ভারতের তীব্র তাপদাহে ভবন ঠাণ্ডা রাখতে প্রাচীন টেরাকোটা এয়ারকুলার যেভাবে সাহায্য করছে
ভারতে গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাপে পোড়ামাটির পাত্রে পানি ঠান্ডা করার প্রাচীন পদ্ধতিকে যেন নতুন করে কাজে লাগানো হচ্ছে। এক্ষেত্রে ভবন ঠাণ্ডা করতে এটিকে অনেকটা এয়ার কুলারের মতো ব্যবহার করা হচ্ছে। খবর বিবিসির।
নন্দিতা আইয়ার নামের ভারতীয় ফুড ব্লগার ফ্রিজের ঠাণ্ডা পানি খুব একটা পছন্দ করেন না। তবে এই মে মাসে যখন ভারতে তাপমাত্রা বেড়েছে, তখন রান্নার বইয়ের জনপ্রিয় এই লেখক নিজে পানি পানের ক্ষেত্রে ভিন্ন কৌশল খুঁজতে থাকেন। এক্ষেত্রে বেঙ্গালুরুতে বসবাস করা এই নারীর শৈশবে দেখা এক পদ্ধতির কথা মনে পরে। মূলত এটি হচ্ছে দুটি ভিন্ন ধরণের কাদামাটি দিয়ে তৈরি পোড়ামাটির পাত্র যা মটকা নামে পরিচিত। এটি বাড়িতে ঘরোয়া ওয়াটার কুলার হিসাবে ব্যবহার করা হয়।
নন্দিতা বলেন, "আমার দাঁত বেশ সংবেদনশীল। তাই ফ্রিজের পানি পান করা আমার জন্য কষ্টকর। অন্যদিকে মটকা পানিকে যথেষ্ট ঠাণ্ডা রাখে; যা পান করতে বেশ আরামদায়ক।"
নদিতা আরও বলেন, "আমার মনে আছে প্রাকৃতিকভাবে ঠাণ্ডা এই পানি মুম্বাইয়ের গ্রীষ্মের গরমে বেশ কাজে লাগতো। তাই যখন বেঙ্গালুরুর আবহাওয়া মুম্বাইয়ের মতো আচরণ করতে শুরু করে, তখন আমি এরকম পাত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।"
বহু আগে থেকেই অবশ্য মটকার ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে যখন পানি পোড়ামাটির পাত্রে রাখা হয় তখন তা প্রতিটি ছিদ্রে স্পর্শ করে। তখন এই ছিদ্রগুলির ভেতরে আটকে থাকা পানি বাষ্পীভূত হওয়ার সাথে সাথে প্রক্রিয়াটি ধীরে ধীরে পানির ভেতর থেকে সুপ্ত তাপ বের করে। এক্ষেত্রে বাষ্পীভবনে তাপ হারানোর পর পাত্রটি শীতল হয়ে যায় এবং ভেতরের অবশিষ্ট পানিও ঠান্ডা হয়ে যায়।
শত শত বছর ধরে ভারতের গ্রামীণ এলাকায় পানি ঠাণ্ডা করতে মাটির পাত্রের ব্যবহার করা হয়। ৩ হাজার বছরেরও বেশি আগে হরপ্পা সভ্যতায়ও এই নিদর্শন দেখা যায়।
নন্দিনী প্রচুর রান্না করেন বিধায় তার ফ্রিজে বেশ কয়েকটি পানির বোতল রাখার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা নেই। সেক্ষেত্রে মটকা বেশ কার্যকরী।
কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ভারত তাপদাহের সাথে প্রচণ্ড লড়াই করছে। সেক্ষেত্রে ঘরবারি ঠাণ্ডা রাখার প্রয়োজনীয়তা আরও গভীরভাবে অনুভূত হচ্ছে। চলতি গ্রীষ্মে দিল্লির তাপমাত্রা ৫২.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁয়েছে। ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত তাপদাহে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণে প্রতি ঘণ্টায় বিদ্যুতের চাহিদা ২৮ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এক্ষেত্রে ঘরবাড়ি ঠাণ্ডা রাখতে পোড়ামাটির প্রাচীন পদ্ধতি যেন নতুন করে ব্যবহৃত হচ্ছে।
টেরাকোটার ব্যবহার প্রাচীন চীনা ও গ্রীক মৃৎশিল্প থেকে শুরু করে মিশরীয় শিল্পকলা পর্যন্ত বিস্তৃত। এক্ষেত্রে ২০১৪ সালে কুলএন্টের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান স্থপতি মনীশ সিরিপুরাপু টেরাকোটার ব্যবহারকে নতুনভাবে রুপদান করেন।
মূলত মনীশের একজন ক্লায়েন্ট একটি সমস্যার সম্মুখীন হন। তার কারখানায় একটি ডিজেল জেনারেটর দুটি বিল্ডিংয়ের মধ্যবর্তী স্থানে এত বেশি গরম বাতাস ছড়াচ্ছিল যে, ঐ তাপ কর্মীদের জন্য অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। যা মাথাব্যথা ও বমি বমি ভাবের পর্যন্ত সৃষ্টি করে। সিরিপুরাপু মূলত টেরাকোটা স্থাপনের মাধ্যমে সমস্যাটি সমাধানের চেষ্টা করেন।
তিনি বলেন, "আমার সমস্ত কাজ প্রকৃতিকে মাথায় রেখে। আমি নতুন সব প্রযুক্তির খোঁজ করতে চেয়েছিলাম।"
এক্ষেত্রে মটকার কৌশলটি ব্যবহারের ভাবনা সিরিপুরপুরের মনে আসে। তিনি বলেন, "মটকার পাত্রের পানি স্বাভাবিকভাবেই ঠাণ্ডা হয়। কারণ যখন এটি পানি বাষ্পীভূত করে তখন তা পাত্রের তাপ শুষে নেয়। এক্ষেত্রে আমি যদি সেই একই প্রক্রিয়াটিকে উল্টোভাবে ব্যবহার করি তাহলে কী হবে? তখন আমার মনে হয় যে, আমরা পোড়ামাটির চারপাশের বাতাসকে একইভাবে ঠান্ডা করতে পারি।"
এক্ষেত্রে সিরিপুরাপুর ডিজাইনে পুনঃব্যবহৃত পানি পোড়ামাটির উপর পাম্প করা হয়। এক্ষেত্রে পোড়ামাটির ছিদ্রের ভিতর থেকে পানি বাষ্পীভূত হওয়ার সাথে সাথে এটি চারপাশের বাতাসকে ঠাণ্ডা করে।
এক্ষেত্রে কুলএন্টের পক্ষ থেকে বিহাইব (মৌচাক আকৃতির) নামে একটি স্টেইনলেস স্টিলের কাঠামোর চারপাশে প্রায় ৮০০ থেকে ৯০০টি পোড়ামাটির কোণ হাতে তৈরি করা হয়েছিল।
তাদের প্রথম বিহাইব স্থাপনের পর থেকে কোম্পানিটি পুনে থেকে শুরু করে জয়পুরসহ সারা দেশে স্কুল, পাবলিক স্পেস, বিমানবন্দর এবং বাণিজ্যিক ভবনগুলিতে ৩৫টি কুলিং টাওয়ার তৈরি করেছে। এছাড়াও তারা বিহাইব নকশার পাশাপাশি অন্যান্য ডিজাইন নিয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে।
এদিকে গবেষকরা পোড়ামাটির কুলিং প্রোটোটাইপ নিয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। এক্ষেত্রে ভারতের মহারাষ্ট্রের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থীরা একটি পোড়ামাটির এয়ার কন্ডিশনার তৈরি করেছিল। এটি বাতাস শুষে নিতে ও তা ভেজা পোড়ামাটির উপর দিয়ে বের করে দেওয়ার জন্য একটি পাখা ব্যবহার করেছিল। এর ফলে সেখানকার তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে বলে তারা রিপোর্ট করেছে।
ভারতের আর্কিটেকচার ফার্মগুলি জানায়, তাদের পোড়ামাটির স্থাপনাগুলি তাপমাত্রায় অনেকক্ষেত্রে প্রায় ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমাতে পেরেছে। যা একটি সম্পূর্ণ ভবনকে পর্যন্ত প্রাকৃতিকভাবে ঠাণ্ডা করতে পারে।
ক্লায়েন্টদের পাঠানো ভিডিও ও সাইট ভিজিটের মাধ্যমে দেখা যায়, কুলএন্ট নিজেদের বিহাইবের মতো ডিজাইন ব্যবহার করে তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমিয়েছে। এই বিষয়ে সিরিপুরাপু বলেন, "আমাদের প্রত্যাশার চেয়েও এটি অনেক ভালো ফলাফল দিয়েছে।"
এন্ট স্টুডিও বাদেও আরও বেশ কয়েকটি আর্কিটেকচার ফার্ম তাপমাত্রা কমাতে পোড়ামাটির ব্যবহার করছে। বেঙ্গালুরুভিত্তিক আর্কিটেকচার ফার্ম থ্রেশহোল্ডের অন্যতম সহ-প্রতিষ্ঠাতা স্থপতি অবিনাশ অঙ্কালগে বলেন, "গত ১০০ বছরে আধুনিক প্রযুক্তিগুলি বায়ু শীতলকরণে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে৷ তবে এগুলো আমাদের পরিবেশে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।" এক্ষেত্রে তিনি ভবনগুলির জন্য প্যাসিভ কুলিং সিস্টেম তৈরি করতে পুনর্ব্যবহৃত পোড়ামাটি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন।
অবিনাশ বলেন, "আমরা আমাদের সাম্প্রতিক বেশ কয়েকটি প্রজেক্টের জন্য পোড়ামাটির দিকে ঝুঁকছি। সেক্ষেত্রে এটিকে বেশ কয়েকটি উপায়ে ব্যবহার করা হচ্ছে৷"
দক্ষিণ বেঙ্গালুরুতে একটি বাণিজ্যিক ভবনে সূর্যের তাপ থেকে বাঁচতে থ্রেশহোল্ডের পক্ষ থেকে টেরাকোটার একটা নকশা বিল্ডিংয়ের দক্ষিণ দিকে স্থাপন করা হয়েছে।
অবিনাশ বলেন, "দুপুর ১২ টা থেকে ৩টার দিকে সূর্য যখন সবচেয়ে তীব্র থাকে, তখন উপরের টাইলের ছায়া নীচের দিকে পরে। ফলে সূর্যের আলো সরাসরি বিল্ডিংটিতে স্পর্শ করতে পারে না।"
আবিনাশ আরও বলেন, "আমরা একে পারস্পরিক ছায়াকরণ নীতি বলি। এটি রাজস্থানের অনেক পুরানো শহরে বিশেষ করে জয়পুর ও জয়সালমেরে ব্যবহৃত হতো। এটি প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ বছর আগে বাড়ি, প্রাসাদ ইত্যাদি সর্বত্র ব্যবহৃত হত।"
নীতিটি ব্যবহার করে আধুনিক নকশায় মূল ভবনটি পোড়ামাটির পর্দার কাঠামোর ৩ থেকে ৪ ফুট পেছনে নির্মাণ করা হয়। আবিনাশ বলেন, "টেরাকোটা একটি প্রাকৃতিক উপাদান হওয়ার কারণে সবসময় গাছপালা দ্বারা আচ্ছাদিত করা হয়। যার আরও শীতল প্রভাব রয়েছে। এটি একটি স্বাস্থ্যকর জীববৈচিত্র্যকে নির্দেশ করে।"
বেঙ্গালুরু থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে একটি খামারবাড়িতে থ্রেশহোল্ড শীতলীকরণের ক্ষেত্রে প্রথাগত ইটের বিকল্প হিসাবে পোড়ামাটির ইট নিয়ে পরীক্ষা করেছে। আবিনাশের মতে, এগুলি পরিবেশের জন্য বেশ উপযোগী৷
কেননা পোড়ামাটির ইটগুলি ৬০০ থেকে ৭০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পোড়াতে হয়; যা প্রথাগত ইট তৈরিতে প্রয়োজনীয় তাপমাত্রার অর্ধেক। একইসাথে এই ইট বিল্ডিংয়ে ভেতরে ৫ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা হ্রাস করতে পারবে বলে ধারণা করা হচ্ছে৷
আর্কিটেকচার ফার্মগুলি ভবন শীতল করার লক্ষ্যে ভারতের আদিবাসী পোড়ামাটির কারিগরদের সাহায্যও নিচ্ছে৷ তাদের মধ্যে একজন হলেন দোলন কুন্ডু মন্ডল, যিনি কলকাতায় বসবাস করেন এবং যার পোড়ামাটির শিল্পকর্ম জাতীয় পুরস্কার জিতেছে।
শৈশবে মন্ডল নদীর তীর থেকে কাদামাটি সংগ্রহ করে ছোট পুতুল, পশু, পাখি ইত্যাদি বানাতেন। তার নিজের বাড়িটিও মাটি দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। তবে সেখানে পানি আটকানোর কোনো ব্যবস্থা ছিল না, তাই প্রতি বর্ষার পরে বাড়িটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যেত।
মণ্ডল বলেন, "আমার দাদি, বড় বোন ও আমি খড় টুকরো টুকরো করে মাটিতে মিশিয়ে বসবাসের জন্য ঘরটি পুনর্নির্মাণ করতাম।"
মন্ডল জানান, তিনি সবসময় কাদামাটি দিয়ে নতুন কিছু ভাস্কর্য তৈরি করার স্বপ্ন দেখতেন। সম্প্রতি তিনি একটি বাড়ির জন্য পোড়ামাটির কাজ করার প্রস্তাব পেয়েছেন। মন্ডল বলেন, "ছোটবেলা থেকেই আমি সবসময় কাদামাটির সংস্পর্শে বড় হয়েছি।"
উত্তর ভারতের গুরুগ্রামে অবস্থিত থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভস-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট সৌমেন মৈত্রী বলেন, "পোড়ামাটির নির্মাণগুলি গ্রামীণ কারিগরদের জীবিকার ব্যবস্থা করছে। তবে এর কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে৷ ভবনে অতিরিক্ত পোড়ামাটির কাঠামো ইতোমধ্যে সঙ্কুচিত শহরগুলিতে অনেক জায়গা দখল করতে পারে। এছাড়াও সময়ের সাথে সাথে এগুলোর শীতলীকরণের কার্যকারিতা হ্রাস পেতে পারে। কেননা পোড়ামাটির মাইক্রো ছিদ্রগুলিতে ধুলাবালি আটকে যেতে পারে। যা পরবর্তীতে পরিষ্কার করা ও যত্ন সহকারে রক্ষণাবেক্ষণ করা অপরিহার্য।
অনুবাদ: মোঃ রাফিজ খান