করব্যবস্থার ডিজিটালাইজেশন ২০২৯-৩০ অর্থবছরে রাজস্বকে চারগুণ করবে: সিপিডি
করব্যবস্থার ন্যায্য ও টেকসই ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে ২০৩০ সাল নাগাদ দেশের রাজস্ব আয় ১৬৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারবে, যা চলতি অর্থবছরের চেয়েও চারগুণ হবে। গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-র এক নতুন গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
রোববার (১৯ মে) ঢাকায় 'ডিজিটালাইজেশন অব দ্য ট্যাক্সেশন সিস্টেম ইন বাংলাদেশ: দ্য নেক্সট ফ্রন্টিয়ার ফর হায়ার রিসোর্স মবিলাইজেশন' শীর্ষক এক সংলাপে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
গবেষণার মূল ফলাফলগুলো তুলে ধরার সময় সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, "বাংলাদেশ যদি ২০২৮ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ ডিজিটালাইজেশন করতে পারে, তাহলে ২০২২-২৩ অর্থবছরের ৪৫ বিলিয়ন ডলারকে ছাড়িয়ে ২০৩০ সালে রাজস্ব আয় ১৬৭ বিলিয়ন ডলার হতে পারে। তবে রাজস্ব আহরণের বিদ্যমান প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে ওই সময়ে তা মাত্র ৯০ বিলিয়ন ডলার হবে।"
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) করব্যবস্থার ডিজিটাইজেশনের উদ্যোগের অভাব রয়েছে উল্লেখ করে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, "যথাযথ অভ্যন্তরীণ ও আন্ত সমন্বয় ছাড়া বাংলাদেশের রাজস্ব প্রশাসন ন্যায্য ডিজিটাইজেশন ও অটোমেশন অর্জন করতে পারবে না।"
ডিজিটাইজেশন অর্জনের জন্য তিনি তিনি ২০৩০ সালের মধ্যে একটি সময়নিষ্ঠ ডিজিটালাইজেশন এবং অটোমেশন কর্মসূচি বাস্তবায়নের পরামর্শ দেন, যার আওতায় থাকবে সম্পূর্ণ ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়া। এটি কর ব্যবস্থার আন্তঃসমন্বয়ের পাশাপাশি সফটওয়্যার ডেটাবেজের সাথেও সামঞ্জস্য রাখবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত সংলাপ অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিশিষ্টজনদের মধ্যে ছিলেন এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আব্দুল মজিদ।
তিনি বলেন, "১৯৯০ এর পর থেকে রাজস্ব বোর্ডের ডিজিটাইজেশনের লক্ষ্যে অন্তত ২৫টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এগুলোর ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়নি। গত এক দশকে এনবিআর কর ব্যবস্থার বেশকিছু অটোমেশনের প্রকল্প নেয়, এরমধ্যে বিট্যাক্স মডিউল; অটোমেটেড ভ্যাট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সিস্টেম (আইভ্যাস), এবং জাতীয় একক উইন্ডো উল্লেখযোগ্য। কিন্তু শেষপর্যন্ত এসব প্রকল্পের কোনোটিই সাফল্যের মুখ দেখেনি।"
বর্তমানে বেশকিছু ভ্যাট, ট্যাক্স ও কাস্টমস সংক্রান্ত কাজ ম্যানুয়াল প্রক্রিয়ায় করা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, "ব্যবসায়ীরা এনিয়ে এনবিআরের কাছে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন, সরকারের অন্যান্য সংস্থাও যথাযথ অটোমেশন বাস্তবায়নে ব্যর্থ হচ্ছে।"
অন্যান্য দেশের তুলনায় অটোমেশন প্রক্রিয়ায় পিছিয়ে থাকায় বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের হয়রানির কথা তুলে ধরেন পোশাক শিল্পের শীর্ষ সংগঠন- বিজিএমইএ'র পরিচালক শামস মাহমুদ।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক এই সভাপতি বলেন, "ব্যবসা পরিচালনা সহজ করার জন্য (ইজ অব ডুয়িং বিজনেস) ডিজিটাইজেশন ও অটোমেশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। (করব্যবস্থায়) যতো অটোমেশন থাকবে, ব্যবসা করা ততোই সহজ হবে।"
সংলাপে সভাপতিত্ব করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন, অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, "২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ হতে চলেছে, ফলে আমরা আগের মতো সহজে ও কম খরচের বিদেশি অর্থায়ন পাব না। আমাদের অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ বাড়াতে হবে। এজন্য ন্যায্য ও টেকসই ডিজিটাইলাজেশনের মাধ্যমে এনবিআরকে তার প্রশাসনিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে।"
কর ন্যায্যতা নিশ্চিত করার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, "কেউ যখন কর ফাঁকি দিয়ে দেশ থেকে অর্থপাচার করার পরেও কর সুবিধা পায়, তখন প্রকৃত করদাতারা নিরুৎসাহিত হয়।"
"গত ১০ বছরে কর ব্যবস্থার অটোমেশন ও ডিজিটাইজেশন নিয়ে এনবিআরের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে। কিন্তু, এর প্রকৃত ফল কোথায়?"- প্রশ্ন রাখেন এনবিআরের সাবেক সদস্য মো. আলমগীর হোসেন।
তিনি বলেন, প্রতিবেশী নেপাল সফলভাবে তার রাজস্ব বিভাগের ডিজিটাইজেশন বাস্তবায়ন করেছে। "অন্যদিকে আমরা পিছিয়ে রয়েছি।" কর ব্যবস্থার ডিজিটাইজেশন নিশ্চিত করার জন্য জোরালো রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি থাকা দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, করদাতারা কর কর্তৃপক্ষের ক্ষমতার যথেচ্ছ ব্যবহারকে ভয় পান। ডিজিটালাইজেশন এই ভয় কমাতে সাহায্য করবে বলে পরামর্শ দেন তিনি।
সরকারি ব্যয়ের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, "যেসব দেশ সরকারি ব্যয়ের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে তারা সম্ভাব্য করদাতাদের কর দিতে উৎসাহিতও করে।"
যারা কর না দিয়ে অর্থপাচার করছে, তাঁরা রাজনৈতিক ও আর্থিকভাবে যথেষ্ট প্রভাবশালী বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
রাজস্ব বোর্ডের অটোমেশনের অনেক প্রকল্প সফল হয়নি বলে স্বীকার করেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেলা মো. রাহমাতুল মুনিম। তিনি বলেন, "আমরা কারণগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছি, এবং জানতে পেরেছি এখানে স্থানীয় সম্পৃক্ততা না থাকাটা একটা বড় সমস্যা ছিল, কারণ বেশিরভাগ প্রকল্পই বাস্তবায়ন করেছে বিদেশি সত্ত্বাগুলো। এখন আমরা নিজস্ব বিশেষজ্ঞ দিয়ে অটোমেশন প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন করছি।"
অনলাইনে কর রিটার্ন জমা, উৎসে ই-ট্যাক্স কর্তন, ডকুমেন্ট ভেরিফিকেশন সিস্টেম ও অটোমেটেড অফিস ম্যানেজমেন্ট এর মতো বেশকিছু সফল স্বয়ংক্রিয়করণ প্রকল্পের কথাও উল্লেখ করেন তিনি। এছাড়া বাস্তবায়ন সম্পন্ন হওয়া ভ্যাট ও কাস্টমস প্রকল্পগুলোর কথাও তুলে উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, "সম্পূর্ণ অটোমেশন ছাড়া আমরা প্রকৃত ভ্যাট ও ট্যাক্স আদায় করতে পারব না।"
প্রতিবছর বাজেট এলেই এনবিআরকে আরো বেশি রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়, এতে রাজস্ব কর্তৃপক্ষটি 'অসহায়বোধ' করে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এই লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এনবিআরের আদায়ের বাস্তবতা আছে কিনা সেটা দেখা হয় না।
"সারাবছর আমাদের এসব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়েই ভাবতে হয়, ফলে নতুন উদ্ভাবন সম্পর্কে ভাবার সুযোগ তেমন থাকে না" যোগ করেন তিনি।