কাসাভা চাষের জন্য উজাড় হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চল, হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য
খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার পিঠাছড়া এলাকায় ১০ একর পাহাড়ি বনভূমির মালিক আবু তাহের। ৩৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে তাহেরের এই পাহাড়ি বনভূমিতে ৫০টিরও বেশি প্রজাতির গাছ, বিভিন্ন স্তন্যপায়ী, উভচর প্রাণি, পাখি ও সরীসৃপের আবাসস্থল ছিল। তাহের মাঝে মাঝে ফল ও কাঠ সংগ্রহ করতে এই বনে যেতেন। কিন্তু, গত বছরের ডিসেম্বরে তাহের সেখানে গিয়ে দেখতে পান তার ১০ একর বনভূমির সব গাছপালা কেটে উজাড় করে ফেলা হয়েছে।
তাহের দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড (টিবিএস)-কে জানান, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনীতিবিদসহ প্রভাবশালীরা কাসাভা চাষের জন্য জায়গা তৈরি করতে সব গাছ ও ঝোপঝাড় কেটে ফেলেছেন, যা স্থানীয়ভাবে শিমুল আলু নামে পরিচিত। দক্ষিণ আমেরিকার বিশেষ জাতের এ শষ্য গত কয়েক বছর ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে চাষ হচ্ছে।
গত ২৭ মার্চ খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা ও মানিকছড়ি উপজেলার বেশ কয়েকজন বাসিন্দা জানান, কাসাভা চাষের জন্য শত শত একর বনভূমি উজাড় করা হয়েছে এবং প্রতি বছর চাষের পরিমাণ বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে কাসাভা বা শিমুল আলুর মতো কন্দ শস্য চাষের জন্য বন কেটে ফেলা বৈজ্ঞানিকভাবে সঠিক নয়। এই ধরনের কৃষি পদ্ধতি মাটি ক্ষয়ের দিকে পরিচালিত করতে পারে এবং ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে, বিশেষত পার্বত্য অঞ্চলে।
তারা বলেন, ভূমিধস ও মাটির উপরের স্তরের ক্ষয়রোধে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই) ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক নির্ধারিত সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক চাষাবাদ পদ্ধতি অনুসরণ করেন না কৃষকরা।
এসআরডিআই অনুসারে, কৃষকদের পাহাড়ের ঢাল কাটার অনুমতি নেই। যদি তারা তা করে তবে বৃষ্টির পানি উপরিভাগের মাটি ধুয়ে ফেলবে এবং ভূমিধস হবে। কাসাভা পাহাড়ে বা পাহাড়ের ঢালুতে চাষাবাদ না করে সমতল ভূমিতে চাষাবাদের পক্ষে মতামত দেন তারা।
আবু তাহের টিবিএসকে বলেন, "বিভিন্ন বন্যপ্রাণি যেমন বানর, লজ্জাবতী বানর, গন্ধগোকুল, বিভিন্ন পাখি এবং সাপের আবাসস্থল ছিল এই বনভূমি। কিন্তু তারা গাছ এবং ঝোপঝাড় কেটে ফেলার পরে এসব প্রাণীদের আর এখানে দেখা যায় না। অনেক জমির মালিক এখন কাসাভা চাষের জন্য তাদের জমি ইজারা দিচ্ছেন। আমি তা করিনি, তাই তারা জোর করে আমার বন ধ্বংস করেছে।"
মাটিরাঙ্গার বাসিন্দা জামাল উদ্দিন তাহেরের জমিসহ ২০০ একর জমিতে কাসাভা চাষ করছেন। জামাল কাসাভা চাষের জন্য বন পরিষ্কার করার কথা স্বীকার করলেও জোর করে বা মালিকদের সম্মতি ছাড়াই জমি নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
তিনি বলেন, "আমি এসব জমি ইজারা নিয়েছি। জবরদস্তি, দখলের অভিযোগ সত্য নয়। অনেক সময় মালিকের অনুপস্থিতিতে এসব জমির তত্ত্বাবধায়করা ইজারার টাকা লেনদেন করেন।" তবে জামালের দাবির সত্যতা যাচাই করতে পারেনি টিবিএস।
কাসাভা চাষের সঙ্গে জড়িত বেলছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য আহসান উল্লাহ নামে স্থানীয় আরেক প্রভাবশালী ব্যক্তিও অবৈধভাবে জমি দখলের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
"জমির মালিকরা স্বেচ্ছায় তাদের জমি আমাদের কাছে ইজারা দিয়েছেন। আমরা প্রতি বছর একর প্রতি ১০ হাজার টাকা পরিশোধ করি, সাধারণত জুন থেকে জুন পর্যন্ত হিসাব হয়। এ বছর ৭০ একর জমিতে কাসাভা চাষ করেছি"- বলেন তিনি।
স্থানীয়রা জানান, কাসাভাসহ কন্দ শস্য চাষ সম্প্রসারিত হওয়ায় পিঠাছড়ার বন্যপ্রাণীও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
মাটিরাঙ্গায় ১২০০ একর পাহাড়ি বনাঞ্চলে এখন কাসাভা চাষ হচ্ছে এবং কাসাভা চাষ মাটিরাঙ্গা ছাড়িয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। প্রাণ এগ্রো বিজনেস লিমিটেড ও রহমান কেমিক্যাল লিমিটেডের তথ্য অনুসারে, খাগড়াছড়িতে তাদের সর্বমোট ৬ হাজার ৬০০ একর কাসাভা বাগান রয়েছে।
এই কোম্পানি দুটির লক্ষ্য ২০২৬ অর্থবছরের মধ্যে কাসাভা চাষ ১৫ হাজার একর পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা। প্রাণ এগ্রোর লক্ষ্য রাঙামাটিতে কাসাভা চাষ ৩৭৮ একর থেকে এক হাজার একরে উন্নীত করা। এছাড়া ২০২৪ অর্থবছরে ১৫০ একর বনভূমি দিয়ে প্রাণ এগ্রো বান্দরবানে কাসাভা চাষ শুরু করে। তাদের তথ্য মতে, ২০২৬ অর্থবছরে তা এক হাজার একর জমিতে পৌঁছাবে।
পিঠাছড়া বন ও বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ উদ্যোগের প্রতিষ্ঠাতা মাহফুজ আহমেদ রাসেল টিবিএসকে বলেন, "পার্বত্য চট্টগ্রামে কাসাভা চাষের দ্রুত বিস্তার উদ্বেগজনক। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বনাঞ্চল পুরোপুরি বিলীন হয়ে যেতে পারে। এই চাষাবাদ আমাদের পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য এবং বন্য প্রাণিদের জন্য ক্ষতিকারক ও জলবায়ু সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।"
পার্বত্য জেলাগুলোতে প্রায় ১৯ বছর কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (শস্য) মো. ওমর ফারুক বলেন, পাহাড়ে বর্তমানে কাসাভা, কচু, আনারস, আদা ও হলুদ চাষাবাদে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে না। তদুপরি কাসাভার শিকড় খুব গভীরে যায়। ফসল তোলার সময় পাহাড় এবং ঢালে ব্যাপক মাটি খননের প্রয়োজন হয়।
এতে বর্ষা মৌসুমে ভূমিক্ষয় হয়, যা পাহাড়ে ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়ায়। বন ও ঝোপঝাড় পরিষ্কার করার সময় কৃষকরা কখনো কখনো আগাছানাশক ওষুধ ব্যবহার করে ঝোপঝাড় উজার করে, যা পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্যও হুমকিস্বরুপ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কাছে কাসাভা চাষের কোনো তথ্য নেই। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (রাঙামাটি অঞ্চল) অতিরিক্ত পরিচালক তপন কুমার পাল বলেন, "যেহেতু পুষ্টিগুণ সম্বলিত অর্থকরী ফসল হিসেবে কাসাভার প্রাধান্য পাচ্ছে এবং এর বাণিজ্যিক আবাদ বিস্তৃত হচ্ছে, সেহেতু এর উৎপাদন যেন পরিবেশগতভাবে টেকসই পদ্ধতিতে করা হয় তা নিশ্চিত করাই আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে মাটির ক্ষয় রোধে মাটি খনন কমিয়ে আনা জরুরি।"
কেন কাসাভা চাষ করা হয়?
কাসাভা অনেক দেশে তার পুষ্টি উপাদানের জন্য খাদ্য হিসেবে জনপ্রিয়। বাংলাদেশে কাসাভার স্টার্চ পাউডার টেক্সটাইল ও ফার্মাসিউটিক্যালসের মতো শিল্পে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এর বেশিরভাগই আমদানি করতে হয়। স্থানীয় কোম্পানিগুলো চাহিদা মেটাতে কাসাভা চাষ করছে। বর্তমানে দেশে প্রতি বছর ৫০ হাজার টনেরও বেশি কাসাভা উৎপাদন হয়, যা চাহিদার মাত্র ২%। কাসাভা ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে আহরণ করা হয় এবং রোপণের পরে প্রায় সাত থেকে আট মাস সময় লাগে।
রহমান কেমিক্যাল লিমিটেড ও প্রাণ এগ্রো বিজনেস লিমিটেড পার্বত্য চট্টগ্রামে চুক্তি-ভিত্তিক চাষাবাদ বা কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে কাসাভা চাষ করছে।
কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের মাধ্যমে দেশে ২০১৪ সালে প্রাণ কাসাভা প্রকল্প শুরু করে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে ১২.৫ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়ে প্রাণ ২০১৩ সালে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হবিগঞ্জে একটি স্টার্চ এবং তরল গ্লুকোজ প্ল্যান্ট স্থাপন করে। রহমান কেমিক্যাল লিমিটেডের কারখানা ঢাকায় অবস্থিত।
সাবেক ইউপি সদস্য আহসান উল্লাহ বলেন, "প্রাণ কাসাভা চাষের জন্য প্রায় ৮০ শতাংশ টাকা অগ্রিম দেয়। প্রতি একর জমির জন্য তারা আমাদের প্রায় ২০ হাজার টাকা দিয়েছে। আমাদের ৩০ হাজার টাকা খরচ করতে হচ্ছে। প্রতি একর জমিতে আমরা প্রায় ৬.৫ টন কাসাভা উৎপাদন করতে পারি এবং প্রাণ আমাদের কাছ থেকে তা কিনে নেয়।"
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, জামালপুর ও কুমিল্লাসহ বেশ কয়েকটি জেলায় কাসাভা চাষ হচ্ছে। তবে সবচেয়ে বেশি কাসাভা উৎপাদন হয় খাগড়াছড়িতে।
রহমান কেমিক্যালের প্রকল্প পরিচালক রেজাউল করিম টিবিএসকে বলেন, "খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলায় ৪০০ একর সহ ১৩০০ একর জুড়ে আমাদের কাসাভা প্রকল্প রয়েছে।"
অনিয়ন্ত্রিত চাষের জন্য হচ্ছে বন উজার
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট বনভূমির প্রায় ৩১ শতাংশ পার্বত্য চট্টগ্রামে অবস্থিত, যার ৮৪% প্রাকৃতিক এবং ১৬% আবাদি।
বান্দরবানের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আব্দুর রহমান জানান, আম, আনারসসহ বিভিন্ন ফলের বাগানের পাশাপাশি বিভিন্ন কন্দ শস্য যেমন আদা, কচু পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক পাহাড়ি বনাঞ্চল ধ্বংস করছে।
বর্তমানে কাসাভা পার্বত্য চট্টগ্রামে আরেকটি হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বেশ কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে যে গত তিন দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বনাঞ্চল দ্রুত হ্রাস পেয়েছে, মূলত বিভিন্ন মনুষ্যসৃষ্ট বাগান এবং কন্দ শস্য চাষের কারণে।
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ২০২৪ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত 'পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়িতে বন উজাড়ের কার্বন পরিণতি: একটি জিআইএস এবং রিমোট সেন্সিং পদ্ধতি' শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৯০ সাল থেকে ২০২০ সালের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে ৪০.৫০% বনভূমি বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল আরইডিডি+ স্ট্র্যাটেজি (বিএনআরএস) উল্লেখ করেছে যে বাণিজ্যিক কৃষির পরিবর্তনের কারণে পাহাড়ে বন উজাড় এবং ভূমি অবক্ষয়ের মতো ঘটনাগুলো ঘটছে।
বিএনআরএস অনুসারে, বন উজাড়ের পরে, প্রায় ৯৬.৫১% জমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট গাছ, বাগান এবং অন্যান্য বৃক্ষরোপণের (গুল্ম) জন্য ব্যবহৃত হয়। এভাবে করা হয় মূলত স্থানান্তরিত চাষের জন্য, যেখানে ছোট অঞ্চলগুলো চাষের জন্য পরিষ্কার করা হয় এবং কয়েক বছর পরে পরিত্যক্ত হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, পার্বত্য অঞ্চলে প্রায় ৩৯ ধরনের ফল ও তিন ধরনের কন্দ জাতীয় শস্য চাষ হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় ২ লাখ ৪৩ হাজার ৯৮১ একর জমিতে ফলের চাষ হয়েছে এবং তা প্রতিবছরই বাড়ছে। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে জমির পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৬২ হাজার ৪৫৩ একর।
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের এক গবেষণার কথা উল্লেখ করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (শস্য) মোঃ ওমর ফারুক বলেন, আদা, হলুদ, কচু ও কাসাভার মতো কন্দ ফসল চাষের ফলে প্রতি হেক্টরে (২.৪৭ একর) ৫৮ টন থেকে ৮০ টন পর্যন্ত মাটির ওপরের স্তর ক্ষয় হয়।
পানির স্তর শুকিয়ে যাচ্ছে
২৭ মার্চ পিঠাছড়া পাহাড়ি ঝর্ণা ঘুরে দেখা যায়, গোমতী নদীতে মিশে যাওয়া ঝর্ণাটি প্রায় শুকিয়ে গেছে। সাড়ে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ এই ছড়ার এক কিলোমিটার প্রায় বিলীন হয়ে গেছে, বাকি অংশ হারিয়ে যাওয়ার পথে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বন উজাড় আদিবাসীদের জন্য সংকট সৃষ্টি করছে। যারা জলপ্রপাত, খাঁড়ি এবং ছড়ার মতো প্রাকৃতিক জলের উৎসের ওপর নির্ভর করে, তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এ অবস্থার আরও অবনতি হচ্ছে।
স্থানীয় সম্প্রদায়ের মতে, বন উজাড় পানি সংকটের প্রধান কারণ। ক্রমবর্ধমান বন উজাড়ের কারণে পানির স্তর শুকিয়ে যাচ্ছে।
মাটিরাঙ্গা উপজেলার বাসিন্দা কাঞ্চন মালা ত্রিপুরা বলেন, "আমাদের বাড়ি ছিল মাটিরাঙ্গার গভীর জঙ্গলের মধ্যে। ২০২১ সালে আমাদের এলাকায় কাসাভা চাষ শুরু হওয়ায় কয়েকশ একর বনভূমি উজাড় হয়ে যায়। ফলে পাহাড়ি ঝর্ণা শুকিয়ে যাওয়ায় পানীয় জল আনতে আমাদের কয়েক মাইল পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে।"
আরেক বাসিন্দা পরীমনি চাকমা বলেন, "আগে আমরা গুঁইসাপ ও বন্য শুকরের মতো বনজ খাবারের ওপর নির্ভর করতাম। তবে এসব প্রাণী এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে।"
বন গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. আকতার হোসেন পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ধ্বংসের জন্য কর্পোরেট কোম্পানিগুলোকে দায়ী করেন।
তিনি জানান, এই বনগুলো প্রাকৃতিক স্পঞ্জ হিসেবে কাজ করে যা বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করে এবং ধীরে ধীরে এটি পাহাড়ি স্রোতের মাধ্যমে ছেড়ে দেয়। যার ওপর বন্যপ্রাণি এবং আদিবাসীরা নির্ভর করে।
ড. আকতার বলেন, "ফল ও কন্দ জাতীয় শস্য চাষের জন্য গাছ কাটা এবং পাহাড়ের ঢাল ভেঙে ফেলার ফলে পাহাড়ের পানির প্রবাহ হ্রাস পায়। যা মারাত্মক পানি সংকট সৃষ্টি করে। এটি পাহাড়ে বসবাসকারী এবং বন্যপ্রাণী উভয়কেই বিপন্ন করে, তাদের পাহাড়ে বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে বাধ্য করে এবং মানুষ ও বন্যপ্রাণীর মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি করে।"
বাস্তুতন্ত্রের জন্য বিপদ
বিশেষজ্ঞরা আরও উল্লেখ করেছেন যে পার্বত্য চট্টগ্রামের পুরো বাস্তুতন্ত্র ভেঙে পড়ছে, সঠিক তত্ত্বাবধানের অভাবে বনাঞ্চল আশঙ্কাজনক হারে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
বাস্তুশাস্ত্র ও জীববৈচিত্র্য বিশেষজ্ঞ পাভেল পার্থ বলেন, "পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস করে এক জাতীয় ফসল চাষ খুবই বিপজ্জনক কাজ।"
তিনি বলেন, "সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাণিজ্যিকভাবে কাসাভা চাষ শুরু হয়েছে, যা খুবই উদ্বেগজনক। সেগুন, রাবার, তামাক, ইউক্যালিপটাস এবং বাবলা চাষের মনোকালচারের কারণে এই অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্র ইতোমধ্যে বিপন্ন হয়ে পড়েছে। তাই কাসাভা পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য বিপর্যয় নিয়ে আসতে পারে।"
পাভেল ব্যাখ্যা করেন, "বাণিজ্যিকভাবে একজাতীয় ফসল চাষ এ অঞ্চলের মাটির অণুজীব, পরাগরেণু, জলাশয় ও কার্বন শোষণ ক্ষমতা ধ্বংস করতে পারে। এটি এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক বন পুনর্জন্ম ব্যবস্থাকেও বাধাগ্রস্ত করছে।"
তিনি বলেন, বাণিজ্যিক কাসাভা চাষ শুধু বন্যপ্রাণি ও স্থানীয় আদিবাসীদের খাদ্য সংকটই সৃষ্টি করছে না, তাদের চলাচলের পথ ও বাসস্থান দখল করে নিচ্ছে।
কেউ দায়ভার নিতে চাচ্ছে না
রহমান কেমিক্যালের কাসাভা প্রকল্প পরিচালক রেজাউল করিম পাহাড়ি বনাঞ্চলে কাসাভা চাষের কথা স্বীকার করে বলেন, "আমরা পরিবেশের ক্ষতি করছি না। আমরা তুলনামূলক সমতল জমিতে চাষাবাদ করি।"
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল টিবিএসকে বলেন, "আমরা এমনভাবে চাষাবাদ করি না, যাতে জীববৈচিত্র্য, বন্যপ্রাণি ও বনের ক্ষতি হয়। আমরা পাহাড় কাটি না। যেসব এলাকায় জীববৈচিত্র্য বা বন্যপ্রাণির সঙ্গে কোনো সংঘর্ষ নেই, সেসব এলাকায় আমরা চাষাবাদ করি। যেখানে গাছ ও পাহাড় কাটার প্রয়োজন নেই সেখানে অব্যবহৃত বা অনাবাদি জমিতে চাষাবাদ করতে কৃষকদের উৎসাহিত করছি।"
পার্বত্য বনাঞ্চল ভূমি মন্ত্রণালয়ে অধীনে। যার প্রতিনিধিত্ব করেন জেলা প্রশাসক। তবে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক মোঃ সহিদুজ্জামান জানান, পাহাড়ি বনে কাসাভা চাষ সম্পর্কে তার তেমন কোনো ধারণা নেই।
নির্বিচারে ফল ও কন্দ জাতীয় শস্য চাষ নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে অদূর ভবিষ্যতে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম হুমকির মুখে পড়বে বলে সতর্ক করেন অধ্যাপক আকতার হোসেন।
রাঙামাটির মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মাহবুবুল ইসলাম কাসাভা চাষিদের মাটির ক্ষয় রোধে আধুনিক চাষ পদ্ধতি ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন। তার ভাষ্যে, কাসাভা চাষিদের মাটির ক্ষয় রোধে আধুনিক চাষ পদ্ধতি যেমন- কনট্যুর লাইন, বেঞ্চ টেরেস, হিল স্লোপ অ্যাক্রস দ্য হিল স্লোপ, স্ল্যাশ ও মালচ উইথ অ্যাগ্রোফরেস্ট্রি পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে।"
পাভেল পার্থ বলেন, "এ চাষে স্থানীয় আদিবাসীদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে কোনো উপকার হয় না। এতে লাভ হয় কেবল মুনাফালোভী কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর। তাই কাসাভা চাষ যেন পার্বত্য চট্টগ্রামের স্পর্শকাতর বাস্তুসংস্থান ধ্বংস না করে সেদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়, বন বিভাগ ও পরিকল্পনা কমিশনকে খেয়াল রাখতে হবে। কাসাভা চাষের জন্য দেশে আরও অনেক উপযুক্ত জায়গা রয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।