‘চোখের পলকেই আমাদের সব শেষ’
লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার চর ফলকন ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা সাহাব উদ্দিন (৬০)। ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে বিধ্বস্ত হওয়া ঘরের দিকে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখা গেল এই মৎসজীবীকে।
"কী করবো? কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। কোথায় থাকবো? নিজের নৌকাটা আর নেই। থাকার ঘর নেই। ভিটের মাটিটুকুও নেই। চোখের সামনেই সব শেষ হয়ে গেল। এমন বাতাস আর পানি জীবনে দেখিনি। পলকেই বাড়ির ৬ পরিবারের সকলের বসত শেষ গেল।বাড়ির সকলে ভাত খাইনি ২ দিন । ৫ মেয়ে আর ১ ছেলে নিয়ে এখন কোথায় যাবো? কোথায় থাকবো? কী খাবো?," কিছু জানতে চাওয়ার আগেই আগে এমন অসংখ্য কথা বলে গেলেন সাহাব উদ্দিন।
ভাঙা ঘরের স্তুপের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন আরও ৩ কিশোরী। এদের একজন মুক্তা (১৫)। গত কয়েক বছর আগে মুক্তার বাবাকে নিয়ে গেছে সর্বনাশা মেঘনা। এরপর মুক্তদের নিয়ে তার মা নানার বাড়িতেই ছোট একটি ডেরায় থাকতেন। সোমবারের ঝড় তাদের ঘর ও ভিটের মাটি এমনভাবে নিয়ে গেছে, সেখানে আর কোনো চিহ্নও নেই।
"আমি এখন কোথায় যাবো? কোথায় থাকবো? আমার বাবা নেই। জমি নেই। এখন কোনো ঘরবাড়িও নেই। রোববার থেকে মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ভাত খেতে পারিনি," নিজের অসহায়ত্বের কথা এভাবেই জানালেন মুক্তা।
ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাত বাংলাদেশের উপকূলজুড়ে অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন রেখে গেছে। খুলনা, লক্ষ্মীপুরে ঝড় এবং জোয়ারের তাণ্ডবলীলা যারা কাছ থেকে দেখেছেন, তাদের অভিজ্ঞতা ছিল ভয়াবহ। তারা জানান— এমন বাতাস আর পানি জীবনে দেখেননি তারা। পলকেই সব শেষ। সপরিবারে ভিটে-মাটিহীন হয়েছেন অনেকেই, জীবিকা তাড়নায় এখন অনিশ্চয়তায় দিন পার করছেন তারা।
সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে লক্ষ্মীপুর
সোমবার (২৭ মে) দুপুরে ঝড়ের সময় মেঘনা নদীতে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে নদীর পাড়ের অনেকের ঘরবাড়ি নিয়ে গেছে। কারো কারো ঘরের মালামাল ভাসিয়ে নিয়েছে জোয়ারের পানি। মেঘনাপাড়ের প্রায় বাড়ির বাসিন্দাদের বসতঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। অনেকের ভিটের মাটি পানিতে নিয়ে গেছে। এতে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে রয়েছে অনেকে।
রিমালের তাণ্ডবের পরে মঙ্গলবার এবং বুধবার মেঘনাপাড়ে ঘুরে দেখা গেছে, মাইলের পর মাইল শুধু ক্ষতের চিহ্ন। স্থানীয়রা বাড়ি ঘর সরানো কিংবা মেরামতের কাজে ব্যস্ত। মেঘনাতীরে নির্মাণাধীন বেড়িবাঁধের বিভিন্ন স্থানে ধস নেমেছে। কোনো কোনো জায়গায় মুছে গেছে বাঁধের চিহ্ন।
মাতব্বরহাট বাজারের উত্তরে কথা হয় ছকিনা বেগমের (৬০) সঙ্গে। তিনি জানান, এর আগে ৩ বার নদীতে তার বাড়িঘর ভেসে গেছে। সোমবার ঝড়ে আবারও একই বিপর্যয়ের সম্মুখীন তিনি।
ছকিনা বলেন, "বিকেলে ৪টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত এক গলা পানিতে ২ ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ঘরের বেশির ভাগ মালামাল ধুয়েমুছে চলে গেছে। এখন রান্না করার চাল নেই।"
কৃষক মো. আলী বলেন, "ঘরের পাশে নির্মাণাধীন বেড়িবাঁধ ছিল। তাই প্রথমে ভেবেছি পানি ঢুকবে না। এজন্য আশ্রয়কেন্দ্রে যাইনি। কিন্তু বাঁধের মাটি ধসে গিয়ে বাড়িতে পানি ঢুকে গেছে। ঘরে বুক পরিমাণ পানি ছিল। প্রথমে ঘরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। পরে খাটের ওপর উঠে পড়ি। কিন্তু থাকার মতো অবস্থা ছিল না। তাই সাঁতরে আশ্রয় কেন্দ্রে চলে গেছি।"
"বিকেল ৪টার দিকে আশ্রয়কেন্দ্রে যাই, এদিন ভোররাতে চলে আসি। বাড়িতে এসে দেখি সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। ঘরে থাকা চাল পানিতে ভিজে আছে," যোগ করেন তিনি।
সফিকুল ইসলাম বলেন, "ঘরে ছোট দুইটা ছেলে-মেয়ে আছে। তাদের মা বেঁচে নেই। জলোচ্ছ্বাসের সময় তাদের নিয়ে ঘরেই ছিলাম। ঘরে বুক পরিমাণ পানি হয়ে গেছে। তাই কাঁধের ওপর দুই বাচ্চাকে উঠিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম।"
"ঘরে খাবার নেই। বাইরে থেকে খাবার এনে খেয়েছি। কিন্তু কেউ আমাদের কোনো খোঁজ নেয়নি," জানান সফিকুল।
ঘূর্ণিঝড় রেমাল এবং মেঘনা নদীর সৃষ্ট জোয়ারের ফলে লক্ষ্মীপুরের ৪টি উপকূলীয় এলাকায় বেঁড়িবাঁধ, ঘরবাড়ি এবং মাছের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তা।
খুলনায় চলছে উপকূলবাসীর সংগ্রাম
খুলনার পরিস্থিতিও খুব বেশি ভালো নয়। খুলনার পাইকগাছার গোপীপাগলা গ্রামের বাসিন্দা দিপালী সরদার (৩২) জানান, "আমার বসত বাড়ি এখন বুক সমান পানির নিচে। ঘরের ড্রামে থাকা চাল পর্যন্ত পানিতে চলে গেছে। ৬০টি হাস-মুরগীর ও ৫টি গরুর খোঁজ মিলছে না। পরিবারের কারও পোশাক খুঁজে পাচ্ছি না। অসহায় হয়ে এখন রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছি।"
দিপালী সরদার বলেন, "সরারাত ঝড় হলে, আমরা ঘরের খুঁটি ধরে বসে ছিলাম। সকালে বাইরে বেরিয়ে দেখি, প্রচণ্ড বেগে আমাদের বাড়ির দিকে পানি ছুটে আসছে। কিছু বোঝার আগেই আমাদের সব কিছু চোখের পলকে হারিয়ে গেল। আমরা দ্রুত কিছু মালামাল নিয়ে নৌকায় উঠে রাস্তায় চলে আসলাম। পরে গিয়ে দেখি ঘরে আর কিছুই বাকি নাই।"
দিপালীর স্বামী প্রদীপ সরদার বলেন, "চিংড়ির ঘের ছিল আমাদের একমাত্র আয়ের মাধ্যেম। তা নিমিষেই তলিয়ে গেল। অথচ এটা দিয়েই আমার সারাবছর চলতে হয়। গত দুইদিন ধরে শুধু শুকনা খাবার— কখনো মুড়ি, কখনো চিড়া ও নদীর লবণাক্ত পানি খেয়ে বেঁচে আছি। আমার সংসারে কোনো অভাব ছিল না, মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে সব কিছু হারিয়ে গেল।"
গোপীপাগলা গ্রামের চেয়ে পাশ্ববর্তী তেলিখালী গ্রামের অবস্থা আরও ভয়াবহ। সেখানে শত শত বাড়ির মধ্যে অন্যতম গাজী বাড়ি। যেখানে ২০টি বসত বাড়ি ছিল। তার মধ্যে ১৫টি বাড়ি ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত ও বিধ্বস্ত হয়েছে, পরে প্লাবিত হয়ে চলে গেছে পানির নিচে।
ওই বাড়ির বাসিন্দা এনামুল গাজী বলেন, "এত ভয়াবহ ক্ষতি আমাদের আগে কোনো দিনই হয়নি। এখন আমাদের বাড়ির বাসিন্দারা রাস্তায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনটি পরিবার একেবারে সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে।"
এই গ্রামগুলো পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২২ নং পোল্ডারের অন্তর্গত। রোববার ঝড়ের রাতে ওই পোল্ডারের তেলিখালী এলাকায় ভদ্রা নদীর বাঁধ প্রায় ৬০০ ফুট ভেঙে যায়। ফলে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে।
বাঁধ ভেঙে গিয়ে ভদ্রা নদীর পানিতে আশেপাশের আরও ১১টি গ্রামের অধিংকাংশ বাড়ি প্লাবিত হয়েছে। সেগুলো হল— সৈয়দখালী, খেজুরতলা, সেনের বেড়, হাটবাড়ি, ফুলবাড়ি, বাগীরদানা, দুর্গাপুর, কালি নগর, দারুল মল্লিক, হাবিখোলা ও নোয়াই গ্রাম।
ওই গ্রামের স্বাস্থ্য সহকারী দীপিকা সরদার বলেন, "এই পোল্ডারের ১৩টি গ্রামে মধ্যে কমপক্ষে ১০ হাজার মানুষের বসবাস। বাঁধ ভেঙে যাওয়া ওই মানুষগুলো এখন বসত হারা হয়ে গেছে। খাবার মতো কোনো পানি নেই। অধিকাংশ মানুষের কাছে খাবার নেই। গত দুই দিন ধরে কেউ আমাদের গ্রামের খোঁজও নেয়নি। আজ সরকার পর্যায়ের কিছু লোক এসে সামান্য ত্রাণ বিতরণ করছেন।"
তবে পাইকগাছা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহেরা নাজনীন বলেন, "ওই এলাকার মানুষের জন্য আমরা ইতোমধ্যে ত্রাণ পাঠিয়েছি। তবে ক্ষতির তুলনায় তা পর্যাপ্ত নয়। ঊর্ধ্বতনদের কাছে আরও ত্রাণের আবেদন করা হয়েছে।"
বুধবার দুপুরে গিয়ে গেখা যায়, তেলিখালী যে স্থানে বাঁধ ভেঙে গেছে, সেই স্থানে এলাকার হাজারো নারী-পুরুষ একত্র হয়ে রিং বাঁধ দিয়ে পানি আটকানোর চেষ্টা করছেন।
বাঁধ মেরামতে অংশ নেওয়া আবতাব উদ্দীন বলেন, "আমি ৫ বিঘা জমি লিজ নিয়ে ঘের করেছিলাম। তাতে আমার প্রায় ৩ লাখ টাকা বিনিয়োগ ছিল। তবে প্লাবনের কারণে একেবারে সব ধুয়ে-মুছে চলে গেছে। ঘেরে এখন কোনো মাছই নেই। তবু ঘেরটাকে তো টিকিয়ে রাখতে হবে। তাই অন্যান্যদের সাথে স্বেচ্ছায় এসে বাঁধ মেরামতে অংশ নিয়েছি।
সেখানে থাকা মতিয়ার রহমান নামের আরেক ব্যক্তি বলেন, "এই বাঁধ সংস্কার করে পানি আটকাতে না পারলে আমাদের এলাকা রক্ষা করা যাবে না। প্রতিদিন জোয়ারের পানিতে বসত বাড়ির সবকিছু হারিয়ে যাচ্ছে। না পেরে অসুস্থ শরীর নিয়ে বাঁধ মেরামত করতে এসেছি।"
টেকসহ বাঁধ নির্মাণ করা না হলে এই এলাকায় একই ধরনের ক্ষতি বারবার হবে বলে জানান স্থানীয় খুলনা-৬ আসনের সংসদ সদস্য মো. রশীদুজ্জামান।
তিনি বলেন, "১৯৬০ সালের দিকে পাকিস্তান সরকার এই বাঁধ নির্মাণ করেছিল, যার মেয়াদ ছিল ২০ বছর। তবে দুঃখের বিষয় হল বিগত ৬৪ বছরের মধ্যে এই বাঁধ কখনো সংস্কার করা হয়নি। ফলে বারবার কোনো না কোনো এলাকা প্লাবিত হয়। আমি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে এই এলাকায় টেকসই বাঁধ নির্মাণের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।"