্য কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয়েছে।
তা সত্ত্বেও, তিনি তার সাময়িক আইসোলেশনে বাড়িতে বসে সরকারি কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন। যদিও তার প্রচলিত সংবেদনশীল ব্যবহারের জন্য পরিচিত মার্কেল বেশ শান্ত ছিলেন।
এই নজিরবিহীন সংকটের মধ্যেও জার্মানির সাধারণ নাগরিকদের জন্য বিপুল অর্থনৈতিক প্রণোদনা (প্রায় এক ট্রিলিয়ন ইউরো) অনুমোদন দিয়েছেন মার্কেল, যা তাকে জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস এনে দিয়েছে।
অবশ্য প্রথমদিকে মাস্ক ব্যবহার না করায় সমালোচনার মুখে পড়েন মার্কেল। তবে একটি সংবাদ সম্মেলনে তার দলের এক রাজনীতিবিদ বলেন, যেহেতু মার্কেল সামাজিক দূরত্বের নিয়মগুলো মেনে চলছেন কাজেই তাকে মাস্ক পরতে হবে না।
করোনা মহামারিতে মৃত্যুর হার পশ্চিম ইউরোপে, বিশেষ করে জার্মানিতে সবচেয়ে কম। কিন্তু অ্যাঙ্গেলা মার্কেল সেসবে তার নিজের একার কৃতিত্ব বলে মনে করেন না।
তার ১৫ সদস্যের মন্ত্রীসভা আর পার্লামেন্টের সিদ্ধান্তেই, করোনা মহামারিতেও জনগনের আস্থা অর্জন করেছেন তিনি। প্রতিটি শ্রমিক, কর্মচারী তাদের মাসিক বেতন পেয়েছে, খাদ্য উৎপাদন নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে চলেছে।
এমনকি ইতালি স্পেন থেকে শত শত কোভিড-১৯ আক্রান্ত মানুষদেকে জার্মানিতে স্পেশাল প্লেনে নিয়ে এসে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়েছে। সর্বোপরি জার্মান স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিনামূল্যে জনগনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়ে করোনা মোকাবেলা করায় এখনো ইউরোপের শীর্ষ স্থানে আছে দেশটি।
জনগনের আস্থা অর্জন করার আরেকটি কারণ হলো- দীর্ঘ ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকার পরে তিনি ২০২১ সালে চ্যান্সেলর হিসেবে আর নির্বাহী চেয়ারে না বসে তার আসনটি ছেড়ে দিচ্ছেন। এটা অবশ্য তিনি একবছর আগেই ঘোষণা দিয়েছেন। ইতোমধ্যেই দলের প্রধান থেকে ইস্তফা দিয়েছেন।
গত শুক্রবার (১৭ জুলাই), নিজের ৬৬ তম জন্মদিন উদযাপন করলেন মার্কেল। একটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তিনি এই দিনটি কিভাবে উদযাপন করলেন?
সন্তানহীন অ্যাঙ্গেলা মার্কেল তার স্বামী ইয়োখিম জাউয়ার (৭১) এর সঙ্গে ঘরোয়াভাবেই কাটালেন। মার্কেলের স্বামী ইয়োখিম জাউয়ার, বার্লিন হুম্বোল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কোয়ান্টাম রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যাপক। বার্লিনে তার সাথে একটি ৫ রুমের এপার্টমেন্টে বসবাস করেন তারা। সরকারি চ্যান্সেলর বাংলোতে তিনি থাকেন না, শুধু অফিস করেন।
জন্মদিনে সম্ভবত তারা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গেও চ্যাট করেছেন, তবে এসব খবর পত্রিকায় ছাপা হয় না। চ্যান্সেলরের ৬৬তম জন্মদিনে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো অনুষ্ঠানও হয়নি। হতে পারে যে তিনি এক গ্লাস চেরি ভদকার সাথে একান্তভাবে তার স্বামীর সঙ্গেই দিনটি উদযাপন করেছেন, যে পানীয়টি তরুণ বয়সে ছাত্র জীবনে অ্যাঙ্গেলা উপভোগ করতেন।
অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের জীবন: কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানী থেকে চ্যান্সেলর
১৯৫৪ সালে হামবুর্গের অ্যাঙ্গেলা কাসনার হিসাবে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। সাবেক পূর্ব জার্মানিতে কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানী নিয়ে পড়াশোনা করেন।
সাত বছর আগে একজন চিত্রপ্রতিবেদক কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করার সময় সমাজতান্ত্রিক দলে মার্কেলের জীবন ও কাজ নিয়ে একটি প্রতিবেদন করেন। সেখানে অ্যাঙ্গেলা বলেন, 'কাজ করার সময় ব্যাকগ্রাউন্ডে, প্রায়শই পশ্চিম সংগীত শুনতাম আমি। মস্কোতে আমার বিটলসের প্রথম এলপি রেকর্ড কিনেছিলাম"। পশ্চিমা শিল্পীদের মধ্যে, বিটলস এবং রোলিং স্টোনকে তার বেশি পছন্দ, এমনটাই জানান তিনি সাক্ষাৎকারে।
১৯৭৭ সালে বিয়ে করেন উলরিখ মার্কেলকে। ৫ বছর সংসার করার পর ১৯৮২ সালে ছাড়াছাড়ি হয় তাদের। তবে প্রথম স্বামী উলরিখ মার্কেলের নামটিই এখনও ব্যবহার করেন অ্যাঙ্গেলা।
১৯৯৮ সাল থেকে তিনি কোয়ান্টাম রসায়নবিদ ইয়োখিম জাউয়ার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, যার সাথে তার ১৪ বছর আগে দেখা হয়েছিল।
১৯৮৯ সালে বার্লিনের প্রাচীর পতনের সময়টিতে কি করছিলেন মার্কেল? তার বয়স তখন ৩৪ বছর। অ্যাঙ্গেলা মার্কেল জানান, বার্লিন প্রাচীরের পতনের রাতে সংক্ষিপ্তভাবে উদযাপন করলেন এবং খুব শীঘ্রই ঘুমাতে চলে গেলেন। বাইরে তখন কয়েক হাজার মানুষ, ভোরের প্রথম প্রহরে তারা উদযাপন করছে এক নতুন বিশ্বব্যবস্থাকে।
২০০৫ সালে ফেডারেল চ্যান্সেলর নির্বাচিত হওয়ার আগে অ্যাঙ্গেলা মার্কেল দু'বার 'হেলমুট কোল' মন্ত্রীপরিষদে একবার ফ্যামিলি ও ইয়ুথ এবং একবার পরিবেশ ও জলবায়ু মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এরপর টানা তিনবার চ্যান্সেলর নির্বাচনের পদপ্রার্থী হিসেবে "প্রথম" হয়েছিলেন। অ্যাঙ্গেলা মের্কেলের আগে জার্মানির সাত জন চ্যান্সেলর এসেছেন, তারা সবাই ছিলেন পুরুষ।
২০০৫ সালে চ্যান্সেলর নির্বাচনে জয়ী হন অ্যাঙ্গেলা। জার্মানির ইতিহাসে প্রথম কোন বিজ্ঞানী ফেডারাল চ্যান্সেলর পদে অধিষ্ঠিত হলেন।
নিজের পূর্ব জার্মানির শেকড়, শিক্ষার জন্য তিনি আজো ধন্যবাদ দেন, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। অ্যাঙ্গেলা মার্কেল নতুন ফেডারেল রাজ্যগুলো থেকে আসা প্রথম চ্যান্সেলর। বয়সের দিক থেকেও তার পূর্বসূরিদের থেকেও আলাদা ছিলেন তিনি - মাত্র ৪৫ বছর বয়সে দলের প্রধান ও ৫১ বছর বয়সে চ্যান্সেলর হন তিনি। শপথ গ্রহণের সময় সবচেয়ে কম বয়সী চ্যান্সেলর ছিলেন মার্কেল।
মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা তাঁর বিদায়ী সফরে বার্লিনে শেষ যাত্রা করেছিলেন। তাকে বিদায় জানানোর সময় মার্কেল তার অনুভূতি প্রকাশ করেছিলেন দারুণভাবে।
এর তিন বছর পরে ওবামার ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা বেন রোডস এর "দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যাজ ইট ইজ: এ মেময়ের অফ থে ওবামা হোয়াইট হাউজ" বইটি বের হয়। সেখানে জার্মানিতে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ওবামার এই শেষ যাত্রার বর্ণনা দিয়েছেন বেন। তার বস এবং অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের মধ্যে সম্পর্ক সম্পর্কে অসাধারণ তথ্য প্রকাশ করেছিলেন বেন।
তিনি লেখেন, 'তাদের দু'জন তিন ঘন্টা একসঙ্গে বসে ডিনার করছেন, সারা পৃথিবীর সমস্যা নিয়ে কথা বলেছেন। ওবামা তার মেয়াদকালে আর কোনও রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়ার চেয়ে বেশি সময় ধরে বসে থাকেননি কখনো। বিদায়ের সময়, তাদের দুজনের চোখেই অশ্রু ঝলমল করেছিল, যা স্ব-নিয়ন্ত্রিত অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের জন্যও ছিল বিরল।'
শুধু নিজ দেশেই নয়, সারা বিশ্বে একজন বিচক্ষণ রাজনৈতিক নেতার আসন দখন করেছেন অ্যাঙ্গেলা মার্কেল। ইউরোপের প্রতিবেশি ফরাসি, ইতালিসহ সকল দেশের সাথে এক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন, একসময় "ম্যার্কোজি" নামে মার্কেল-সার্কোজি জুটি ফরাসি ও জার্মান সংস্কৃতির উন্নয়ন সাধন করেছেন।
আজ থেকে ১৫ বছর আগেও আমি অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের সমর্থক ছিলাম না। কিন্তু বিগত কয়েক বছর তার রাজনৈতিক জীবন পর্যবেক্ষণ করেছি, ব্যক্তিগতভাবেও তার সঙ্গে একবার দেখা করার সুযোগ হয়েছে।এই অভিজ্ঞতা থেকেই আমার মনে তার প্রতি একটা আস্থাভাজনতা ও সহনশীলতা গড়ে উঠেছে। তাই তাঁর চ্যান্সেলর হিসেবে এই শেষবারের মতো জন্মদিনে বিস্তারিত পর্যালোচনা করলাম। শুভ জন্মদিন অ্যাঙ্গেলা ♥
লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা; জার্মানিতে 'এশিয়া টুডে'র সম্পাদক