নাকবা দিবস: এআই, ইতিহাস ও স্মৃতি ঘেঁটে ধ্বংস হওয়া ফিলিস্তিনি জীবনের পুনর্নির্মাণ
ইসরাইল সৃষ্টি করা হলো ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে। সাড়ে সাত লাখের বেশি ফিলিস্তিনির শিকড় সমূলে উপড়ে ফেলা হলো তাদের নিজ ভূমি থেকে। হাজার হাজারকে করা হলো হত্যা। এই ছিল ইসরাইল বানানোর গোঁড়ার দিনগুলোর বেদনা ও রক্তমাখা ইতিকথা। ইসরাইল বানাতে যেয়ে ৫৩০ গ্রাম এবং শহরকে পুরোপুরি ধ্বংস করা হলো। এ ধ্বংসের লীলায় জড়িত ছিলো ইহুদিবাদী আধাসামরিক বাহিনী এবং ইসরাইলের সেনাবাহিনী। ৭৫ বছর পর আল জাজিরা ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি গ্রামের জীবন যাত্রার চালচিত্র তুলে ধরেছে। গ্রামটির নাম বায়ত নাবালা। এ গ্রামের সবই অতীত। পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে সব। সে সময়ের ধ্বংসলীলা থেকে রক্ষা পাওয়া কয়েকজন ফিলিস্তিনি এবং তাদের অধস্তন বংশধরদের স্মৃতি-কথকতা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পরিচালিত উপস্থাপনা এবং ইতিহাসের দলিল-দস্তাবেজ ঘেঁটে এ চালচিত্র নির্মাণ করা হয়েছে।
জলপাইয়ের শেষ মওসুম
১৯৪৭। অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি। মওসুমের বৃষ্টির প্রথম আশীর্বাদ ঝরে পড়ছে সেদিন ফিলিস্তিনি গ্রাম বায়াত নাবালার ওপর। রূপালি বাতাবরণ হয়ে নামছে পানির বিন্দুরা। প্রচণ্ড গ্রীষ্মের দাবদাহে ক্লান্ত, জমিগুলো আকাশ থেকে নেমে আসা অমিয়ধারা পান করছে। আর সাথেই তারা জীবনের আলোড়ন তুলেছিল। প্রস্তরময় ঢালে অবস্থিত নিজ নিজ পাথরের বাড়িতে বসবাসকারী গ্রামবাসীরা জানতেন যে পাহাড় জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রাচীন বাগানগুলোর পুরানো গাছসকল খতিয়ে দেখার সময় এসেছে এখন। তারা আরেকটি জলপাই মওসুমের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে।
বায়াত নাবালার বাসীরা নিজেদের জলপাই নিয়ে গর্ব করেন। স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় এ জলপাইয়ের রয়েছে রোগ-ব্যাধির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দেহকে সক্ষমতা যোগানোর ভেষজগুণ। পাথরের যাতায় পিষে জলপাই তেল তৈরি হয় বায়াত নাবালায়। উট এবং গাধার পিঠে করে সে তেল নিয়ে যাওয়া হয়। তেলের খোশবুতেই মিলে পরিচয়। জলপাই গাছের কোন জায়গা থেকে পাড়া হয়েছে তা এই খোশবু শুঁকেই বোঝা যায়। গাছের একবারে আগা থেকে নেওয়া জলপাই তেলের হালকা মিষ্টি সুবাসে মেতে উঠবে চারপাশের বাতাস।
গ্রামটির অধিবাসী দুই হাজার ছয়শ'র বেশি হবে। জলপাই মওসুম তাদের জন্য দুঃখজনক ঘটনার জন্ম দিয়েছিল। যে টিলার ওপর বায়াত নাবালা অবস্থিত তা মিশে গেছে উপত্যকায়। এখান দিয়েই উত্তরের দিকে চলে গেছে আশ-শামি, দক্ষিণের দিকে ওয়াদি সারার এবং কেরেইকাহ্। প্রতি নভেম্বরে এ সব উপত্যকা পানিতে তলিয়ে বনে যায় নদী।
আশ-শামি উপত্যকার খাড়া টিলার ধার ঘেঁষে থাকা গাছগুলো থেকে আপনমনে জলপাই তুলছিল কিশোরী কন্যা হেলমিয়া আস-সাঈদ। সে সময় পা ফসকে পানিতে পড়ে ডুবে যায়। সে সন্ধ্যায় তার মৃতদেহ ভেসে ওঠে পাশের প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরের গ্রাম দেইর তারিফে।
এ করুণ ঘটনার কথা তখনও কিশোরী কন্যার বন্ধু-বান্ধবরা জানতে পারেনি। কিন্তু পরে দশকের পর দশক ধরে এ দুঃখজনক মৃত্যু তাদের স্মৃতিতে শোকের দোলা হয়ে আছে। বায়াত নাবালার জীবন যাত্রার ক্ষেত্রে এটি অপূরণীয় ক্ষতির সঙ্কেত হয়েই বিরাজ করছে।
এ এমন এক গ্রাম যেখান সবাই সবাইকে চেনেন। লেবু জাতীয় ফল, শাক-সবজি এবং শিমের জন্য বিখ্যাত গ্রামটির আস্থাভাজন মুদ্রা হয়ে উঠেছে এ সব কৃষিপণ্য। এর ওপর ভিত্তি করেই ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সম্পর্কের বিকাশ।
ডাল উৎপন্নকারী চাষী প্রথমে নিজ পরিবারের প্রয়োজনের হিসাব-নিকাশ করবেন। তারপর বাড়তি শস্য দিয়ে প্রতিবেশীর সাথে মুরগী-বিনিময়ের বাণিজ্য করবেন। স্নেহময় কোনও বাবা হয়ত কয়েক বাক্স কমলার বদলে নিজের মেয়ের জন্য একটি সাইকেল নিয়ে বাড়িতে ফিরবেন। গ্রামের মাঝামাঝি স্থানে রয়েছে সেলুন। সেখানে ক্ষৌরকারকে তার কাজের দাম চুকিয়ে দেওয়া হয় গমের থলি দিয়ে। সবচেয়ে কাছের বড় চিকিৎসা কেন্দ্র রয়েছে লিদা শহরে। সেখানে যাওয়া মানে পাক্কা ৬ কিলোমিটার পাড়ি দেওয়ার ধকল। গ্রামবাসীরা অগত্যা ছোটখাট চিকিৎসার জন্য ক্ষৌরকারের শরণাপন্ন হন। পোকায় খাওয়া দাঁত তুলতে বা জোঁক চিকিৎসার জন্য ছুটে তার কাছেই।
পাথর ও মাটির তৈরি ঘর-বাড়িগুলো গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছে। পাশেই কাঁচা পথ। গ্রামবাসীরা কেউ কারো বাড়িতে বেড়াতে গেলে দাওয়ায় শতরঞ্চি এবং ফরাস পেতে দেন মেজবান। বাইরের খোলা উনুনে সেঁকা রুটি পরিবেশন করা হয়। দেয়ালে ঝুলছে তোষক বা জাজিম। রাতে তাই বিছিয়ে পরিবারের সদস্যরা সুখ-নিদ্রা দেয়।
টিলা বেয়ে গ্রামের অনেকেই সেখানে একটি শিবিরে কাজ করতে যান। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে এ সেনাশিবির বসায় ব্রিটিশ। ফিলিস্তিন এবং ট্রান্সজর্দান অঞ্চলে প্রশাসনের দায়িত্বে ছিল তারাই। প্রথম মহাযুদ্ধ শেষে জাতিপুঞ্জের আদেশপত্রের আওতায় এ দায়িত্ব নিয়েছে ব্রিটিশ। শিবিরটির বিশাল সাঁতারখানা বা সুইমিং পুল এবং খাওয়ার ঘর কেবল ব্রিটিশ সেনাদের জন্য নির্ধারিত। এ ছাড়াও এ সেনাশিবিরে কাঠ ও ধাতব কাজ করার কর্মশালা আছে। এ সব কর্মশালায় বায়াত নাবালার বাসিন্দারা নিজেদের নির্মাণকাজের বিদ্যাকে আরও চৌকস করে তোলেন। প্রতিবেশীদের সহায়তায় নিজদের বাড়িঘর বানানো বা মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় কাজ করে ঠিকঠাক করে নেন।
শিবিরটির পাশেই রয়েছে গ্রামের পুরানো কুপ। কুপটি মাটির ১০০ মিটার গভীরে চলে গেছে। মাটির পাত্র ভরে ঘরের জন্য পানি আনতে গ্রামবাসীদের ঢাল বেয়ে আধা কিলোমিটার হাঁটতে হয়।
শিবিরটির ঠিক উল্টো দিকে লিদাগামী সড়কের পাশেই রয়েছে গ্রামটির বিদ্যালয় ভবন। ১৯২১'এ প্রতিষ্ঠিত চার কক্ষের এ বিদ্যালয়ে প্রথম চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। হালকা হলুদাভ কিংবা ঘিয়া রঙ ঘেষা পাথর দিয়ে বিদ্যালয় ঘরটি তৈরি করা হয়েছে। বিদ্যালয়ের একটি পাঠাগার আছে। সূর্যের উত্তাপ থেকে রক্ষা করছে সবুজ গাছের ছায়া। আট শিক্ষকের আওতায় লেখাপড়া করে প্রায় ২৩০ জন ছাত্র। মাঝে মাঝে জনা কয়েক মেয়েও এসে ছেলেদের সাথেই বসে একই ক্লাসে।
এ বিদ্যালয়েরে কল্যাণে প্রায় সাতশ' ফিলিস্তিনি লেখাপড়া শিখতে পেরেছেন। তাদের অনেকেই খবরের কাগজ কেনার জন্য ইয়াফা (এখনকার জাফা) যেতেন। কিন্তু বায়াত নাবালাবাসীরা তাদের বেশির ভাগ খবরই পেতেন সেখানকার একমাত্র রেডিও'র মাধ্যমে। রেডিওটি থাকত গ্রামের 'মোখতার' (প্রধান) হাজি মোহাম্মদ হোসাইনের বাড়িতে। ব্রিটিশ পরিচালিত ইস্ট ব্রডকাস্টিং স্টেশন থেকে প্রচারিত আরবি ভাষার অনুষ্ঠানই কেবল রেডিওতে শোনা যেত।
১৯৪৭'এর শেষ দিকে রেডিও থেকে প্রচারিত খবরে অশনি সংকেত পাওয়া শুরু হলো। নভেম্বরের ২৯ তারিখে জাতিসংঘ (ইউএন) ফিলিস্তিনকে বিভক্ত করার নীল নকশা গ্রহণ করে। ফিলিস্তেনের ৫৫ শতাংশ ভূমিকে হলোকাস্ট বা ইউরোপে হিটলারের ইহুদি নিধন যঞ্চের দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে ইহুদিদের জাতীয় আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার জন্য বরাদ্দ করা হয়। আরব নিয়ন্ত্রিত ফিলিস্তিনি অংশেই পড়েছে বায়াত নাবালা। ফিলিস্তিনি বিভক্তকরণের প্রতিবাদ তারা জানিয়েছে কিন্তু একটি বিষয় তাদের কাছ পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, শত শত মাইল দূর থেকে যে কূটনৈতিক আদেশ জারি করা হয়েছে তার ওপর তাদের ভাগ্য নির্ভর করছে না। বরং তাদের চোখের সামনে যে সব ঘটনা ঘটছে তাই শেষ পর্যন্ত তাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করবে। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দ জুড়ে ইহুদিবাদী আধাসামরিক গোষ্ঠী হাগানা খ্যাতনামা ফিলিস্তিনি ভূমি মালিকদের বসতভিটা কীভাবে ডিনামাইট দিয়ে গুড়িয়ে দিয়েছে, সে কাহিনী গ্রামের মানুষগুলো আগেই শুনেছেন। খবর ক্রমেই আরও খারাপের দিকেই যাবে।
১৩ ডিসেম্বর গ্রামবাসীদের কাছে খবর এলো যে, হাগানার অন্যতম শাখা ইরগুন অতর্কিতে হামলা করেছে বায়ত নাবালার পশ্চিম সীমান্তের গ্রাম আল-আব্বাসিয়ায়। পরের দিন পুলিশ এবং ট্রান্সজর্দান আমিরাতের সেনা নিয়ে গঠিত আরব বাহিনীর সেনা বহরের ওপর হামলায় প্রাণ হারাল ১৩ সৈন্য। এই গ্রাম থেকে সাত কিলোমিটার দূরের ইহুদি বসতি বেন শেম্যান ছেড়ে যাওয়ার সময় এ হামলা হয়।
এরপরই ধারাবাহিক হামলার দিনরাত শুরু হলো। বায়াত নাবালার কাছাকাছি ব্রিটিশ শিবিরে কাজ করার সময় এক গ্রামবাসী নিহত হলেন। জবাবে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধারা আক্রমণ চালালেন। ব্রিটিশ সেনাবাহী রেলগাড়িতে হামলা চালাল ইহুদিবাদী আধাসামরিক গোষ্ঠী। হামলা এবং পাল্টা হামলার এ সব রক্তক্ষয়ী খবরাখবর বায়াত নাবালাবাসীদের রেডিও থেকে শোনার দরকার ছিল না। হত্যা ও হামলার এ সব ঘটনা ঘটছে প্রায় তাদের দোর গোঁড়ায়ই।
কোনো কোনো গ্রামবাসী ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধাদের কাতারে যোগ দিলেন। সামান্য যা সঞ্চয় ছিল এবং স্ত্রী-কন্যাদের অল্প কিছু জড়োয়া ছিল তাই বিক্রি করে অস্ত্রের যোগানের ব্যবস্থা হলো। গাজা ও মিসর থেকে আগ্নেয়াস্ত্র কিনে আনা হলো। প্রতিটি অস্ত্রের দাম পড়ল গড়ে প্রায় ১০০ ফিলিস্তিনি পাউন্ড। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ব্রিটিশ বাহিনী কিছু অস্ত্র-গোলাবারুদ ফেলে গেছে। বায়াত নাবালার মানুষজন তা জড়ো করলেন।
ইহুদিবাদী আধাসামরিক গোষ্ঠীর অস্ত্রশক্তির মুখে এসব একেবারেই তুচ্ছ হয়ে দাঁড়াল। এছাড়া, ইহুদিবাদীদের বহু সদস্যকে ব্রিটিশরা সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়েছে। আর অনেকেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। অন্যদিকে, বায়াত নাবালাবাসীদের কারও কারও যুদ্ধ অভিজ্ঞতা আছে। ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের বিরুদ্ধে ১৯৩৬-৩৯'এর আরব বিদ্রোহের নেতা হাসান সালামেহ্'র সাথে একযোগে লড়েছেন। তারা রেললাইন উড়িয়ে, বিদ্যুতে খাম্বা উপড়ে ব্রিটিশ বাহিনী ও ইহুদিদের যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপর্যয় ঘটালেন।
আশেপাশের ফিলিস্তিনি গ্রামগুলোকে হামলার হাত থেকে রক্ষার জন্য বায়াত নাবালাবাসীদের অনেকেই এগিয়ে গেলেন। তাদের নগণ্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়েই এ দুঃসাহসিক অভিযানে গেলেন তারা।
তবে বেশির ভাগ যুদ্ধেই তাদের ভাগ্যে নেমে আসল পরাজয়ের দুর্যোগ। এপ্রিলের ৮ তারিখে এতকালের আস্থাভাজন রেডিও ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা বায়াত নাবালাবাসীরা হৃদয়বিদারক খবর শুনতে পেলেন। খবরে বলা হলো, হাগানা হামলায় নিহত হয়েছেন ফিলিস্তিনি জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের অন্যতম নেতা এবং সালামেহ্ সহযোদ্ধা আবদ-আল-কাদের আল-হোসাইনি। এ খবরে নারীরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। রাগে-দুঃখে-শোকে দিশাহারা এক গ্রামবাসী মোখতারের বাড়ির রেডিওটিকে সটান আছাড় দিলেন।
পরদিনই বায়াত নাবালা থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরের গ্রাম দেইর ইয়াসিনে হামলা হলো। হামলায় অংশ নিলো ইরগুন এবং অন্য আরেক ইহুদি আধাসামরিক গোষ্ঠী লেহির ১৩০ সদস্য। গ্রামটির ছয়শ' অধিবাসীর মধ্যে শতাধিক নিহত হলেন। নিহতের সঠিক সংখ্যা নিয়ে আজও ইতিহাসবিদদের তর্ক-বিতর্ক চলছে।
ইহুদিবাদী আধাসামরিক গোষ্ঠীর দখলীকৃত অন্যান্য ফিলিস্তিনি গ্রাম থেকে পূর্বমুখো শরণার্থীদের ঢল নামল। এ ঢল চলল বায়ত নাবালা গ্রামের মধ্য দিয়েই। শরণার্থীদের মুখ থেকে শোনা গেল ইহুদিবাদীদের পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের কাহিনী। হামলাকারীরা কীভাবে নির্বিচারে ফিলিস্তিনি কন্যা বা নারীদের ওপর চড়াও হয়েছে। তাদের সম্ভ্রমহানি করেছে। গর্ভবতী ফিলিস্তিনি মায়ের পেট চিড়ে দিয়েছে। ইহুদিবাদীদের খুন-উল্লাস থেকে রেহাই পায়নি দুগ্ধপোষ্য বা খুদে খুদে শিশুরাও। শরণার্থী পরিবারগুলোর অনেকেই বায়াত নাবালায় বেশি দিন কাটালেন না। শরণার্থীরা আবার পূর্বমুখো যাওয়ার জন্য হাঁটতে শুরু করলেন। রামাল্লায় যাওয়ার পথে নিরাপদ গ্রাম বা শহর পাওয়া যাবে বলে আশার স্বপ্নজাল বুনছিলেন এ সব ছিন্নমূল শরণার্থী। রামাল্লাকে তখন আরব বাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটি হিসেবে গণ্য হতো।
গ্রামটির শিশুরাই কেবল তুলনামূলকভাবে চারপাশে চলমান হাঙ্গামার কোপানল থেকে রক্ষা পেল। স্কুল শেষ করে রাস্তায় ছুটত খেলার জন্য। লুকোচুরি খেলার পাশাপাশি তাদের প্রিয় আরেক খেলার নাম চুরা। কোমল পানীয়র খালি ক্যান বা ঘিয়ের টিনকে গাছের ডাল দিয়ে ক্রমান্বয়ে আঘাত করাই ছিল এ খেলার আনন্দ। আঘাতে আঘাতে ক্যান বা টিন বেচারা দুমড়িয়ে-চুমড়িয়ে ভর্তা না হওয়া পর্যন্ত খেলা থামত না। আবার কোনো কোনো দিন মা-বাবা বা অভিভাবকরা বাসায় মিষ্টি নিয়ে ফিরতেন।
একদিন বিকাল ৫টার সময় একদল ছেলে স্কুলের কাছে যথারীতি খেলছিল। স্কুল ভবনটি গ্রাম থেকে শ দুয়েক মিটার দূরে অবস্থিত। হঠাৎ করে তারা একদল অচেনা লোককে দেখতে পেল। তাদের মাথায় বাঁধা রয়েছে কিফিয়েহ্স। মধ্যপ্রাচ্যের জনপ্রিয় ঐতিহ্যবাহী মস্তকাবরণ। তবে জর্দানের সেনারা সাধারণ ভাবে এটি সে সময় ব্যবহার করত।
আগন্তকের দল কওয়া-নাই- বলা নাই হঠাৎ করে ফাঁকা গুলি ছুঁড়তে শুরু করলে ছেলের খেলা ছেড়ে দৌড়ে গ্রামে ফিরল। ছেলেদের অনেকেই এর আগে গল্প শুনেছে ইহুদিবাদী আধাসামরিক গোষ্ঠীর সদস্যরা অনেক সময়ই আরব বাহিনীর সেনাদের ছদ্মবেশ নিয়ে হামলা চালায়। এরা ভালো করেই জানত যে, ছেলেরা তাদের মা-বাবাদেরকে এই গুলি ছোঁড়ার কথা জানাবে। তাদেরকে সতর্ক করবে। স্কুলের ভেতর কয়েকজন ছাত্রের ক্লাস নিচ্ছিলেন এক শিক্ষক। গোলাগুলির শব্দ শুনে শিক্ষক তার ছাত্রদেরকে দ্রুত ডেক্সের নিচে ঢুকে আত্মরক্ষা করতে বললেন।
গ্রামটির সবাই তড়িঘড়ি করে বাড়ি ফিরে এলেন। সন্ধ্যা সাতটার দিকে নিচু দিয়ে উড়ে যাওয়া উড়োজাহাজের শব্দের পরপরই আশেপাশের উপত্যকাগুলোতে বোমা ফেলার গগদ বিদারী শব্দ শোনা যেতে লাগল। একই সাথে চুরমার হয়ে গেল গ্রামবাসীদের শান্তির সব স্বপ্নজাল ও প্রত্যাশা।
নাকবা এলো বায়ত নাবালায়
সাড়ে সাত থেকে ১০ লাখ ফিস্তিনিদের মতো বায়ত নাবালা গ্রামের শান্তিপ্রিয় বাসিন্দাদের তাদের জন্মভূমি থেকে চিরতরে উৎখাত করা হলো। তাদেরকে নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে পথে নামতে বাধ্য করা হলো। ইহুদিবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এবং ইসরাইলি সেনাবাহিনীর দখল করে নিজ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিল ফিলিস্তিনের ব্যাপক ভূখণ্ড। হিসেবে কষে, নীল নকশা এঁটে ইসরাইল ৫৩০টির বেশি ফিলিস্তিনি গ্রামকে ধ্বংস করে দিল। এমনভাবে এসব ধ্বংস তৎপরতা চালানো হলো যেন গ্রামগুলো আদি ও প্রকৃত বাসিন্দা ফিলিস্তিনিরা জন্মেও নিজ ভূমিতে ফিরে আসতে না পারে।
মে মাসে বায়াত নাবালার মানুষদেরকে গ্রাম খালি করার নির্দেশ দিল আরব বাহিনী। ইহুদিবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে টিলার ওপর ঘাঁটি গড়তে চাইছে আরব বাহিনী। তাই গ্রাম খালি করতে হবে। বেশির ভাগ গ্রামবাসী যে যার মতো চলে গেল। প্রতিবেশীদের সাথে যোগাযোগ নষ্ট হয়ে গেল। বৃহত্তর পরিবারের সদস্যরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল।
তারপরও কেউ কেউ বুকে সাহস বেঁধে রয়ে গেলেন। কিন্তু জুলাই মাসের ১০ তারিখে লিদা গ্রামের মানুষজন স্রোতের মতো আসতে থাকল। আগের দিন ইহুদিবাদী লুটপাট বাহিনীর সদস্যরা লিদার ওপর কামানের গোলা দাগতে শুরু করে। লিদা শহরের মানুষজন যেন ভেগে যেতে বাধ্য হয় সে জন্য এ কাজ করে। এ বাহিনীর সদস্যরা ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে যৌথ ভাবে ইসরাইলি ডিফেন্স ফোর্সেস বা আইডিএফ গঠন করে। তবে গোলাবর্ষণের চাপের মুখে ফেলেও শহরবাসীদের শহরছাড়া করতে ব্যর্থ হলো। এবারে ভিন্ন তরিকার আশ্রয় নিল। ইসরাইলি জিপগুলোতে শহরে ঢুকে নির্বিচারে রাইফেল ও মেশিনগান দিয়ে গুলি ছুঁড়তে লাগল। ঘরবাড়িতে গ্রেনেড ছুঁড়ে দিতে থাকল। ইসরাইলি সেনারা একটি মসজিদে হাজার হাজার নিরস্ত্র মানুষকে আটক করল। তারপর সেখানে ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ে দিল। ৪২০ জনের বেশি এভাবে প্রাণ হারালেন। মসজিদের দেওয়াল জুড়ে নারী-পুরুষ-শিশুদের দেহাবশেষ ছড়িয়ে পড়ল।
এমন হামলার পরও যারা বেঁচে গেলেন তাদের নির্বাসনে পাঠান হলো। তার আগে ইসরাইলি সেনারা ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে ঘড়ি, সোনা-দানা, এবং টাকার ব্যাগসহ সব দামি জিনিস কেড়ে নিল। পবিত্র রমজান মাসে এ ঘটনা ঘটে। রোজা রেখেছিলেন বেশির ভাগ ফিলিস্তিনি। ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের প্রচণ্ড গরমের মধ্যে চলতে যেয়ে অনেকেই ক্লান্তিতে পথের মধ্যেই পড়ে গেলেন। বেশির ভাগ বয়সী এবং শিশুরা এমন অমানবিক ধকল সহ্য করতে পারেননি। মারা গেলেন তারা। তাদেরকে তড়িঘড়ি ভুট্টাক্ষেতে কবর দেওয়া হলো।
নাকাবার সবচেয়ে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ ঘটেছে লিদায়। এ ঘটনা বায়ত নাবালার শেষ গ্রামবাসীদের কাছে সতর্ক বার্তা হয়ে দেখা দিল। তারা বুঝতে পারলেন এবারে গ্রাম ছাড়তে হবে। অল্প সময়ের জন্য হলেও গ্রাম ছাড়তেই হবে।
তারপর ৭৫টি বছর চলে গেছে। আজও যারা বেঁচে আছেন তারা গ্রামটিতে ফিরে যাওয়ার আশায় দিন গুণছেন।
পথ দীর্ঘ
আজকের দিনে বায়াত নাবালা গ্রামকে খুঁজে বের করার কোনো উপায় নেই। একমাত্র এ গ্রামের সাথে এককালে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল তারা ছাড়া আর কেউ গ্রামটি কোথায় ছিল চিনতেই পারবেন না।
নাকাবার সময় গ্রামবাসীরা প্রাণ নিয়ে পূর্বমুখো পালাতে ব্যস্ত। তখনই গ্রামবাসীদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করে দেওয়ার নীল-নকশা চলছে। ১৯৪৮'এর ১৩ সেপ্টেম্বর ইসরাইলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুরিয়ান তাদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি বিষয়ক মন্ত্রী পর্যায়ের কমিটির কাছে বায়াত নাবালা গ্রাম ধ্বংস করে দেওয়ার আনুষ্ঠানিক আবেদন জানান। এই সংস্থাটি পদ্ধতিগত ভাবে ফিলিস্তিনি ভূমি দখল করে তা ইসরাইলিদের বাসোপযোগী করার কাজে লিপ্ত। একই মাসের শেষদিকে গ্রামটির প্রায় সব ঘরবাড়িকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হলো।
গ্রামটির সর্ব পশ্চিম থেকে ১১৬ দুনামস (২৯ একর) ভূমিসহ অন্যান্য নয় গ্রাম থেকে সর্বমোট ২৩, ৫৪৬ দুনামস ভূমি ক্রোক করল ইসরাইল। আর বিস্তার ঘটানো হলো লিদা বিমান বন্দরের।
১৯৪৮'এর আগে এটি ছিল একটি সাদামাটা বিমানক্ষেত্র। এতে মাত্র চারটি এয়ারস্টিপ বা ধাবনপথ ছিল। শান্ত শহর লিদার কাছেই ছিল এ বিমানক্ষেত্রের অবস্থান। ১৯৩৪ সালে ব্রিটিশরা তৈরি করেছিল এটি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালে প্রধানত সামরিক অভিযানের কাজে লাগত এটি। বায়াত নাবালা সরাসরি এ বিমানক্ষেত্রের কাছাকাছি ছিল। গ্রামটি বিমানক্ষেত্রে থেকে ৬০ গুণ বড়। পাশের জিনদাস সমভূমি থেকে গ্রামের কমবয়সী ছেলে-মেয়েরা উড়োজাহাজের ওঠানামা দেখতে পেতো।
১৯৭৩'এ এর নাম বদলে বেন গুরিয়ান রাখা হয়েছে। সাবেক বিমানক্ষেত্রে থেকে এ বিমানবন্দর এখন ১০০ গুণ বড়। ফিলিস্তিনি শিশুরা এখানে বিমানের ওঠানামা দেখে আর বিস্মিত হতে পারে না। বরং এটি মনে করিয়ে দেয় আজকের দিনে ফিলিস্তিনিরা বিশ্বের সবচেয়ে কঠোর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার শিকার হচ্ছেন।
২০২২ খ্রিষ্টাব্দে এ বিমানবন্দর দিয়ে এক কোটি ৯২ লাখ ভ্রমণকারী যাতায়াত করেন। গোটা ইসরাইলে ঢোকার প্রধান স্থান হলো এই বিমান বন্দর। কিন্তু হতভাগ্য ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠী। স্থানীয় জেলা সমন্বয় দপ্তরের বিশেষ অনুমতি ছাড়া বেন-গুরিয়ান বিমান বন্দর থেকে উড়তে পারে না কোনও ফিলিস্তিনি। পশ্চিম তীর এবং গাজায় ফিলিস্তিনিদের প্রতি পদক্ষেপের ওপর নজরদারী করছে ইসরাইলের জেলা সমন্বয় দপ্তর। ফিলিস্তিনিদের জন্য এই অনুমতি পত্র যোগাড় করাকে কার্যত অসম্ভব করে রেখেছে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ। বিকল্প হিসেবে ফিলিস্তিনিদেরকে স্থলপথে জর্দানে যেত হয় সেখান থেকে আম্মানের বিমান বন্দর ব্যবহার করেন তারা।
১৯৬৭'এর আরব – ইসরাইল যুদ্ধের আগে ফিলিস্তিনিরা জেরুজালেমের কালানদিয়া বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়ন করতে পারতেন। ফিলিস্তিনি সীমান্তের ওপর পুরো নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের পর থেকে এবারে তাদের নিজস্ব আর কোনও বিমানবন্দর নেই!
এদিকে, বেন-গুরিয়ানের পূর্ব দিকে আরেকটি গ্রামের বড়সড় অংশকে বন-উদ্যানে পরিণত করা হয়েছে। পূর্বাঞ্চলের শহরের নামে এর নাম রাখা হয়েছে শোহাম বন-উদ্যান।
ইসরাইলি পরিবাররা সপ্তাহের ছুটি দিনে এ বন-উদ্যোনে যায়। তাদের সন্তানরা ফাঁকা জায়গায় বলা খেলে বা ছোটাছুটি করে। এ বন-উদ্যান পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে জিউইশ ন্যাশনাল ফান্ড বা জেএনএফ। ফিলিস্তিনি ভূমি থেকে ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোকে বলপ্রয়োগ উৎখাত করে সেখানে ইসরাইলি বসতি গড়ার ইতিহাসের সাথে এ সংস্থা জড়িত। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের পর ৩৭২টি ফিলিস্তিনি গ্রামকে দখল করে ৪৬টি উদ্যান বা পার্ক বানানো হয়েছে। সে সব পার্কের অন্যতম হলো শোহাম।
বায়াত নাবালার অধিকাংশ ফলবাগান ধ্বংস করে দেওয়া হয় নাকাবার সময়। তবে গ্রামটির অবশিষ্ট ফলবাগানকে কেন্দ্র করে জেএনএফ গড়ে তোলে নতুন জলপাই এবং বাদামের বাগান। এ বাগান আসলে যে এককালে ফিলিস্তিনিরা বানিয়েছেন সে কথা কোথাও উল্লেখ করেনি জেএনএফ।
আল জাজিরা থেকে সৈয়দ মূসা রেজা