যেভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল কলেজিয়েট স্কুলের ঐতিহাসিক ভবন
ভেঙে ফেলা হয়েছে ভবন। ক্লাসশেষে অন্য সহপাঠীদের সঙ্গে সেই ধ্বংসস্তূপের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ওরা তিন বন্ধু। নূর উল্লাহ, শফিক সাদিক আর তানভীর। কী মনে করে ওরা ধ্বংসস্তূপ থেকে তুলে নিয়েছে কয়েকটি আধলা। ওগুলো নাকি তারা নিয়ে যাবে বাসায়, সংরক্ষণ করবে গভীর যত্নে, হেরিটেজ হিসেবে। তাদের একজন বলল, 'এখন স্মৃতি তো এটাই থাকবে, আর কিছু তো রাখা যাবে না।'
তারা ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। বিদ্যালয় প্রাঙ্গণের ঐতিহাসিক ভবনটির ধ্বংসস্তূপ থেকে তারা স্মৃতি জমা করছিল। পুরান ঢাকার লয়াল স্ট্রিটে মোঘল স্থাপত্যরীতিতে তৈরি এ ভবনটি এখন কেবলই জঞ্জাল। সম্প্রতি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে এটি ভাঙার কাজ শুরু করেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। ঐতিহাসিক এ ভবনের স্মৃতি ধরে রাখতেই শিক্ষার্থীরা সংগ্রহ করছে ভাঙা ইট–আধুলি। ফেইসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে স্মৃতিরোমন্থন করছেন স্কুলের বর্তমান-প্রাক্তন অনেকেই।
ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল শুধু ঢাকা বা পূর্ববঙ্গ নয়, ব্রিটিশশাসিত অবিভক্ত বাংলার প্রথম সরকারি বিদ্যালয়। তবে এ ভবনটি নির্মিত হয়েছিল স্কুল প্রতিষ্ঠার অনেক আগে, পর্তুগীজদের বিশ্রামাগার হিসেবে। ব্রিটিশ আমলে এটি ছিল একটি ডাকবাংলো।
ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন কলেজিয়েট স্কুলের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে লিখেছেন: '১৮৩৫ সালে জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন লর্ড বেন্টিংকের কাছে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, প্রেসিডেন্সী বিভাগের প্রধান প্রধান শহরে, যেমন ঢাকা, পাটনা প্রভৃতিতে ইংরেজি সাহিত্য, বিজ্ঞান পড়াবার জন্যে স্কুল খোলা উচিত। গণ্যমান্যদের মধ্যে ঢাকার সহকারী সার্জন ডা. জেমস টেলর এবং আরো অনেকে উৎসাহের সঙ্গে এ প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়েছিলেন। ২৪ জুন ১৮৩৫ সালে ভারত সরকার কমিটির এই সুপারিশে সম্মতি প্রদান করেছিলেন। কমিটি ঢাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উৎসাহে এতই আগ্রহী হয়ে উঠেছিল যে ১৮৩৫ সালের জুন মাসে বেসরকারিভাবে ঢাকায় স্কুল স্থাপনের জন্য মি. রিজ ও পার্বতীচরণ সরকারকে প্রেরণ করেছিল ঢাকায়। স্কুলের জন্য ভাড়া নেওয়া হয়েছিল আন্টাঘর ময়দানের পাশে ইংরেজ কুঠিটি। এভাবে ১৫ জুলাই ১৮৩৫ সালে শুধু ঢাকায় নয়, সমগ্র বাংলার প্রথম সরকারি স্কুলটির উদ্বোধন করা হয়েছিল।'
স্কুলটি প্রথমে পরিচিত ছিল 'ইংলিশ সেমিনারী' নামে। পরবর্তীকালে নাম হয় 'কলেজিয়েট স্কুল'। ১৮৪১ সালে এর একটি কলেজ শাখা খোলা হয়েছিল। সেটিই বর্তমান ঢাকা কলেজ। স্কুলটি কলেজ থেকে আলাদা হলেও 'কলেজিয়েট স্কুল' নামই বহাল থাকে।
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই স্বমহিমায় উজ্জ্বল ছিল স্কুলটি। দেশবরেণ্য অসংখ্য কৃতি সন্তানের জন্মদায়িনী এটি। প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন ঢাকার জমিদার নবাব খাজা আব্দুল গণি। পদার্থ ও জীববিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু, পদার্থবিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা এ বিদ্যালয়ের পড়াশোনা করেছেন। এছাড়া বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত, শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরী, বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, নির্মাতা খান আতাউর রহমান, আলমগীর কবির, সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক ও শহীদুল জহিরের মতো দিকপাল বাঙালি এ বিদ্যালয়ে ছাত্র ছিলেন।
কল্লোল যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ও সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসুও বিদ্যালয়টির প্রাক্তন শিক্ষার্থী। বাল্যস্মৃতি নিয়ে লেখা তার গ্রন্থ 'আমার ছেলেবেলা'তে স্কুলটির প্রাণবন্ত বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। স্কুল চত্ত্বর ও ভবন, ক্লাসরুমে বসে গির্জা দর্শন, দিনের শেষ ক্লাসগুলোতে ছেলেমানুষি অস্থিরতা সবই উঠে এসেছে তার লেখায়।
বুদ্ধদেব লিখেছেন: 'স্কুলটি অনেক কালের নামজাদা – কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমল থেকেই মর্যাদাবান। দাঁড়িয়ে আছে ঢাকার প্রধান নাগরিক অঞ্চলে সগৌরবে, গোল মোটা রোমক-থামওলা উন্নতশির অট্টালিকা – পূর্বযুগে এটাই ছিল ঢাকা কলেজ। সামনে ভিক্টরিয়া পার্ক, আশে-পাশে অনেকগুলো বড়ো রাস্তার মোড়, এক মিনিট দূরে সুন্দর গড়নের হলুদ-রঙা একটি গির্জে, যার মস্ত গোল ঘড়িটার দিকে আমি সতৃষ্ণ চোখে তাকাই মাঝে মাঝে যখন শুক্কুরবারে ক্লাশের ঘণ্টা চারটে পেরিয়ে যায়, বিকেলের রোদে জ্বলজ্বল করে গির্জের চুড়ো, আর ঘড়ির কাঁটা যেন নড়ে না। নিচু পাঁচিলে ঘেরা মস্ত ছড়ানো চৌহদ্দির মধ্যে স্কুল, সুরকির পাড়-বসানো হরতন-আকৃতির ছোটো একটি বাগানও আছে – সেখানে ফোটে রং-বেরঙের বিলেতি ফুল। সিঁড়ি, মেঝে, বারান্দা সব তকতকে পরিষ্কার; ক্লাশ-ঘরগুলোতে আলো-হাওয়া প্রচুর খেলে, কিন্তু কম্পাউণ্ড পেরিয়ে গাড়ি-ঘোড়ার শব্দ লেশমাত্র পৌঁছয় না।'
বুদ্ধদেবের লেখায় পাওয়া যায় প্রাচীন এ ভবটির বিভিন্ন শ্রেণিকক্ষের বর্ণনা। তিনি লিখেছেন এ ভবনের সমৃদ্ধ লাইব্রেরি ও আলাদা ভূগোল কক্ষের কথা। 'স্কুলের লাইব্রেরিটিও নেহাৎ ফ্যালনা নয়, সেখানে থ্যাকারের উপন্যাস পড়তে পাওয়া যায়, মাষ্টারমশাইরা তা অনুমোদনও করেন।'
কলেজিয়েট স্কুলের ভেঙে ফেলা ভবনটি ছিল দ্বিতল। এ ভবনে নিয়মিত ক্লাস বন্ধ হয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে। ভবনের নিচ তলায় ছিল একটি মসজিদ। এছাড়াও লাইব্রেরি, সায়েন্স ক্লাব ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের জন্য কয়েকটি কক্ষ ব্যবহার করা হতো। ওপরের তলায় একটি কক্ষে বিতর্ক প্রতিযোগিতা, ক্লাস ক্যাপ্টেন নির্বাচনসহ বিভিন্ন ধরনের আয়োজন হতো।
ভবনটিকে জড়িয়ে ছিল নানা ঐতিহ্যের উপকরণ। প্রবেশমুখেই একটি ফলক ছিল শিক্ষার্থীদের জন্য আশ্চর্য গৌরবের বিষয়। তাতে লেখা ছিল: 'In memory of the very meritorious services of Babu Ratna Mani Gupta, a very successful teacher in Bengal. During his headmastership (1888-1896), Dacca Collegiate School stood first 8 years out of 9 in the entrance examination.'
কিন্তু, এ সবই স্মৃতি এখন। নাম ফলকটির কোনো চিহ্নও নেই কোথাও। বিভিন্ন সময়ে ফলাফলে কৃতিত্ব দেখানো মেধাবী শিক্ষার্থীদের তালিকা (অনার বোর্ড) ধুলো-ময়লা জর্জরিত হয়ে পড়ে রয়েছে একপাশে। ভবনটি ভেঙে ফেলায় বর্তমান শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে প্রাক্তন, ইতিহাসসচেতন নাগরিকদের অনেকেই জানিয়েছেন ক্ষোভ।
ভবন ভাঙার প্রস্তুতি শুরু হতেই মানববন্ধন করে নিজেদের প্রতিবাদ জানিয়েছিল ঢাকার ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা রক্ষায় দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসা সংগঠন আর্বান স্টাডি গ্রুপ। হেরিটেজ ভবন রক্ষায় ২০১৮ সালে হাইকোর্টের দেওয়া একটি রায় দেখিয়েও ভবনটি রক্ষা করতে পারেনি সংগঠনটি। এর সিইও তইমুর রহমান জানালেন তার ক্ষোভের কথা। 'ভবনটির স্ট্রাকচার দেখলে এটা যে মোঘল আমলের তা নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকে না। সে হিসেবে এটি কমপক্ষে ৩০০ বছরের পুরোনো স্থাপনা। হাইকোর্টের রায় দেখানোর পরেও স্কুল কর্তৃপক্ষ ভবন ভেঙে ফেলল।'
তার মতে, পুরাতন এ ভবনটি সংস্কার করে এটিকে গ্রন্থাগার, জাদুঘর কিংবা প্রদর্শনীর কাজে ব্যবহার করা যেত। বললেন, 'কলেজিয়েট স্কুল এখানে প্রতিষ্ঠিত না হলেও মানুষ কিন্তু ৭০–৮০ বছর ধরে কলেজিয়েট স্কুল বলতে এ ভবনকেই চেনে। ভবনটি না ভেঙে সংস্কার করা যেত।'
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ কলেজিয়েট স্কুলের ভবন ভেঙে ফেলার খবর জানিয়ে এক ফেসবুক পোস্টে লেখেন: 'আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, পৃথিবীর সকল উন্নত সভ্যতা সবসময়ই নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে যত্ন করেছে, সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সংরক্ষণ করেছে। কারণ ইতিহাস-ঐতিহ্য হচ্ছে শক্তিশালী, আত্মবিশ্বাসী, সংবেদনশীল জাতি গঠনের মূলভিত্তি।'
ভবন ভাঙার বিষয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষক আরিফুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, তারা কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েই ভবনটি ভাঙার উদ্যোগ নিয়েছেন। তার মতে, ভবনটি ছিল অনেক ঝুঁকিপূর্ণ, প্রায়ই শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা দুর্ঘটনায় পড়তেন।
একই মত ভবন ভাঙার কাজে নিয়োজিত শ্রমিক হাশমত আলীর। তিনি বলেন, 'উপরের ছাদ তো ফাইডা ফাইডা ছিল। হামার [হাতুড়ি] দিয়া বারি দিছে, সঙ্গে সঙ্গে দুইজন নিচে পইড়া গেছে। সবাই আমরা নাইমা পড়ছি। পরে শাবল দিয়া আস্তে আস্তে কাজ করছি।' নতুন করে সংস্কার করা যেত কি না এমন প্রশ্নে বললেন, 'রড নাই তো। পুরা ছাদ ভাইঙ্গা কাজ করতে হইতো। ডাবল টাকা খরচা হইতো। অনেক পাশে ওয়ালই [দেয়াল] নাই।'
তবে এ ভাঙার কাজ শুরু হলে বিভিন্ন মহল থেকে বাধা আসে। কাজ বন্ধ হয়। এরপর স্কুলটিতে গিয়ে প্রধান শিক্ষককে আর পাওয়া যায়নি। ভাঙাচোরা স্তূপের মধ্যে কাগজে প্রিন্ট করা একটি বিজ্ঞপ্তি চোখে পড়ে। তাতে লেখা: 'ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের টেলিফোনিক নির্দেশে পুরাতন ভবন ভাঙার কাজ সাময়িকভাবে বন্ধ থাকবে।'
সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে ভবনটি ছিল একটি আবেগের নাম। এটিকে ঘিরে জড়িয়ে থাকা নানা স্মৃতির কথা জানালেন তাদের কেউ কেউ। অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী শফিক সাদিকের কাছে এ ভবন অত্যধিক গর্বের জায়গা। 'আমি যখন ক্লাস থ্রিতে প্রথম ভর্তি হই, আমরা খেলার জন্য মাঝেমধ্যেই এ পুরাতন ভবনের দ্বিতীয় তলায় যেতাম। আমাদের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে এ ভবনে। আমরা ক্লাস করেছি, খেলেছি, ক্যাপ্টেন নির্বাচন হতো এখানে। ভবনটি সংস্কার করে টিকিয়ে রাখা গেলে সবচেয়ে ভালো হতো।'
তবে শত মনখারাপ হলেও আর হয়তো ফিরে পাওয়া যাবে না ভবনটি। তাই ভবনের ইট-পাথর সংগ্রহ করেই ক্ষান্ত থাকতে হচ্ছে সাদিকদের। 'আমি দুটি ইট সংগ্রহ করেছি। একটি আমার কাছে রাখব। অন্যটি আমাদের একটি ক্লাব আছে, ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল জীববৈচিত্র্য পরিভ্রমণ ক্লাব, সেখানে রাখব। আজ থেকে দশ–বিশ বছর পরে যখন দেখব, আমার মনে হবে যে বিল্ডিংয়ের একটা অংশ আমার কাছে আছে। ইতিহাসের একটা অংশ আমার কাছে থাকবে,' বলে সাদিক।
শফিক সাদিক ও তার বন্ধুদের মতো বর্তমান প্রজন্মের স্মৃতিতে কিংবা কয়েক টুকরো ইটের মধ্যেই হয়তো বেঁচে থাকবে এ ভবনটি। তবে ইতিহাসসচেতন মানুষেদের প্রত্যাশা, আর কোনো ঐতিহাসিক স্থাপনা যেন এভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত না হয়।