সিলেটে হোল্ডিং ট্যাক্স একলাফে ৫০০ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি, নগরজুড়ে ক্ষোভ
সিলেট নগরে এক লাফে হোল্ডিং ট্যাক্স ৫ থেকে ৫০০ গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে সিটি করপোরেশন। এতে নগরজুড়ে ক্ষোভ বিরাজ করছে। নতুন নির্ধারিত হোল্ডিং ট্যাক্সকে অযৌক্তিক ও অনায্য দাবি করে তা বাতিলের দাবি জানিয়েছেন নগরের বাসিন্দারা।
এ দাবিতে প্রতিদিনই নগরে বিভিন্ন প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করছে বিভিন্ন সংগঠন।
জানা যায়, বার্ষিক কর পুনর্মূল্যায়নের পর গত ৩০ এপ্রিল হোল্ডিং ট্যাক্সের নতুন তালিকা প্রকাশ করে সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)। নতুন তালিকায় আবাসিক ভবনের জন্য প্রতি বর্গফুট ৫ টাকা ও বাণিজ্যিক ভবনের প্রতি বর্গফুটের জন্য ৮ টাকা হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণ করা হয়েছে।
আগে আবাসিক ভবনের প্রতি বর্গফুট ৩ টাকা ও বাণিজ্যিক ভবনের প্রতি বর্গফুটের জন্য ৫ টাকা ট্যাক্স নির্ধারিত ছিল।
সিটি করপোরেশনের রাজস্ব শাখা সূত্রে জানা যায়, ২০১৯-২০ সালে মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধান শেষে হোল্ডিং সংখ্যা পুননির্ধারিত হয়। এতে নগরের পুরোনো ২৭টি ওয়ার্ডে হোল্ডিং নির্ধারিত হয় ৭৫ হাজার ৪৩০টি। এসবের ট্যাক্স আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ১১৩ কোটি ২৭ লাখ ৭ হাজার ৪০০ টাকা। নতুন হোল্ডিং ট্যাক্স ধার্যের সময় ধরা হয় ২০২১-২২ সাল।
সেই করারোপের তালিকাই ৩০ এপ্রিল প্রকাশ করা হয়েছে। তবে সিটি করপোরেশনে নতুনভাবে যুক্ত হওয়া ১৫টি ওয়ার্ডের হোল্ডিং ওই তালিকায় আসেনি।
তবে সিটি করপোরেশনের এই মূল্যায়নকে ত্রটিপূর্ণ ও অযৌক্তিক বলে দাবি করছেন নগরের বাসিন্দারা।
সিলেট নগরের সুবিদবাজার এলাকায় রাসেল আহমদের বাসা। আগে তাকে বছরে হোল্ডিং ট্যাক্স দিতে হতো ৮০০ টাকা। তবে পুনর্মূল্যায়নের পর তার হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারিত হয়েছে ১ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। অর্থাৎ, তার হোল্ডিং ট্যাক্স বেড়েছে ২০০ গুণেরও বেশি।
এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে রাসেল আহমদ বলেন, "গত ৮/১০ বছরে আমার বাসার কোনো পরিবর্তন হয়নি। একই রকম আছে। তবু ট্যাক্স ২০০ গুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা একেবারেই অযৌক্তিক।"
হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণে সিটি করপোরেশনের মূল্যায়নকে ত্রুটিপূর্ণ দাবি করে তিনি বলেন, "মাঠ পর্যায়ে অ্যাসেসমেন্ট করে ট্যাক্স পুনঃনির্ধারণের কথা বলা হলেও আদোতে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায়ে যাননি। অফিসে বসেই ইচ্ছেমাফিক তারা কর নির্ধারণ করে দিয়েছেন।"
কেবল রাসেল আহমদ নন, এমন অভিযোগ নগরের প্রায় সব ভবন মালিকদেরই। পুনঃনির্ধারিত হোল্ডিং ট্যাক্স সম্পর্কে অবহিত ও আপত্তিগ্রহণ করতে নগর ভবনের সামনে আলাদা বুথ স্থাপন করেছে সিসিক। প্রায় প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষ এই বুথে ভিড় করেছেন। তারা সকলেই নতুন নির্ধারিত হোল্ডিং ট্যাক্স নিয়ে আপত্তি জানাচ্ছেন।
নগরের ২৬ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল হক হোল্ডিং ট্যাক্স বৃদ্ধির হারে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, "নগরের প্রায় পৌনে এক লাখ ভবনমালিকের হোল্ডিং ট্যাক্স ৫ থেকে ৫০০ গুণ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এটা নগরবাসীর ওপর এক ধরনের জুলুম। একলাফে এতোটা কর বাড়তে পারে না। এই অনায্য কর বাতিলের দাবি জানাই।"
হোল্ডিং ট্যাক্সের এই নতুন হার বাতিলের দাবিতে ৩০ এপ্রিলের পর থেকে প্রতিদিনই নগরে বিক্ষোভ প্রতিবাদ করছে বিভিন্ন সংগঠন। সিটি মেয়রের কাছে স্মারকলিপি দিয়েও এই দাবি জানানো হচ্ছে। সিলেট চেম্বার, মেট্রোপলিটন চেম্বার, সিলেট রিয়েল এস্টেট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে পৃথক বিবৃতি দিয়েও হোল্ডিং বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত স্থগিত করে নতুন করে পুনর্মূল্যায়নের দাবি জানানো হয়েছে।
নাগরিকদের আহ্বানে প্রতিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে রোববার বিকেলে এ ইস্যুতে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করেন সিটি মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী।
এ সময় মেয়র আনোয়ারুজ্জামান বলেন, আগামী সপ্তাহ থেকে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে পর্যায়ক্রমে আলোচনা সভা করে ট্যাক্স নির্ধারণ নিয়ে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।
"এ ব্যাপারে ২৭টি ওয়ার্ডে রিভিউ বোর্ড গঠন করা হবে। পূর্ব নির্ধারিত সময় বর্ধিত করে ২৮ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। আবেদন রিভিউয়ের মাধ্যমে হোল্ডিং ট্যাক্স সহনীয় পর্যায়ে নির্ধারণ করা হবে। এছাড়া, নতুন ১৫টি ওয়ার্ডের অ্যাসেসমেন্ট স্থগিতের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে," বলেন মেয়র।
এদিকে, বর্ধিত হোল্ডিং ট্যাক্স বাতিলের দাবিতে 'নাগরিক সমাজ'-এর ব্যানারে নগরে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। সোমবার এই ব্যানারে মেয়রের কাছে স্মারকলিপিও দেওয়া হয়।
সংবাদ সম্মেলনে মেয়রের আশ্বাস প্রসঙ্গে 'নাগরিক সমাজ'-এর অন্যতম সমন্বয়ক প্রণব জ্যোতি পাল বলেন, সিটি করপোরেশনের নতুন অ্যাসেসমেন্টের ওপর ভিত্তি করে নগরবাসীর ওপর অমানবিকভাবে ৫০০ গুণ হোল্ডিং ট্যাক্স আরোপ করা হয়েছে, যা অযৌক্তিক, গণবিরোধী।
"আমরা কর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত স্থগিতের দাবি জানাচ্ছি। কিন্তু মেয়র তা স্থগিত না করে রিভিউয়ের সময়সীমা কেবল বাড়িয়েছেন। মেয়রের এমন সিদ্ধান্তের সাথে আমরা একমত নই। কর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত স্থগিত না করলে আমরা আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে যাবো," যোগ করেন তিনি।
অস্বাভাবিক হারে হোল্ডিং ট্যাক্স বৃদ্ধির প্রতিবাদে রোববার দুপুরে মানববন্ধন করে মহানগর বিএনপি।
এতে মহানগর বিএনপির সভাপতি নাসিম হোসাইন বলেন, "সিলেট নগরীতে হোল্ডিং ট্যাক্স ৫ থেকে এক লাফে ৫০০ গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যা নগরবাসীর জন্য মরার উপর খাঁড়ার ঘাঁ এর মতো। আমরা বিএনপি হোল্ডিং ট্যাক্সের বিপক্ষে নই। তবে তা হতে হবে সহনীয় পর্যায়ে।"
এদিকে, নগর কর্তৃপক্ষ বলছে, নতুন হোল্ডিং ট্যাক্স সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর মেয়াদকালেই নির্ধারণ করা হয়। বর্তমান পরিষদ তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। এনিয়ে আলোচনা-সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার বিকেলে সংবাদ সম্মেলনে আসেন আরিফুল হক।
বর্ধিত হোল্ডিং ট্যাক্সের বিষয়ে তার উপর আনিত অভিযোগ প্রসঙ্গে আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, "সিটি করপোরেশনে আমার মেয়াদে নতুন করে হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তবে করোনা পরিস্থিতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি বিবেচনা করে সেটা আর বাস্তবায়ন করা হয়নি। আমি সেটি স্থগিত করেছিলাম।"
সাবেক মেয়র বলেন, "হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়ানোর আগে সেবাগ্রহীতাদের সাথে আলাপ করা উচিত ছিল। সেক্ষেত্রে গণশুনানি করে হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যথার্থ হতো। তাই বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় বর্ধিত হোল্ডিং ট্যাক্স আদায় স্থগিত করা উচিত।"
এসব বিষয়ে সিটি করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মতিউর রহমান খান বলেন, "নতুন হোল্ডিং নিয়ে কারো আপত্তি থাকলে ১৪ মে পর্যন্ত আপত্তি জানাতে পারবেন। পরে রিভিউ বোর্ডে শুনানির মাধ্যমে তা নিষ্পত্তি করা হবে।"