সবুজের দৃষ্টান্ত স্থাপন করল তিস্তা সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প
রংপুর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে দুর্গম তিস্তার পাড়ে গাইবান্ধার লাটশাল চর। বিস্তীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে এই চরে দেখা মিলল পাকা রাস্তা, বিদ্যুৎ, থিম পার্ক, আধুনিক আবাসিক ভবন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের।
অথচ ৫ বছর আগেও এ চরের গল্প ছিল ভিন্ন। বর্ষায় পানিতে ডুবে থাকা আর গ্রীষ্মে সাদা বালুর আস্তরণ ছিল চরটির সাধারণ চিত্র। গবাদিপশুর জন্য এ চরে মাঝেমধ্যে ঘাস পেতেন স্থানীয় কৃষকরা। ভালো রাস্তা ও বসবাসের উপযোগী পরিবেশ না থাকায় মানুষের আনাগোনা ছিল না এই জনপদে।
তবে দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী বেক্সিমকো গ্রুপের তিস্তা সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের সুবাদে বদলে গেছে এই দুর্গম এলাকার চিত্র।
শুধু যে এলাকার চিত্র বদলেছে, তা নয়। দেশের সর্ববৃহৎ সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে রিটার্নের ক্ষেত্রেও অবিশ্বাস্য সাফল্য পেয়েছে বেক্সিমকো গ্রুপ। ৩ হাজার কোটি টাকার এই সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প উৎপাদনে যাওয়ার প্রথম বছরেই ৬৩৪ কোটি টাকা আয় করেছে গ্রুপটি।
বেক্সিমকোর কর্মকর্তারা বলছেন, সুকুক বন্ডের মাধ্যমে তোলা বিনিয়োগের টাকা ৫ বছরেই উঠে আসবে এ সোলার পার্ক থেকে।
২০২৩ সালের আগস্টে এ সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। তবে এর আগে ওই বছরের জানুয়ারি থেকেই জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করে কেন্দ্রটি।
তিস্তা সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. তাশিকুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, চালু হওয়ার পর থেকেই সক্ষমতা অনুযায়ী ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে কেন্দ্রটি। সূর্যের বিকিরণ বেশি হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন আরও বেড়ে যায়। 'আমরা সর্বোচ্চ ২১২ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনও করেছি।'
এক বছর আগে চালু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রটি ৪২.৩১ কোটি ইউনিট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করেছে বলে জানান তিনি।
তাশিকুল ইসলাম বলেন, সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী তিস্তা, সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ধরা হয়েছে ১৫ সেন্ট। সেই হিসাবে কেন্দ্রটির মোট আয় হয়েছে ৬৩৪ কোটি টাকা। 'আমরা প্রত্যাশা করছি পাঁচ বছরের মধ্যে প্রকল্পের ব্যয় উঠে আসবে,' বলেন তিনি।
বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য অবকাঠামো
২০১৭ সালে উত্তরের তিনটি জেলাজুড়ে—রংপুর, গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রাম—থাকা ৬৫০ একর জমিতে সোলার পার্ক স্থাপনের কাজ শুরু করে বেক্মিকো।
নদীরক্ষা বাঁধ, রাস্তাঘাট নির্মাণ ও সংস্কার, ভূমি অধিগ্রহণ, সোলার প্যানেল স্থাপন, ট্রান্সফরমার ও জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করার সঞ্চালন লাইনসহ সম্পূর্ণ প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে গ্রুপটি।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রকল্প পরিচালক গৌতম দাস বলেন, প্রকল্পের জন্য ৮ কিলোমিটার নদীরক্ষা বাঁধ দিতে হয়েছে। প্রকল্প এলাকায় যাওয়ার জন্য প্রায় ২০ কিলোমিটার নতুন রাস্তা নির্মাণ করতে হয়েছে।
প্রকল্পের বর্ণনা দিয়ে গৌতম দাস বলেন, এ সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রায় ৫ লাখ ৫০ হাজার সৌর প্যানেল বসানো হয়েছে। এর জন্য ৮৫টি মাউন্টিং পাইলস স্থাপন করা হয়েছে।
তিনি জানান, এসব সৌর প্যানেল থেকে ১২০টি ইনভার্টারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। ইনভার্টার থেকে ২৮টি বক্স ট্রান্সফর্মার ও সাবস্টেশনসহ ১৩২ কেভি ট্রান্সমিশনের মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে বিদুৎ যুক্ত হচ্ছে।
পাশাপাশি আরও যেসব প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে
তাশিকুল জানান, বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি সোলার প্যানেলের নিচে নানা জাতের কৃষি ফলনের মাধ্যমে আরও অতিরিক্ত আয় করার পরিকল্পনা রয়েছে বেক্সিমকোর।
তিনি বলেন, 'আমরা পরিকল্পনা করছি সোলার প্যানেলের নিচের জমিতে বিভিন্ন ধরনের কৃষি ফসল উৎপাদনের। পরিবেশবান্ধব নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি ভুট্টা, আলু, তরমুজসহ স্বল্প উচ্চতার গুল্মজাতীয় রবিশস্য উৎপাদন করব। এখনই কিছু কিছু ফসল উৎপাদন শুরু হয়েছে।'
আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড রংপুরের প্রধান প্রকৌশলী মো. আশরাফ হোসেন বলেন, তিস্তা সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পাওয়া বিদ্যুৎ উত্তরাঞ্চলের রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, লালমনিরহাটসহ বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হচ্ছে। এর ফলে এসব অঞ্চলে লোডশেডিং কমেছে।
এ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা ও কৃষি খাতের উন্নয়নসহ প্রায় ১০ লাখ মানুষ সুবিধা পেয়েছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
সরিজমিন ঘুরে দেখা যায়, বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে থিম পার্ক। নদীরক্ষা বাঁধ ও পার্ককে কেন্দ্র করে পর্যটন ব্যবসা গড়ে উঠেছে। বেড়াতে আসছেন প্রচুর দর্শনার্থী। আশেপাশের মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্য ও কর্মতৎপরতা বেড়েছে। এ এলাকার আশেপাশের জমির দামও কয়েকগুণ বেড়েছে বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা।
বেক্সিমকো গ্রুপের সিইও আহমেদ শায়ান এফ রহমান বলেন, 'তিস্তা সৌর প্রকল্পটি টেকসই অগ্রগতির আলোকবর্তিকা হয় এসেছে। এ প্রকল্প সবুজ ভবিষ্যতের দিকে বাংলাদেশের যাত্রার পথকে আলোকিত করছে। নবায়নযোগ্য শক্তিকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে এ উদ্যোগ কেবল পরিবেশগত প্রচেষ্টাকেই জোরদার করছে না, বরং মানুষের ক্ষমতায়ন, জীবনযাত্রা মান বৃদ্ধির মাধ্যমে আগামী প্রজন্মের জন্য উজ্জ্বল ভবিষ্যত নিশ্চিত করার পাশাপাশি দায়িত্বশীল জ্বালানি উন্নয়নের জন্য বৈশ্বিক মানদণ্ড দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে।'