মোবাইল, ফ্রিজ, এসি, এলপি গ্যাসের সিলিন্ডারে ভ্যাট বাড়ানোর পরিকল্পনা এনবিআরের
বর্তমানে কর অব্যাহতি অথবা হ্রাসকৃত হারে কর প্রদানের সুবিধা পাচ্ছে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কিছু ইলেকট্রনিক্স পণ্য। আসন্ন বাজেটে এগুলোর ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে দেশের রাজস্ব কর্তৃপক্ষ। আসন্ন বাজেটে ভোক্তাদের জন্য এটি আরেক দুঃসংবাদ হতে পারে।
এর মধ্যে রেফ্রিজারেটর, এসি, মোবাইল ফোন ও এলপি গ্যাস সিলিন্ডারের মতো পণ্য থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তারা।
এ ছাড়া, চিনিযুক্ত কিছু জুসের ওপর ভ্যাটের হার বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হতে পারে। জুস প্রস্তুতকারকদের বার্ষিক বিক্রি বা টার্নওভারের ওপরেও ন্যূনতম করের হার বাড়তে পারে।
তামাকজাত পণ্যের মূল্য ও সম্পূরক শুল্কের হারও উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে রাজস্ব বোর্ডের।
এসব পরিকল্পনার বিরোধিতা করে ভোক্তা ও শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রায় দুই বছর ধরে চড়া মূল্যস্ফীতিতে নাভিশ্বাস ওঠা সাধারণ মানুষের দুর্দশা এতে আরো বাড়বে।
অন্যদিকে, চিনিযুক্ত আইটেম ও তামাক পণ্যের ক্ষেত্রে এনবিআরের পরিকল্পনাটিকে ইতিবাচক বলেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
বর্তমানে রেফ্রিজারেটর উৎপাদক পর্যায়ে ভ্যাটের হার ৫ শতাংশ, মূল্য সংযোজনের পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রে তা ২ থেকে ৭.৫ শতাংশ, এবং বিক্রয় পর্যায়ে ৫ শতাংশ।
জুসসহ কিছু চিনিযুক্ত পানীয়ে বিদ্যমান ভ্যাট হার ৫ থেকে ৭.৫ শতাংশ, অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে পুরোপুরি ভ্যাট অব্যাহতি পাচ্ছে এয়ার কন্ডিশনার।
এলপি গ্যাস সিলিন্ডারের উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট ৭.৫ শতাংশ।
এনবিআরের রাজস্ব নীতি প্রণয়নের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত সূত্রগুলো জানায়, এয়ার কন্ডিশনার উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাটের হার ৫ শতাংশ করা হতে পারে।
রেফ্রিজারেটর ও মোবাইল হ্যান্ডসেটের ক্ষেত্রে ২ শতাংশের বেশি বাড়ানো হতে পারে। আর এলপিজি সিলিন্ডারে সামান্য বাড়ানো হবে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
গত তিন মাসের প্রাক-বাজেট সভাগুলোতে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রাহমাতুল মুনিম ইঙ্গিত দেন যে, যেসব খাত এরমধ্যেই অনেকটা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেছে, তাদেরকে দেওয়া কর ও ভ্যাট অব্যাহতি কমানো হবে।
তিনি বলেন, "যেসব শিল্প একটা শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গেছে, তাঁদেরকে সাপোর্ট দেওয়া (কর অব্যাহতি) ধীরে ধীরে বন্ধ করতে হবে।"
ভোক্তাদের ওপর বিরূপ প্রভাব
ভোক্তাদের সংগঠন - কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন টিবিএসকে বলেন, যেকোনো প্রকার পরোক্ষ করের চাপ শেষপর্যন্ত পণ্যের ব্যবহারকারী বা ভোক্তার ওপরই এসে পড়ে।
"সরকার যদি মোবাইল ফোন, এলপিজি সিলিন্ডার, ফ্রিজ বা এসির ওপর ভ্যাট বাড়ায় – তাহলে দাম বাড়িয়ে ব্যবসায়ীরা সেই বোঝা ভোক্তার কাঁধে পার করে দেবে। এতে ভোক্তাদের খরচ বাড়বে। ইতোমধ্যেই দীর্ঘসময় ধরে বিরাজমান উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে তা আরো তীব্র করবে।"
তাই ভ্যাট বা সম্পূরক শুল্কসহ যেকোনো প্রকার পরোক্ষ কর বাড়ানোর বিরোধিতা করে তিনি প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর পরামর্শ দেন, যেটা উচ্চ আয়ের মানুষ দিতে পারবে।
দেশের অন্যতম বৃহৎ ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য উৎপাদক ফেয়ার গ্রুপ। এর প্রধান বিপণন কর্মকর্তা মো. মেসবাহ উদ্দিন বলেন, "ইলেকট্রনিক্স পণ্যে লাভের পরিমাণ ইতোমধ্যেই খুবই কম। তাই যেকোনো পর্যায়েই কোনো কর বাড়ানো হলে, আমরা সেই অনুযায়ী বাড়তি খরচটা ভোক্তাদের ওপর পার করে দিতে বাধ্য হব। আমাদের আর কোনো বিকল্প নেই।"
তিনি আরো বলেন, ইলেকট্রনিক্স পণ্যকে আর বিলাসদ্রব্য হিসেবে গণ্য করা হয় না। তাই কর বাড়ানোরও যুক্তি থাকতে পারে না। বিশেষত যখন দেশের অর্থনীতির বিবেচনায় বিদ্যমান ভ্যাটের হার খুবই উচ্চ।
গবেষণা সংস্থা – রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড) এর চেয়ারম্যান এম এ রাজ্জাক টিবিএসকে বলেন, যদি তুলনামূলক কম দামি মোবাইল ফোন বা এলপিজি সিলিন্ডারের ওপর ভ্যাট বাড়ানো হয়– তাহলে নিম্ন-আয়ের মানুষের ওপর বাড়তি আর্থিক চাপ সৃষ্টি করবে।
আরো ৩ বছর সময় চায় শিল্পগুলো
কর অব্যাহতির সুবিধা নিয়ে এর আগে স্থানীয়ভাবে মোবাইল উৎপাদনকারীরা লাভবান হয়েছে, আর সেটা স্বীকারও করেন ফেয়ার গ্রুপের মেসবাহ উদ্দিন। তবে তিনি এ-ও বলেন যে, করোনা মহামারিসহ দেশের অন্যান্য সংকটে এর সুফলগুলো হারিয়ে গেছে। গত দুই বছরে স্থানীয় মুদ্রা টাকার ৩০ শতাংশের বেশি অবমূল্যায়ন হওয়ার ঘটনা তাদের আর্থিক চাপকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।
মেসবাহ উদ্দিন বলেন, ভ্যাট আরোপের প্রভাব নিয়ে এরমধ্যেই ধুঁকছে মোবাইল উৎপাদকরা। ২০২৩ সালে মোবাইল ফোনের বিক্রি কমেছে ৩৫ শতাংশ, সেই ধারাবাহিকতা চলতি বছরেও আছে।
"আমাদের চাওয়া হলো– বিদ্যমান ভ্যাট হার এবং আমদানি কর সুবিধা আরো তিন বছর রাখা হোক। আমাদের এমন নীতি দরকার যা এ শিল্পের টিকে থাকা নিশ্চিত করবে" - যোগ করেন তিনি।
তবে র্যাপিডের চেয়ারম্যান এম এ রাজ্জাক মনে করেন, ফ্রিজ বা এসির মতো পণ্যে কর অব্যাহতির সুবিধা কমানো যেতে পারে। "সরকার রাজস্ব বাড়ানোর চাপের মধ্যে আছে। আর দীর্ঘসময় ধরেই এসব শিল্প (কর) সুবিধা পেয়ে আসছে" - যোগ করেন তিনি ।
এক দশক আগেও বাংলাদেশে ব্যবহৃত প্রায় সকল মোবাইল ফোন আমদানি করতে হতো। বর্তমানে মুঠোফোনের চাহিদার ৯৫ শতাংশই পূরণ করছে স্থানীয় উৎপাদনকারীরা। এনবিআরের সমর্থন পেয়ে এসি বা ফ্রিজের চাহিদার ৯০ শতাংশই মেটায় স্থানীয় খাত।
তবে গত দুই বছর ধরে এসব সুবিধা প্রত্যাহার করতে শুরু করেছে রাজস্ব কর্তৃপক্ষটি।
চিনিযুক্ত পানীয়ে ভ্যাট বসানোর প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বেনজীর আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "সুগার-সুইটেনেড বেভারেজের ভোগ কমাতে সরকার যদি কর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় – তাহলে এটি খুবই ভালো পদক্ষেপ হবে। এসব পণ্য স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। চিনি ও লবণকে বলা হয় সাদা বিষ, তাই যেকোনো উপায়ে এগুলো খাওয়া নিরুৎসাহিত করা উচিত ।"
তামাক খাত থেকে আরো ৬ হাজার কোটি টাকা
তামাকজাত পণ্যে মূল্য ও সম্পূরক শুল্ক আরো বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছে এনবিআরের সূত্রগুলো।
দামের ওপর ভিত্তি করে বর্তমানে বাজারের সিগারেটগুলোকে চারটি স্তরে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো: নিম্ন, মাঝারি, উচ্চ ও প্রিমিয়াম।
স্তর অনুযায়ী ১০ শলাকার এক প্যাকেট সিগারেটের দাম ৪৫, ৬৭, ১১৩ ও ১৫০ টাকা পর্যন্ত। চারটি স্তরে সম্পূরক শুল্কের হার ৫৮ থেকে ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত।
রাজস্ব বোর্ডের সূত্রগুলো জানিয়েছে, প্রতিটি স্তরের খুচরা মূল্য ৫ টাকা করে বাড়ানো হতে পারে। এছাড়া, কিছু পর্যায়ে সম্পূরক শুল্ক ১ থেকে ২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে।
এনবিআরের একজন কর্মকর্তা বলেন, "কী সিদ্ধান্ত হয় সেটা জানতে বাজেটের আগমুহূর্ত পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। যদি আমাদের পরিকল্পনাটি শেষপর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়, তাহলে এই খাত থেকে আগামী অর্থবছরে আরো ৬ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহ করা যাবে।"
সরকার সর্বোচ্চ রাজস্ব পায় তামাকজাত পণ্য খাত থেকে। বছরে যার পরিমাণ ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। তবে তামাকপণ্যের বিরুদ্ধেও জোরালো প্রচারণা আছে। তামাকপণ্যের ব্যবহার কমাতে এর দাম অনেকটাই বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস এর অ্যাডভোকেসি ম্যানেজার আতাউর রহমান বলেন, তামাকপণ্যের দাম বহুলাংশে বাড়াতে তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে প্রচারণা চালিয়ে আসছেন। বিশেষত তাঁরা চান যেন, নিম্ন-স্তরের তামাকপণ্যের দাম অনেকগুণ বাড়ানো হয়। এতে এগুলোর ব্যবহার নিরুৎসাহিত হবে।
"কিন্তু, যদি মাত্র ৫ টাকা দাম বাড়ানো হয়, তাহলে সেটা ব্যবহার কমাতে তেমন কার্যকর ভূমিকা রাখবে না" - যোগ করেন তিনি।